রান্না মন ভালো রাখতে সাহায্য করে: উম্মাহ মোস্তফা

0
357
উম্মাহ মোস্তফা
ছিলেন ভীষণ মেধাবী শিক্ষার্থী। লেখাপড়া করেছেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। পেশাগত জীবনেও ছিলেন প্রচন্ড সফল একজন মানুষ। সাথে ছিল অসাধারণ রান্নার হাত। তাঁর রান্নার স্বাদে মুগ্ধ পরিবার, বন্ধু, স্বজন সকলে। একসময় নিজের রান্নার গুণটি তিনি অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে শুরু করলেন। তাঁর কাছে রান্না শিখে অনেকেই এখন পরিবারে, পেশাগত জীবনে প্রশংসনীয় রাধুনী। আর রান্নার প্রশিক্ষক হিসেবে দেশ বিদেশে তিনিও ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছেন তুমুল জনপ্রিয়। যিনি স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশি খাবারের বিশ্ব পরিচিতি। তিনি উম্মাহ মোস্তফা। মনের খবর এর তারকার মন বিভাগে কথা বলেছেন উম্মাহ’স কিচেন এর এই স্বপ্নদ্রষ্টা । পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল সেই আলাপচারিতা:

মনের খবর: কেমন আছেন?
উম্মাহ মোস্তফা: ভালো আছি।

ভালো থাকার আলাদা কোনো রেসিপি আছে?
উম্মাহ মোস্তফা: ভালো থাকাটা আসলে একেক বয়সে একেক রকম। আর এখন আসলে পুরো পৃথিবী জুড়ে করোনার থাবায় মানুষের ভালো থাকার ধরণ বদলে গেছে। তবে এই বয়সে এসে আমার ভালো থাকার প্রধান উপাদান আমার পরিবার, আমার মেয়েরা। আমার মেয়েরা যদি ভালো থাকে তাহলে আমি এমনিতেই ভালো থাকি, মেয়েরা যদি খারাপ থাকে আমিও খারাপ থাকি।

রাগ ক্ষোভ হিংসা ব্যাপারগুলি আপনার মধ্যে কেমন?
উম্মাহ মোস্তফা: আমার হিংসা নেই। আমি সবসময় মনে করি যে, হিংসা করে তো আমি তার মত হতে পারবো না। তাই হিংসা ব্যাপারটিকে আমার অযৌক্তিক মনে হয়। তবে আমার মধ্যে রাগ আছে। আমার রাগ অনেকটা ঠান্ডা টাইপের, আমি রাগ হলে উচ্চবাচ্য করি না। কারো উপর রাগ হলে আমি তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিই। তবে কথা বলা বন্ধ করার আগে তাকে আমি জানােই যে তার উপরে আমি কেন রাগ হয়েছি, এবং জানিয়ে কথা বলা বন্ধ করি। তবে স্টুডেন্ট লাইফে রাগটা অন্যরকম ছিল। যখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তাম, তখন রাগ হলে খুব হাউকাউ করতাম। বয়সের সাথে সাথে রাগের প্রতিক্রিয়ার ধরণও বদলে গেছে।

মনের খবর: মন খারাপ হলে ভালো করার জন্য কি করেন?
উম্মাহ মোস্তফা: এটা র্নিভর করে কারণের উপর। কারণটা পারিবারিক হলে একরমম আর অফিসিয়াল কাজের জন্য হলে আরেকরকম। অফিসিয়াল কোনো কাজের জন্য মন খারাপ হলে সেটার কারণটা খুঁজে বের করে সমাধানের চেষ্টা করি। আর পারিবারিক কারণে হলে সেটা যে সদস্যের কারণে হলো তার সাথে আলোচনা করার চেষ্টা করি। আমার কাছে যেকোন সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনাকে সবচেয়ে কার্যকর উপায় মনে হয়।

মনের খবর: স্মৃতিকাতরতায় ভোগেন?
উম্মাহ মোস্তফা:প্রচন্ড পরিমাণে স্মৃতিকাতর আমি। খুব সুক্ষ্ম অনুভূতির মানুষ আমি। এবং আমার স্মৃতিশক্তিও বেশ প্রখর। দিনের বিভিন্ন সময়ে আমি বাতাসরে কিছু গন্ধ পাই, বা রোদ দেখে আমি অতীতের এমন রোদেলা বা বাতাসারে দিনগুলির স্মৃতি রোমন্থন করি।

