“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই”- প্রাণের এ আকুতি শুধু রবিঠাকুরের নয়, এ যেন সবার মনের একান্ত চাওয়া। জন্মিলে মরিতে হইবে- এ কথা ধ্রুব সত্য। কিন্তু তার চেয়ে ও সত্য হচ্ছে কোনো মানুষই মরতে চায় না; যদি না তার গুরুতর কোনো মানসিক বা শারীরিক সমস্যা থাকে।
মৃত্যু সম্পর্কে বিভিন্ন জনের মতামত ও প্রস্তুতি ভিন্ন হয়ে থাকে। একজন ৯০ বছরের বৃদ্ধ/ বৃদ্ধা যিনি কুঁজো হয়ে হাঁটেন, হাসলে যার শুধু মাড়ি দেখা যায়, মাথায় চুল নেই অথবা সব সাদা হয়ে গেছে, যিনি জানেন তার দিন ঘনিয়ে এসেছে, ভুল আর সঠিক এর হিসেব কষার সক্ষমতা ও যার আগের মতো নেই, অন্যের কথা বাদ- নিজ জীবনের দায়িত্বই যিনি নিতে পারেন না, নতুন করে কিছু পাবার বা দেবার কোনো কিছুরই যার অবকাশ নেই, এমন কাউকে ও যদি প্রশ্ন করা হয় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত কিনা বা কতটুকু প্রস্তুত- হয়তো নীরবতাই হবে সরব উত্তর।
আবার মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এমন কারও হয়তো আক্ষেপ থাকে – ইস্ আর কটা দিন যদি সময় পেতাম তাহলে প্রিয়জনদের সাথে হেসে-খেলে কাটাতাম, জীবনটাকে নতুন করে সাজাতাম- যেখানে কোনো ভুল, কোনো পাপ থাকতো না, কোনো কদর্য কিছু থাকতো না।
কেউ হয়তো ভাবেন জীবনে সব অর্জন শেষে, মা- বাবা, সন্তান- সন্ততি সবার একটা গতি করার পর জায়নামাজ এ বসে যাবেন, হজ্জ্ব পালন করবেন, যিকির- আজগর করবেন যাতে পরকালের পথ প্রশস্ত করবেন, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেবেন।
একজন মধ্যবয়সী সফল নারী বা পুরুষ যার অনেক চাওয়াই পুরণ হয়েছে, তিনি হয়তো ভাবেন অন্যের মন্গলের জন্য কিছু করতে পারলে, জগতবাসীর জন্য কিছু করতে পারলে তার জীবন সার্থক হবে, আর অক্লান্ত, নিঃস্বার্থ শ্রম দিয়েই যাওয়াটাই হয়তো তার কাছে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি।
একজন ছোটো শিশু যে জীবন কি তা- ই বুঝে উঠতে পারেনি তাকে যদি মৃত্যু সম্পর্কে বলা হয়, সে হয়তো অবলীলায় বলবে ‘মরার পর ভুত হয়ে আমি দুষ্ট লোকের ঘাড় মটকাব’, অথবা বলবে ‘আমি কখ্খনোই মরবো না, সবসময় বেঁচে থাকবো’।
জীবন যতই কষ্টের, যতই বেদনার হোক, একজন সুস্হ মনের মানুষ কখনোই মরতে চায় না। আবার কার কখন, কিভাবে মৃত্যু হবে এটা কেউ ই জানেন না। তাই মৃত্যু অনিবার্য জেনে ও অনেকের প্রস্তুতি নেয়া হয়ে উঠেনা, অনেকে হয়তো মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন কিন্তু পুরোপুরি প্রস্তুতি নেয়ার আগেই মৃত্যু দরজায় কড়া নাড়ে।
সমাজিক ও ধর্মীয় বিধি- নিষেধ এবং দায়- দায়িত্ব মেনে চলে, পৃথিবীতে স্মরণীয় হতে কিছু করে যেতে পারাটাই হয়তো বা মৃত্যর জন্য প্রস্তুতি।
তীব্র বিষন্ন একজন মানুষ যে মনে করে তার বেঁচে থাকাটা অর্থহীন, সে মরে গেলে তার আপনজনেরা মুক্তি পাবে, যে নিজেকে সব অনিষ্টের মুল ভাবে, যার কাছে তার অতীত, বর্তমান সব ব্যর্থতায় ভরা মনে হয়, মনে হয় ভবিষ্যৎ অন্ধকার – সেই মানুষ তার নিজকে শেষ করার কথা ভাবে, পরিকল্পণা করে, অনেকসময় নিজেকে খুন করে ফেলে। সাইকোটিক রোগী যাদের কমান্ডিং হ্যালুসিনেশন হয়, সর্বক্ষণ কানে আওয়াজ আসে.. কেউ বলছে ” তুই মর বা তোর মরে যাওয়া উচিত” – যা তার মনে এক প্রচন্ড মানসিক চাপ তৈরী করে, তখন সেই মানসিক চাপ, অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ আত্মহত্যা করে ফেলে।
টিন এজারদের মাঝে যাদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা কম থাকে, তাদের কে কেউ হাত/ পা কাটাকাটি, ঘুমের ঔষধ খাওয়া, দেয়ালে মাথা ঠোকা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের আত্মঘাতী মুলক আচরণ করার মধ্য দিয়ে মানসিক চাপমুক্ত হতে গিয়ে অনেক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তাছাড়া, দীর্ঘ মেয়াদী মানসিক চাপ যেমন দারিদ্র, যৌতুক, গৃহনির্যাতন, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, বিবাহবিচ্ছেদ, একাকীত্ব ইত্যাদি থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। দীর্ঘমেয়াদী অসহনীয় ব্যাথা, দুরারোগ্য ক্যান্সার এর দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ চিকিৎসকদের কাছে মৃত্যু দাবী করে।
“অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়–
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত– ক্লান্ত করে;”
তাছাড়া, বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগ, যানবাহনজনিত দুর্ঘটনায় অনেকের মৃত্যু ঘটে। যুদ্ধ, দাঙ্গা – হাঙ্গামা, কলহ, কোন্দলজনিত খুনের ঘটনা ও বিরল নয়। এভাবে প্রতিনিয়ত সাধারণ মৃত্যু ছাড়া ও বিভিন্ন প্রকার অপমৃত্যু, অকালমৃত্যু মানুষের হয়ে থাকে। যার জন্য কেউ প্রস্তুত থাকে না, প্রস্তুত থাকা সম্ভব ও নয়। সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির আপনজন, শুভাকাঙ্ক্ষীদের তা মেনে নেয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে।
কিভাবে নেয়া যায় মৃত্যুর প্রস্ততিঃ যেহেতু আমরা জানি না- কার, কখন, কিভাবে মৃত্যু হবে, তাই প্রতি মুহুর্তেই আমাদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
- মৃত্যুর ঠিক আগমুহুর্তে আমরা সবাই চাই অন্যেরা ক্ষমা করে দিক, দাবী- দাওয়া না রাখুক। এই বিষয়টি যদি সবসময় মাথায় থাকে, তাহলে সর্বদাই একজন মানুষ তার ঘনিষ্ঠজন ও আশপাশের মানুষদের সাথে সদালাপী হবে, তাদের ভালো করার চেষ্টা করবে, অনিষ্ট করা থেকে বিরত থাকবে, তাদের হক আদায় করবে, কখনো তাদেরকে ঠকাবে না, যার যা ন্যায্য পাওনা তা প্রদান করবে।
- প্রতিটি মানুষ মৃত্যুর পর তার সন্তান- সন্ততি কেমন থাকবে তা নিয়ে অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত থাকে। তাই সন্তানদের স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে, সুশিক্ষিত করতে হবে, মানবিক গুণসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে। সন্তানদের নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক রাখতে এবং একতাবদ্ধ থাকতে শৈশব থেকেই শেখাতে হবে।
- যদি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, তাহলে পরকালে জান্নাতবাসী বা স্বর্গবাসী হতে হলে ধর্মীয় বিধি- বিধান মেনে চলতে হবে।
- মৃত্যুর পরও পৃথিবীতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতে চাইলে দেশ, জাতি,ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির বিভেদ ভুলে মানবতার সেবায়, বিশ্ব বাসীর সেবায় নিজকে নিয়োজিত করতে হবে। ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে বের হয়ে বৃহত্তর পরিসরে চিন্তা- ভাবনা করতে হবে।
- মানুষ ভুল করবেই। তাই প্রতিমহুর্তে সচেতন থাকতে হবে যেন ভুল না হয়, যদি ভুল হয়ে যায় তা সংশোধন করতে হবে। নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে, পাশাপাশি অন্যের ভুল হলে তা ক্ষমাশীল দৃষ্টিতে দেখতে হবে।
- শারীরিক ও মানসিক অসুস্হতায় সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে কাপুরুষের মতো জীবন থেকে বিদায় নেয়া দায়িত্বহীনতারই পরিচয় বহন করে মাত্র।
পরিশেষে বলতে হয়,মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা মানে এই নয়- জীবন থেকে, কাজ থেকে, দায়- দায়িত্ব থেকে গুটিয়ে নেয়া। বরং জীবনকে সঠিক ও সুন্দর ভাবে পরিচালনা করা,কাঙ্খিত পদ্ধতিতে বিভিন্নপ্রকার সমস্যার সমাধান করে, প্রতিকুলতার অবসান ঘটিয়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, মানবের কল্যাণে, বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করে যাওয়াতেই জীবনের স্বার্থকতা। আর জীবন যখন স্বার্থক বলে পরিগণিত হয়, তখন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা ও সহজ হয়। আর তখনই হয়তো বলা সম্ভব “মরণরে তুহুঁ মম শ্যাম সম”।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে