বয়ঃসন্ধিক্ষণ বা তরুণ বয়সে মানুষের মনে সাধারণত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা, উচ্চাকাক্সক্ষাসহ নানা ধরনের মানসিক পরিবর্তন তৈরি হয়। আমাদের দেশের পরিবারই তরুণদের এ ধরনের মানসিক পরিবর্তন ভাল চোখে দেখে না বা গ্রহণ করতে পারে না। ফলে জটিলতা আরও বেড়ে যেতে পারে।
যতই দিন যাচ্ছে, মানুষের মধ্যে কাউন্সিলিং নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। প্রতিদিন কেউ না কেউ এ ব্যাপারে জানতে চাচ্ছেন, ইমেইল করছেন। কোথায় কাউন্সিলিং পাব? কে কাউন্সিলিং করান? আসুন জেনে নেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র্রের খোঁজ-খবর।
কাউন্সিলিং কী?
খুব সাধারণভাবে দেখলে দু’জন ব্যক্তির মধ্যে কথোপকথন। একজন বলছেন, অন্যজন শুনছেন। যে বলছেন সে তাঁর সমস্যার কথা, জীবনের কথা, সম্ভাবনার কথা বলছেন। অন্যজন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে কোন প্রকার পূর্ব বিচার-বিশ্লেষণ না করে তাঁর কথা শুনছেন। আবার মাঝে মাঝে, প্রশ্ন করছেন যেন বিষয়টা পরিষ্কার হয়। এই কথোপকথনের মাধ্যমে অন্য ব্যক্তি, যিনি কিনা কাউন্সিলিং সাইকোলজিস্ট বা কাউন্সিলর হিসেবে পরিচিত, চিহ্নিত করছেন সমস্যার ধরন, উৎপত্তি, কারণ। এরপর দু’জনে একসঙ্গে মিলেই ঠিক করেন কিভাবে সেই অবস্থা থেকে বের হওয়া যায়। পরিশেষে সে অনুসারে উদ্যোগ নেন। আর এই পুরো প্রক্রিয়া একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মাধ্যমে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করেই সম্পাদন করা হয়। একজন কাউন্সিলর জীবন সম্পর্কিত নানারকম বৈজ্ঞানিক তত্ত্বীয় জ্ঞানের পাশাপাশি পেশাগত নিবিড় প্রশিক্ষণ আর অভিজ্ঞতার আলোকে তার সেবা দিয়ে থাকেন। যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত একজন কাউন্সিলর আয়নার মতো কাজ করবে, যেখানে আপনি দেখবেন আপনার ব্যক্তিত্ব, কলহ, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা।
কোথায় পাবেন
ছাত্রছাত্রী ও তরুণদের জন্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আছে বিনামূল্যে কাউন্সিলিং নেয়ার সুবিধা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শ দফতরে (টিএসসির ২য় তলা) প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য বিনামূল্যে কাউন্সিলিং সেবার ব্যবস্থা আছে। যে কোন কর্মদিবসে সরাসরি সেখানে গিয়ে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়ার জন্য আবেদন করতে হবে। কাউন্সিলিং ছাড়াও ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন মনোসামাজিক প্রশিক্ষণ যেমন ‘রাগ ব্যবস্থাপনা’ ‘উদ্বেগ ব্যবস্থাপনা’ ‘সামাজিক দক্ষতা’ ইত্যাদির আয়োজন করা হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দোতলায় কাউন্সিলিং করার ব্যবস্থা রয়েছে। জাবির শিক্ষার্থীরা যে কোন কর্মদিবসে চলে আসুন সেবা গ্রহণ করার জন্য।
ঢাকা কলেজ : ঢাকা কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগ দ্বারা পরিচালিত কাউন্সিলিং এ্যান্ড গাইডেন্স সেন্টারে প্রতি সোম ও মঙ্গলবার (১২.০০-২.০০টা পর্যন্ত) কলেজের ছাত্র ও স্টাফদের জন্য বিনামূল্যে কাউন্সিলিং সেবার ব্যবস্থা রয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাইকিয়েট্রি বিভাগে শনি থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কাউন্সিলিং ও সাইকোথেরাপি করা হয়। এর জন্য বহির্বিভাগে ১০ টাকা দিয়ে একটা টিকিট কাটতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (শাহবাগ, ঢাকা) এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে (কলেজগেট, ঢাকা) শনি থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ১০ টাকা টিকিট কেটে এই সেবা গ্রহণ করা যাবে।
বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় : বেসরকারী অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য কাউন্সিলিং, মনোসামাজিক প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। ব্র্যাক, নর্থসাউথ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (চট্টগ্রাম), ইস্টার্ন, গ্রীন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কাউন্সিলিং ইউনিট আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কাউন্সিলিং সেবার জন্য সংশ্লিষ্ট অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, উইলস লিটিল ফ্লাওয়ার স্কুল, স্কলাস্টিকা, আগা খান স্কুল, প্রয়াস (ক্যান্টনমেন্ট) বিশেষায়িত স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠান : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রে বিনামূল্যে কাউন্সিলিং সেবা দেয়া হয়। যে কোন কর্মদিবসে অফিস চলাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানের অফিসে (৭/১৭, ব্লক-বি, লালমাটিয়া, ঢাকা-১২০৭) গিয়ে আবেদন করতে হবে।
এছাড়াও জাতীয় ট্রমা কাউন্সিলিং সেন্টারেও (মহিলা বিষয়ক অধিদফতর ভবন, ৩৭/৩, ইস্কাটন গার্ডেন রোড, ঢাকা ১০০০) নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হয়।
ফি দিয়ে সেবা গ্রহণ : আপনি যদি ফি দিয়ে কাউন্সিলিং সেবা পেতে চান তাহলে যোগাযোগ করতে পারেন ঢাকা এডুকেশনাল এ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগে (৫ম তলা, কলা ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। এখানে শিশু কিশোর ও বয়স্কদের জন্য কাউন্সিলিংসহ বিভিন্ন এ্যাসেসমেন্ট করা হয়।
শিশুদের জন্য প্রতি সেশন ফি (প্রায় ১ ঘণ্টা) ৪০০ টাকা এবং বয়স্কদের জন্য ৬০০ টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ৪০০ টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ পরিচালিত নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট (৪র্থ তলা, কলা ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)-এ পাবেন কাউন্সিলিং ও সাইকোথেরাপি। সেশন ফি ৩০০ টাকা, গ্রুপ সেশন ১৫০ টাকা।
সরাসরি কাউন্সিলিং না নিয়ে শুধু নিজের অব্যক্ত কথাগুলো কাউকে বলতে চান, যে মনোযোগ দিয়ে আপনার কথা শুনবে, আপনার মতো বোঝার চেষ্টা করবে, আপনাকে মানসিক সহায়তা দিবে, তাহলে ফোন করতে পারেন ‘কান পেতে রই’-এর ভলান্টিয়ারদের। রবিবার থেকে বুধবার দুপুর ৩টা থেকে রাত ৯টা এবং বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টা থেকে ভোর ৩টা পর্যন্ত এই নম্বরগুলোতে যোগাযোগ করতে পারেন- ০১৭৭৯৫৫৪৩৯১, ০১৭৭৯৫৫৪৩৯২, ০১৬৮৮৭০৯৯৬৫, ০১৬৮৮৭০৯৯৬৬, ০১৯৮৫২৭৫২৮৬, ০১৮৫২০৩৫৬৩৪।
এর বাইরে, অনেক কাউন্সিলিং সাইকোলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে থাকেন যেখানে আপনাকে ৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত সেশন ফি দিতে হতে পারে।
লেখক : আজহারুল ইসলাম, প্রভাষক, এডুকেশনাল এ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।