করোনা পরিস্থিতি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পুরো পৃথিবী একটি ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন স্থানে লকডাউন অবস্থা জারি রয়েছে। অধিকাংশ মানুষই এই লকডাউন অবস্থার সাথে পূর্বপরিচিত নয়। তারা এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছে না। তাই অনেকেই নিজেকে বন্দী মনে করছে বা বর্তমান পরিস্থিতিকে জেলখানার সাথে তুলনা করছে। কিন্তু এই বিষয়কে এভাবে চিন্তা না করে এর ভালো দিকগুলো চিন্তা করতে হবে।
করোনা নিয়ে মানুষ ভীত, সন্ত্রস্ত। নিজেরা যেমন ভয় পাচ্ছে, তেমনি নিজের ভয় জেনে, বুঝে বা না বুঝে অন্যের মধ্যে সঞ্চার করছে। বিভিন্ন মিডিয়াতে করোনা নিয়ে সবসময়ই সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। বিভিন্নজনের ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রকাশিত হচ্ছে। সব ধরণের প্রচারের মূল উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে ঘরে থাকতে উৎসাহিত করা। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়ার জন্য দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এই বিষয়টিকে নেতিবাচক ভাবে না নিয়ে, নিজেকে বন্দী বা আবদ্ধ না মনে করে ইতিবাচকভাবে চিন্তা করতে হবে। যারা কাজ নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকতেন, পরিবারকে সময় দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ব্যস্ততার কারণে তা সম্ভব হতো না, তাদের জন্য এই সময়টুকু অনেক সুখানুভূতির হতে পারে। সাধারণত পরিবারের সব সদস্যই নিজেদের মত ব্যস্ত থাকে। যেমন: কর্মজীবী মা-বাবা কাজের জন্য বাচ্চাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না। বাচ্চা নিজেও পড়া-শোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অনেকেই অসুস্থতার মধ্যে কাজ করেন। প্রয়োজনমত বিশ্রাম নিতে পারেন না। তাই, এসময়টুকু সবার জন্যেই আনন্দের ও বিশ্রামের সময় হতে পারে। যে কথাগুলো আগে সময়ের অভাবে বলা হতো না, সে কথাগুলো সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলা যেতে পারে। পরিবারের সবাই পাশাপাশি থেকে শারীরিক ও মানসিক বন্ধন আরো দৃঢ় করতে পারেন। যারা কাজের চাপের জন্য পরিবারকে সময় দিতে পারছিলেন না বলে ভূল বোঝা-বুঝির সৃষ্টি হয়েছিল, তারা এসময়কে কাজে লাগিয়ে পরিবারের পাশে থাকতে পারেন। পরিবারের সবাই সবার সাথে ভালো সময় কাটাতে পারেন।
এসময়টুকু সবার জন্য স্বস্তির, শান্তির এবং সুখের সময় হতে পারে। পরিবারের কর্তাব্যক্তি, যিনি কাজের জন্য সকালে বের হয়ে যেতেন এবং রাতে ফিরতেন, তিনি হয়তো বাসায় থাকা তাঁর স্ত্রী কিভাবে সব কাজ করছেন বা বাচ্চারা পড়া-শোনা নিয়ে কিভাবে ব্যস্ত থাকছে সে বিষয়গুলো জানতে পারতেন না বা উপলব্ধি করতে পারতেন না। এসময় ঘরে থাকার ফলে তিনি এ বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারবেন। যারা কর্মজীবী মহিলা আছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই প্রেগন্যান্ট, অনেকের অনেক ধরণের রোগ যেমন: ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হার্টের সমস্যা ইত্যাদি থাকতে পারে। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরণের রোগ থাকে। অনেকের মানসিক রোগ থাকে বা স্ট্রেস সংক্রান্ত সমস্যা থোকে। আতঙ্কিত হওয়ার ফলে মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই আতঙ্কিত না হয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আতঙ্কিত হলে মানসিক চাপ সৃষ্টি হবে এবং মানসিক চাপ থেকে মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। এর ফলে স্ট্রেস সংক্রান্ত ডিসঅর্ডার, অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, প্যানিক অ্যাটাক বা ডিসঅর্ডার হতে পারে। বার বার হাত ধোয়ার বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বা ভ্রান্ত ধারণা কাজ করতে পারে। যার কারণে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার হতে পারে। সোশ্যাল ফোবিয়া, মুড ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেশন এমনকি সাইকোটিক ডিসঅর্ডারেও আক্রান্ত হতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হওয়ার ফলে পরবর্তীতে পোষ্ট ট্রমাটিক ডিসঅর্ডার ও হতে পারে। ঘরে থেকে আতঙ্কিত না হয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার যে নিয়মগুলো রয়েছে সেগুলো মেনে চলতে হবে এবং দৈনন্দিন স্বাভাবিক যে কাজ-কর্ম রয়েছে সেগুলো করতে হবে। শুধুমাত্র বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এবং বাইরে থেকে এসে যে বিশেষ সতর্কতাগুলো আছে সেগুলো মানতে হবে। যে কোন ধরণের মানসিক চাপ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে যেকোন সাধারণ রোগে আক্রান্ত হলেও তার ভয়াবহতা অনেক বেশি হয়। মনোবল সঠিক থাকলে যে কোন রোগকে মোকাবেলা করা সহজ, এই বিশ্বাস মনের মধ্যে থাকতে হবে। ঘরে থেকে অনিয়ম না করে সব কাজ সঠিক সময়ে করে ফেলতে হবে। বাচ্চাদের সবসময় পড়তে বসিয়ে রাখা যাবে না এবং নিজেদেরও অফিসের বা অন্যান্য কাজ নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকা যাবে না। বাচ্চার পড়া একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করাতে হবে। সময়কে ভালোভাবে কাটানোর জন্য সবার সাথে গল্প করা, বিভিন্ন ধরণের ঘরোয়া খেলার আয়োজন করা যেতে পারে। তবে কোন ধরনের ডিভাইসে আসক্ত হওয়া যাবে না। প্রতিটা মূহুর্তকে আনন্দের করে তুলতে হবে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বা কথা কাটা-কাটি যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহমর্মিতা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি করতে এ সময়কে কাজে লাগানো যেতে পারে।
যারা অসুস্থ তাদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে অনলাইনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। যেকোন জরুরী পরিস্থিতিতে সেবা দিতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সবসময়ই পাশে আছেন। সময়মত খাবার খেতে হবে এবং খাদ্যতালিকায় সুষম খাবার রাখতে হবে। বিশেষ করে যেসব খাবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার ও ফল-মূল খেতে হবে। নিয়মিত বিশ্রাম ও পর্যাপ্ত ঘুমের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সুস্বাস্থ্যের যে নিয়ম-নীতি আছে সেগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে। অনলাইনে বিভিন্ন পোগ্রাম করা বা নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরণের প্রোগ্রাম দেখেও সময় কাটানো যেতে পারে। আত্বীয়-স্বজনের সাথে ফোনে কথা বলে তাদের খোঁজ নেওয়া, তাদেরকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়া যেতে পারে। নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়া আতঙ্ক ছড়ায় এমন কোন নিউজ দেখা যাবে না। সু্স্থ থাকার জন্য বিভিন্ন ধরণের ব্যায়াম, ইয়োগা ও রিলাক্সেশন করা যেতে পারে। যার যার অবস্থান থেকে ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে চলতে হবে। একা কোন সমস্যার সমাধান করা যায় না কিন্ত সবাই মিলে পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করে যেকোন সংকটময় অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারা যায়। মনে সাহস ও আস্থা রাখতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে, এ পরিস্থিতি সাময়িক সময়ের জন্যে। তাই নিজেকে ভালো থাকতে হবে এবং অন্যকেও ভালো রাখতে হবে।
যেহেতু বেশিরভাগ গৃহ সহকারীরা ছুটিতে আর সবারই বাসায় অনেকক্ষন থাকা হবে তাই বাসার কাজগুলো সবাই আন্তরিকতার সাথে ভাগ করে নিতে পারি । তাহলে দায়িত্ব বোধ বাড়বে সে সাথে আন্তরিকতা।
একসাথে থাকাটা যেন আমাদের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন, আস্থা, বিশ্বাস তৈরী করে এবং কমায় দূরত্ব এবং দ্বন্দ্ব । বাড়ায় যেন ভালো থাকার প্রয়াস। এই যেন হয় আমাদের শক্তি। এতে করে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা বা রোগের উন্নতি হবে। ভূল বাঝাবুঝি , দূরত্ব,অবহেলা জনিত সমস্যা এবং রোগের নিরসন ও প্রকোপ কমবে
করোনা পরিস্থিতিতিতে লেখকরে অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন:
করোনা: শিশুকে মানসিকভাবে সবল রাখতে যা করবেন
করোনা ভাইরাস ও গর্ভবতীর মানসিক স্বাস্থ্য
করোনায় মানুষ কেন বাইরে বের হচ্ছে?