মনের খবর: কখনও কি  নিজেকে মানসিকভাবে অসুস্থ মনে হয়েছে?
আমার ৩ টা মেয়ে। ৩টা মেয়ের জন্মের সময়ই আমি প্রসবকালীন মানসিক চাপে ভুগেছি। এছাড়া প্রেগন্যান্ট খাকা অবস্থায় পেশাগত জীবনেও আমাকে বিভিন্ন কটুক্তি শুনতে হয়েছে যা আমাকে অনেকটাই মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলেছে। তাই আমার কাছে প্রেগন্যান্ট কেউ রান্না শিখতে আসলে আমি তাদের দিকে একটু বেশি যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করি।

মনের খবর: অবসর সময়ে রান্না ছাড়া আর কি করেন?
উম্মাহ মোস্তফা: লেখালেখি করতে ভালোবাসি, বই পড়তে ভালোবাসি। ইদানিং ব্লগিং করছি খুব। অবসর সময় লেখালেখি আর বই পড়েই কাটে।

মনের খবর: রান্না মানুষের মনের উপর কতটা প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন?
উম্মাহ মোস্তফা: রান্নাটা শুধু রান্না নয়, রান্না ভালোবাসারও প্রতীক। কেউ যখন কোনো রান্না করে সেটা খেয়ে যদি কেউ প্রশংসা করে তখন যিনি রান্না করেন তার মনের মধ্যে একটা প্রশান্তি কাজ করে। এই প্রশান্তি নিঃসন্দেহে তার মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। অনেক সময় আমাদের বিষণ্ণ লাগলে বা মন খারাপ থাকলে কিছু একটা করতে ইচ্ছে করে। এই কিছু একটা করার জন্য রান্না বেশ কার্যকর একটা উপায়। আর সেই রান্না করার পর যদি প্রশংসা পাওয়া যায় তবে সেটা মন ভালো করে দিতে টনিকের মত কাজ করে।

মনের খবর: রান্নার ক্ষেত্রে মনসংযোগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
উম্মাহ মোস্তফা: এটা আসলে ব্যক্তি বিশেষ এর উপর নির্ভর করে। এর আগে যে বললাম রান্না করলে মন ভালো থাকে, আমি নিজের ক্ষেত্রে দেখেছি যে মন খারাপ থাকলে আমি যে রান্নাটা করতে চাচ্ছি সেটা ঠিকমত হচ্ছে না।

মনের খবর: আপনার রান্না শুরুর এবং রান্নাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার গল্পটা যদি একটু বলতেন?
উম্মাহ মোস্তফা: রান্নার শুরু তো আসলে ছোটবেলা থেকেই। মায়ের কাছে। ছোটবেলা থেকে রান্না করতে ভালো লাগতো। আর আমাদের দেশে সাধারণত যেটা হয় যে নারী মানেই রান্না করবে, বাবা মায়েদের মধ্যে এরকম একটা সামাজিক চাপ থাকে। আমার মাও আমাকে বলতেন যে, “তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড় যাই করো সাথে তোমাকে রান্নাটাও খুব ভালো করে রপ্ত করতে হবে যাতে কেউ বলতে না পারে তুমি রান্না পারো না। তুমি খুব ভালো রান্না করো, তবে তোমাকে আরও ভালো করতে হবে।” এরপর আমি যখন ডেনমার্ক এস্বাসীতে জব করতাম তখন আমার রির্পোটিং বস আমার রান্নার খুব প্রশংসা করতেন এবং তিনিই আমাকে উৎসাহিত করতেন অন্যদেরকে রান্না শেখানোর। তখন বিষয়টিকে অতটা গুরুত্ব দিইনি। এরপর তিনি আমাকে একজন হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিকে রান্না শেখানোর দায়িত্ব দেন। তারপর থেকে কিভাবে যেন কি হয়ে গেলো: আমি আমার শখের রান্না অন্যদেরকে শেখাতে শুরু করলাম। তারপর শখটাই কখন যেন পেশা হয়ে গেলো। ২০১১ থেকে এখন পর্যন্ত এটা নিয়ে ভালোই আছি। এনজয় করছি খুব।

