অগ্রহণযোগ্য আচরণ এর কারণ অসামাজিক ব্যক্তিত্বজনিত রোগ

অগ্রহণযোগ্য আচরণ এর কারণ অসামাজিক ব্যক্তিত্বজনিত রোগ

দিনে দিনে আমাদের সমাজ অস্থির হয়ে উঠছে। সমাজবিরোধী কর্মকান্ড ক্রমশই বাড়ছে। দুর্বৃত্তপরায়ণতা, মারামারি, ছিনতাই, নির্যাতন, হত্যা ইত্যাদি যেন আজ নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি বিমান ছিনতাইয়ের মতো বিরল উদাহরণও আছে আমাদের দেশে। তবে সমাজবিরোধী কর্মকান্ড কি আগে ছিল না? ছিল তো অবশ্যই। কারণ এসব কর্মকান্ড মানুষের ব্যক্তিত্বের সাথে অনেকটাই সম্পর্কযুক্ত।

মনোবিজ্ঞানে ব্যক্তিত্ব বা পার্সোনালিটি শব্দটি ব্যবহার করা হয় একজন ব্যক্তির কথাবার্তা, চলাফেরা, ভাবভঙ্গি বা আচার আচরণকে ব্যাখ্যা করার জন্য। এই ব্যক্তিত্ব বংশানুক্রমিকভাবে পূর্বপুরুষের কাছ থেকে কিছুটা আসলেও মূলত চারপাশের পরিবেশ থেকে শেখার ফলে গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। জীবনে পরিবেশগত বিভিন্ন (বাড়িতে, শিক্ষাঙ্গনে, কর্মস্থলে) কারণে প্রত্যেকের মধ্যে আলাদাভাবে জন্ম নেয় মৌলিক ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্বের কারণেই প্রতিটি মানুষ একেকজন আলাদা সত্তা। এ মৌলিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে যখন কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তখন তাকে পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার বা ব্যক্তিত্বজনিত রোগ বলে। যার ফলে শুধু ব্যক্তির নিজেরই নয়, তার আশেপাশের মানুষদেরও ভোগান্তি হয়।

ব্যক্তিত্বজনিত রোগের আবার বিভিন্ন ধরন আছে যার মধ্যে সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্বজনিত রোগ বা অ্যান্টিসোশ্যাল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার অন্যতম। সমাজবিরোধী বা অসামাজিক ব্যক্তিত্বজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি তার নিজের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু, সহপাঠী বা সহকর্মী কারো সঙ্গেই মানিয়ে চলতে পারেন না। তারা পারিপার্শ্বিক নানা বিষয় মেনে নিতে পারেন না এবং আবেগের বহিঃপ্রকাশও সঠিকভাবে করতে পারেন না। নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তারা অত্যন্ত একগুঁয়ে ধারণা পোষণ করেন। এ রোগ সাধারণত মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের বেশি হয়ে থাকে এবং রোগের জন্যে কোনো নির্দিষ্ট কারণ এককভাবে দায়ী থাকে না। জৈবিক, পরিবেশগত ও সামাজিক বিভিন্ন কারণের সমন্বয়ে এ ধরনের রোগ হয়ে থাকে। কারণগুলোর মধ্যে উল্লখযোগ্য হচ্ছে-

  • বংশগত বা জেনেটিক যেমন : বাবা-মা থেকে বা উত্তরাধিকসূত্রে প্রাপ্তি
  • মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক পদার্থের (Neurotransmitters) আধিক্য, ঘাটতি বা সঠিকভাবে কাজ করতে না পারা
  • মস্তিষ্কের যে অংশটি বিচার বিবেচনা পরিচালনা করে ও সহিংস আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, তার পরিমাণের ঘাটতি হওয়া
  • বিশৃঙ্খল পারিবারিক জীবন
  • শিশুকাল থেকে নিকটজনের বিভিন্ন হিংসাত্মক আচরণ অবলোকন
  • ছোটবেলায় বিভিন্ন মানসিক চাপ, দুর্ব্যবহার, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের ভেতর কাটানো
  • হিংসাজনিত মানসিক আঘাত ইত্যাদি।

সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্বজনিত রোগের উপসর্গ সাধারণত আঠারো বছরের আগে প্রকাশ পায় না। এ রোগের প্রভাবে মানুষের আচরণ হয় নিষ্ঠুরতম। এরা নিম্নে বর্ণিত সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য কিছু আচরণের মাধ্যমে এক অস্থির অস্বস্তিকর পীড়াদায়ক পরিস্থতির সৃষ্টি করেন-

