থাইরয়েড হরমোনের রোগ চেনা জটিল কিছু নয়, হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শে এর সুচিকিৎসা হয়

অধ্যাপক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন

২০০৮ সাল থেকে বিশ্ব থাইরয়েড দিবস পালিত হয়ে আসছে। ২০১৩ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ থাইরয়েড সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এই দিবসটি পালন করে আসছে। বর্তমানে বিভিন্ন সংগঠনও এই কর্মসূচি পালন করছে। এই ব্যাপারে অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল এন্ড্রোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ডায়াবেটোলজিস্ট অব বাংলাদেশ (এসিইডিবি) এর কর্মসূচি লক্ষণীয়। এসবের দ্বারা সাধারণ জনগণ বেশ উপকৃত হচ্ছেন। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ কোটি মানুষ থাইরয়েডের নানা সমস্যায় ভুগছেন। অথচ তাদের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ জানেন না যে, তারা এই সমস্যায় ভুগছেন। পুরুষদের তুলনায় নারীরা চার থেকে পাঁচগুণ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন এই রোগে।

থাইরয়েড হরমোনের প্রভাব
থাইরয়েড গ্রন্থিটি গলার সামনের দিকের উঁচু হাড়ের নিচে অবস্থিত। গ্রন্থিটি দেখতে প্রজাপতি সদৃশ এবং এটি ট্রাকিয়া বা শ্বাসনালিকে পেচিয়ে থাকে। যদিও থাইরয়েড একটি ছোট গ্রন্থি কিন্তু এর কার্যকারীতা ব্যাপক। থাইরয়েড গ্রন্থি কর্তৃক নিঃসৃত হরমোন মানব পরিপাক প্রক্রিয়ায় অন্যতম ভূমিকা পালন করে। ভ্রুন অবস্থা থেকে আমৃত্যু থাইরয়েড হরমোনের প্রয়োজন অপরিহার্য। এ হরমোনের তারতম্যের জন্য শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি, মোটা হওয়া, ক্ষয় হওয়া, মাসিকের বিভিন্ন সমস্যা, ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা, হার্টের সমস্যা এবং চোখ ভয়ঙ্করভাবে বড় হয়ে যেতে পারে। বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ হিসেবে থাইরয়েড হরমোনের তারতম্যকে দায়ী করা হয়। শারীরিক কার্যক্ষমতা সঠিক রাখার জন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় এ হরমোন শরীরে থাকা একান্ত জরুরী।

দরকার সুস্থ মা
সুস্থ নবজাতকের জন্য সুস্থ মা একান্ত প্রয়োজন। মায়ের থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা থাকলে এর প্রভাব নবজাতকের ওপর পড়ে। নবজাতকের থাইরয়েড হরমোনের অভাব শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়। ফলশ্রুতিতে শিশু প্রতিবন্ধিতে পরিণত হতে পারে। শিশুকে এ প্রতিবন্ধিতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিটি নবজাতকের জন্মের সাথে সাথে থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা করা একান্ত জরুরী।

হরমোন নরমাল থেকেও থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে। সাধারণত আয়োডিনের অভাবে গলাফুলা রোগ হয়ে থাকে, যাকে সাধারণ ভাষায় ‘ঘ্যাগ’ রোগ বলা হয়। বাংলাদেশে যদিও আয়োডিনযুক্ত লবন খাওয়া হচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের উদ্যোগে পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের বেশিরভাগ স্কুলগামী শিশু এবং গর্ভবতী মায়েদের আয়োডিনের অভাব রয়েছে। আয়োডিন শরীরে অতি প্রয়োজনীয় থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। থাইরয়েড হরমোন স্বাভাবিকভাবে তৈরিতে সুষম খাদ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ সেলেনিয়াম এবং আয়রন প্রয়োজন।

চিকিৎসা
দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশে থাইরয়েডের চিকিৎসা হয়ে আসছে। বিগত ৩০ বছর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের থাইরয়েড ক্লিনিকের মাধ্যমে এ দেশের হাজার হাজার মানুষ থাইরয়েডের সুচিকিৎসা পেয়ে আসছেন। এটা দেশের একমাত্র সমম্বিত থাইরয়েড ক্লিনিক যা নিউক্লিয়ার মেডিসিন এবং সার্জারি বিভাগের মাধ্যমে অত্যন্ত সুনামের সাথে এ দেশের মানুষকে সেবা দিয়ে আসছে। থাইরয়েড হরমোনের সব ধরণের চিকিৎসা এ দেশে হয়। এজন্য বলা হয়, থাইরয়েড হরমোনের রোগ চেনা জটিল কিছু নয়, হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শে এর সুচিকিৎসা হয়। এজন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

দরকার সচেতনতা
থায়রয়েড হরমোনজনিত রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘদিন থেকে রেডিও, টিভি, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, অনলাইন, বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনা প্রভৃতির মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সচেতনতা একান্ত প্রয়োজন। ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে।

আশার কথা, বাংলাদেশ সরকার পুরনো ৮টি মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে নতুন করে আরো ৬টি মেডিক্যাল কলেজে এন্ডোক্রাইনোলজি বা হরমোন বিভাগ খোলার মাধ্যমে হরমোনজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে সরকারী পর্যায়ে প্রায় একশত হরমোন বিশেষজ্ঞ কাজ করে যাচ্ছেন। এই বিপুল বিশেষজ্ঞদেরকে পদায়নের মাধ্যমে এনসিডি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজে লাগানো সম্ভব। এনসিডি’র মাধ্যমে থাইরয়েড হরমোনজনিত রোগের ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বেসরকারী পর্যায়ে ২০০ এর বেশি হরমোন বিশেষজ্ঞ কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের অনেক বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ এবং সব পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র থাইরয়েড রোগীদের সেবা দিয়ে আসছে।

বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক থাইরয়েড রোগীদের ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। আসুন, আমরা সবাই থাইরয়েড রোগ সম্পর্কে জানি এবং এর প্রতিকার ও প্রতিরোধে এগিয়ে আসি।

লেখক : অধ্যাপক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন,

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)।
প্রেসিডেন্ট, অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল এন্ড্রোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ডায়াবেটোলজিস্ট অব বাংলাদেশ (এসিইডিবি)

Previous articleআমি বাইপোলার ডিসঅর্ডারের একজন রোগী
Next articleধোবাউড়া উপজেলায় মানসিক অসুস্থতা নিরূপণ ক্যাম্প

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here