মনের খবর: শিশুদের মস্তিস্কের গঠনের জন্য কি ধরনের খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলারে পরামর্শ দিবেন?
উম্মাহ মোস্তফা: আমাদের দেশে আসলে শিশুদের ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার ক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের মধ্য উদাসীনতা দেখা যায়। আমাদের দেশে শিশুদেরকে ফ্রোজেন খাবার খাওয়ানো হয়, মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ানো হয়। এ ব্যাপারে বাবা-মায়েদের সচেতন হতে হবে। এসব খাবার পরিমিত পরিমাণে খাওয়াতে হবে। মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি খেলে শিশুরা হাইপার এক্টিভ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া কোমল পানীয় পুরোপুরি পরিহার করতে হবে। আর কি খাওয়াতে সে বিষয়ে আমি বলবো-যেকোনো খাবারই একটু আকর্ষণীয় করে পরিবেশন করলে শিশুরা সেটা খাবে। শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য শাকসবজি খাওয়াতে হবে। তবে শাকসবজির ক্ষেত্রেও মিষ্টি এবং কার্বোহাইড্রেড যুক্ত সবজি পরিহার করে ফাইবার যুক্ত সবজি বেশি খাওয়াতে হবে। দুধ যেকোনো বয়সীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে নারীদের জন্য। শিশুদেরকে নিয়মিত দুধ খাওয়ানোর অভ্যাস করাতে হবে, সাথে কাজু বাদাম সহ বিভিন্ন ধরনের বাদাম খাওয়াতে হবে। এতে করে শিশুদের স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের গঠন ভালো থাকবে।

মনের খবর: আমাদের মানুষের এই যে ধারণা-নারী মানেই রান্না করা বাধ্যতামুলক। এটা কি শুধু বাধ্যতামূলক নাকি রান্নাটা একটা শিল্পও?
উম্মাহ মোস্তফা: প্রথমত, আমার কাছে অনেক পুরুষরাও রান্না শিখতে আসেন। এটা আমার কাছে খুব ভালো লাগে যে আমাদের দেশের মানুষের ধ্যান ধারণা বদলাচ্ছে। পুরোপুরি বদলাতে হয়তো আরো অনেক সময় লাগবে, তবে একটা সময় বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করবে যে রান্নাটা শুধু নারীর কাজ নয়। দ্বিতীয়ত, রান্নাটাকে আমি শুধু শিল্প বলবো না। রান্না একটা বিজ্ঞানও। রসায়ন ল্যাবে যেরকম সবকিছুর একটা নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহারে পরীক্ষা করা হয়, রান্নাটাও ঠিক তেমনই।

মনের খবর: রান্নাকে যারা পেশা হিসেবে নিতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
উম্মাহ মোস্তফা: পেশা হিসেবে রান্না খুবই সম্ভাবনাময়। আমাদের দেশে এখন প্রচুর রেস্টুরেন্ট। সেসব জায়গায় শেফ হিসেবে কাজ করার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। এই পেশায় এখন প্রতিযোগিতা খুব কম। তাই কাজ শিখে পেশায় যোগ দেওয়া অনেক সুযোগ রয়েছে। তাই যারা রান্নাকে পেশা হিসেবে নিতে চায় তাদেরকে আমি বলবো এই পেশায় আসতে হলে অবশ্যই শিখে আসতে হবে। আর রান্নার তো আসলে অনেক সেক্টর, তাই কে কোন সেক্টর নিয়ে কাজ করতে চায় সেটা নির্দিষ্ট করাটাও জরুরী। একজন সবকিছু রান্না করতে গেলে আসলে হবে না।

মনের খবর: রান্না নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
উম্মাহ মোস্তফা: বালাদেশের খাবারের যে একটা স্বত্রন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে এটা আমি সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চাই। বাংলাদেশের খাবারকে সারাবিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলতে চাই। এছাড়া আমার আরেকটা ইচ্ছে আছে; আমি ইতোমধ্যে লন্ডন, নেপাল এবং দুবাইয়ে রান্নার ক্লাশ নিয়েছি। আমি চাই বিশ্বের প্রতিটি দেশে উম্মাহ‘স কিচেন নিয়ে রান্নার ক্লাশ করাতে।

মনের খবর: সময় দেওয়ার জন্য মনের খবর এর পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
উম্মাহ মোস্তফা: মনের খবরকেও ধন্যবাদ।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleমহামারি ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত
Next articleসুস্থ মন, সুস্থ জীবন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here