  • প্রতারণামূলক আচরণ
  • অন্যদের ওপর নির্মম, নিষ্ঠুর, হিংস্র, ধ্বংসাত্মক ও আগ্রাসী আচরণ
  • স্বেচ্ছাচারিতা
  • আবেগপ্রবণতা ও সহিংসতা
  • খিটখিটে মেজাজ
  • পরিবার ও সমাজের নিয়মকানুন না মেনে বেপরোয়া চলাফেরা করা
  • দায়িত্বহীনতা
  • অন্যদের প্রতি চূড়ান্ত উদাসীন মনোভাব পোষণ করা ও অন্যদের অধিকার অমান্য করা
  • নির্যাতন, ছিনতাই ও হত্যা জাতীয় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া
  • অন্যের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের পরও অপরাধবোধ না অনুতাপ থাকা
  • নিজেকে যোগ্য এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তি মনে করা
  • পোষা জন্তুদের ওপর অত্যাচার করা
  • মিথ্যে কথা বলা
  • ক্ষমা চাওয়ার অভিনয় করা ইত্যাদি।

এ ধরনের রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কগুলোকে অপব্যবহার বা অবহেলা করে নিকটজনকে শোষন-পীড়নে লিপ্ত থাকে। এরা মাঝে মাঝে বিভিন্ন সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার জন্য মিথ্যা এবং প্রতারণামূলক আচরণও করে। অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মনোবৃত্তির বাইরে তাদের কোনো লক্ষই থাকে না। তারা পরবর্তীতে এক সময় অন্যান্য মানসিক রোগ যেমন : উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা কিংবা নেশায়গ্রস্ততায় আক্রান্ত হয়ে যায়। তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের রোগীর রোগ সম্বন্ধে নিজের অন্তর্দৃষ্টি থাকে না ও তারা নিজেকে কখনই রোগী হিসেবেই মনে করেন না। আবার সমাজেও তাদেরকে রোগী হিসেবে বিবেচনা করে না। রোগের তীব্রতাভেদে তাদেরকে মাথাগরম, একগুঁয়ে, রগচটা ইত্যাদি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। রোগের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করে যখন তারা সমাজিক নানা অপরাধূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয় তখন তাদেরকে সন্ত্রাসী বলা হয়।

অনেকের আবার বদ্ধমূল ধারণা যে, একটু বোঝালেই তাদের আচরণ শোধন করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে ব্যক্তিত্বের রোগ ইচ্ছাকৃত কোনো জেদ নয়। কাজেই সঠিক সময় এর চিকিৎসা শুরু না করা গেলে রোগীর ব্যক্তিগত ক্ষতির সাথে সাথে তার আশেপাশের মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সামাজবিরোধী ব্যক্তিত্বজনিত রোগ একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ। কাজেই এর চিকিৎসাও দীর্ঘমেয়াদি। অন্যের অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল হওয়া এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য উৎপাদনশীল কর্মকান্ড উৎসাহ দেয়ার লক্ষ্যে তাদেরকে মনস্তাত্বিক চিকিৎসার (জ্ঞানীয় থেরাপি, আচরণগত থেরাপি ইত্যাদি) আওতায় আনা প্রয়োজন। অনেক সময় উপসর্গের ভিন্নতা অনুসারে বিভিন্ন ঔষধেরও প্রয়োজন হয়। অপরাধমূলক ঘটনাগুলিতে সংশোধনাগার বা পুনর্বাসন কেন্দ্রেরও প্রয়োজন আছে।

সামাজবিরোধী আচরণর পরিবর্তন কখনোই দ্রুত হবে না। এই ক্ষেত্রে, পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় ধৈর্যের সাথে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারলে রোগীর আচরণের পরিবর্তন করা সম্ভব। কাজেই সামাজে অস্থিরতা সৃষ্টিকারী সবাইকে ঢালাওভাবে দুর্বৃত্ত কিংবা সন্ত্রাসীর কাতারে ফেলে না দিয়ে সামাজবিরোধী ব্যক্তিত্বজনিত রোগীদের চিহ্নিত করে তাদের চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। রোগীর চিকিৎসা ও রোগের পরিবেশগত কারণগুলো নির্মূলের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে সামাজিক অবক্ষয় অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।

তথ্যসূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleভোরে জাগলে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি কমে: গবেষণা
Next articleসন্দেহপ্রবণ মানুষের আয়ু কম হয়: গবেষণা
অধ্যাপক ডা. সুস্মিতা রায়
অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, সিলেট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here