শিক্ষক, শিক্ষার্থীর মানসিক বিশ্ব, সেখানে শিক্ষকের কাজ, তার বোধ এবং সমাজ রাষ্ট্রের করণীয় জানাচ্ছেন আইইআর (ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ)’র সাবেক পরিচালক ও অধ্যাপক ড. আবদুল মালেক। তার মুখোমুখি হয়েছেন ওমর শাহেদ
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মানসিক পৃথিবীটি কেমন হবে?
প্রথমত শিক্ষক যারা আছেন বা হবেন-তাদের শিক্ষকতাকে পছন্দ করে এই পেশায় আসতে হবে। তাহলে শিক্ষকতা কি? ফরমাল বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার কথাই আমি বলি-এখানে শিক্ষকতার সঙ্গে শিখন-শেখানোর সম্পর্ক আছে। শিক্ষাথীরা শিখবে। তাদের শেখার সুযোগও শিক্ষককে সৃষ্টি করতে হবে। এটি আরোপিত হবে না। কেননা, শেখার জন্য স্বাভাবিক ও আনন্দদায়ক পরিবেশ প্রয়োজন। তাতে ভৌত ও প্রাকৃতিক উপকরণ (সেটিং বা বিন্যাস) থাকতে হবে। এও আমি বলতে চাচ্ছি-শুধুমাত্র দালানকোঠা, চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ ও প্রযুক্তিগত উপকরণগুলোই যথেষ্ট নয়; তাদের সঙ্গে প্রাকৃতিক বিন্যাস ও প্রাকৃতিক পরিবেশটিও থাকতে হবে, থাকা প্রয়োজন। প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই সঙ্গে আঙিনা থাকা খুব দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য কী হবে?
শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের সঙ্গে, সঙ্গে বিধিবদ্ধ (সিলেবাস, পাঠ্যপুস্তক) জ্ঞান অর্জন করানোই শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া ঠিক নয়। তাদের স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক, মানসিক বিকাশ (মানুষ প্রকৃতির অংশ, প্রাকৃতিক দেহের বিকাশ হলো মানুষ) থাকার স্বাভাবিক ব্যবস্থা থাকা তাতে হতে হবে। চাপিয়ে দিলে এটি তৈরি হয় না। এজন্য খোলামেলা, প্রকৃতি পরিবেষ্টিত হতে হবে শিশু বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের শহর ও গ্রামে এই সংকট আছে। শহরে এই সংকট প্রকট।
শিক্ষক কীভাবে কাজ করবেন?
শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানো প্রণালীর প্রধান ও অপরিহায উপাদান। শিখন প্রণালীটি স্বাভাবিক ও সুস্থভাবে পরিচালনা করাই তার প্রধান কাজ। ফলে অবশ্যই তাকে শিক্ষাথীবান্ধব হতে হবে। শেখানোর কাজটি তার আরোপিত হলে হবে না। তাতে সফলতা আসবে না। কাজটি হলো-শিক্ষক শিক্ষার্থীর আগ্রহ সৃষ্টি করবেন ও শিখন বিষয়গুলো অনুযায়ী তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করবেন। প্রকৃত অর্থে তাকে হতে হবে শেখার সুযোগ সৃষ্টিকারী। ইংরেজিতে তাকে ফ্যাসিলিটেটর বলা হয়। এই প্রণালীতে শিক্ষক সবসময় তাদের কাছের মানুষ হবেন। তাদের বন্ধু, পথপ্রদর্শক ও আদর্শ হবেন। শিখনের ক্ষেত্রে, শিখন প্রণালীতে শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপে বা ভয়ে থাকবে না। এক্ষত্রে তাদের ব্যক্তি ও সামষ্টিক মনস্তত্ব শিক্ষকের জানা থাকতে হবে ও উপলব্ধি করতে হবে। সেটি বিবেচনায় রেখে শেখানোর কার্যাবলী তাদের পরিচালনা করতে হবে। এটি বিষয়বস্তুভিত্তিক হবে। যখন যে পদ্ধতি, কৌশল প্রয়োজন তার ভিত্তিতে প্রেরণা, প্রেষণা, উৎসাহদান, সহায়তা প্রদান ইত্যাদি ভিত্তিক শিখন প্রণালী গড়ে তুলতে হবে তাদের। সেটি গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব শিক্ষকের। প্রতিটি শিশু বা শিক্ষাথীর জীবন ও মনে মা, বাবা যেমন সবসময় নির্ভরযোগ্য, তার পরম মমতা ও স্নেহের উৎস; তেমনি শিক্ষককেও সেই অবস্থায় নিজেকে নিয়ে যেতে হবে। তিনি তেমন হবেন। তার কাছ থেকে সমান মমতা, উৎসাহ, স্নেহ পাবে সে ও তারা। যে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের যত কাছাকাছি যেতে পারবেন, তার সফলতা তত বেশি হবে এবং সমাজে তিনি তত বেশি অবদান রাখতে পারবেন।
শিক্ষক হিসেবে আপনার খ্যাতির রহস্য কী?
আমি খ্যাতিমান কী না জানি না-আমার ছাত্রছাত্রী ও সহকমীরা বলবেন। তবে আমি স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ভালোভাবে নেই। শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগ ধরে রাখি। শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হলো শিক্ষার্থীরা, এই বোধটি ধারণ করি আমি সবসময়। একজন শিক্ষক যদি কর্তব্যনিষ্ঠ হন, শিক্ষার্থীদের শেখানোর বিষয়ে তিনি নিবেদিতপ্রাণও হলে তার শিখন-শেখানোর জ্ঞান এবং দক্ষতার প্রস্তুতিগুলো স্বতস্ফূতভাবে গড়ে উঠে।
শিক্ষকের জন্য সমাজ রাষ্ট্রের করণীয়?
শিক্ষকতা পেশা মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রধান। এখানে ব্যক্তিক হিসাব-নিকাশ প্রধান নয়। এক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্র এবং বিশ্বের শিক্ষকদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা প্রয়োজন। তাহলেই চলে। একজন শিক্ষককে যদি তার বাস্তব জীবন বিশেষত অথনৈতিক অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ বা সমস্যা জর্জরিত থাকতে হয়, তাহলে তার পক্ষে রাষ্ট্র, সমাজ ও বিশ্বে আশানুরূপ অবদান রাখা সম্ভব হয় না। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় তো তারাই পরিচালনা করেন।
(১১ ডিসেম্বর, ২০২১; আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)