বাংলাদেশের মানুষের জীবনের গৌরবোজ্জল ঐতিহ্যের একটি বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারী। মাতৃভাষার জন্য নির্ভয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করার ইতিহাস সৃষ্টির শোকের দিন একুশে ফেব্রুয়ারী। আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে এইটা সহজেই অনুধাবন করতে পারি যে, কি দুর্বার আকর্ষণে বাংলার দূর্জয় সন্তানেরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ২১শে ফেব্রুয়ারীতে নিজের জীবন উৎসর্গ করে বাঙ্গালী জাতিকে দিয়ে গেছেন স্বাধীন মাতৃভাষা বাংলা।
বাংলা ভাষার ইতিহাসের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী যখন হাজার হাজার ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হন তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেল যা ব্যারাক নামে পরিচিত ছিল (বর্তমানে শহীদ মিনার অবস্থিত) তা ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। “বাংলা ভাষা’কে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীতে যখন ক্ষোভে উত্তাল রাজপথ তখন ছাত্রসমাজ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক এবং বাংলা ভাষাভাষী সকল শ্রেণীর জনগণ নেমে এসেছিলেন রাজপথে। তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি “মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধিদের সভায় গঠিত হয় বাংলা ভাষার জন্য প্রথম একটি কাউন্সিল যার নাম ছিল “সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”।
ছাত্ররা যখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে নেমে আসেন রাজপথে তখন বাংলাভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন ভাষা শহীদরা অনেক ভাষাবিদরা, কারাবরণ করেন ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক, বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী।
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরী পাকিস্তান সরকারের হাতে বন্দী হন এবং কারাবরণ করেন। ১৯৭১ সালে এই ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, নাট্যকার ও সাহিত্য সমালোচক বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের অন্যতম শিকার হলেও বাংলাভাষায় তার অবদান চিরস্মরণীয়।
একুশের ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল আমাদের স্বাধীনতার মূল সূত্রপাত। স্বাধীন বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ভবনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে “ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ”।
বাংলা ভাষা বিষয়ক বিজ্ঞানসমত চর্চা ও গবেষনায় বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করা এবং আন্তর্জাতিক চাহিদা বিশেষত তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে মিল রেখে বাংলা ভাষাকে বিশ্ব মানসম্মত করার উদ্দেশ্যেই এই বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের ভাষাবিদরা বাংলা ভাষাকে নিয়ে গবেষনায় নিয়োজিত রয়েছেন। বাংলাভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষার চর্চা, প্রশিক্ষণ, গবেষণায় ভাষা নীতি প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা প্রদান ও পরামর্শ প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট”। বর্তমানে “চিকিৎসা ভাষা বিজ্ঞান” “ভাষা বিজ্ঞান“ বিভাগের বাংলা ভাষা ভাষী মানুষদের জন্য গবেষণার আকেরটি নতুন উন্মেষ দ্বার। ২০১১-২০১২ সালে এ বিভাগটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যেখানে “অটিজমসহ নিউরো ডেভালাপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং ভাষাবৈকল্য রোগীদের নিয়ে শুরু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণামূলক কার্যবিধি। রোগ ও শোকের কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ যেমন ব্যাহত হয় তেমনি রোগ ও শোকের কারণে কোন মানুষের বিকশিত “ভাষা” দক্ষতাটি হঠাৎ করে হারিয়ে যেতে পারে অথবা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হতে পারে।
বর্তমানে পৃথিবীর সকল চিকিৎসা ভাষাবিজ্ঞানীরা সারা পৃথিবীতে এই বিষয় নিয়ে তৎপর হয়েছে উঠেছেন। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে খুব একটা পিছিয়ে নেই। এ গবেষণায় সহায়তা প্রদান ও পরামর্শ প্রদানের জন্য সক্রিয় ভাবে নিয়োজিত আছেন ডীন কলা অনুষদ, ডীন চিকিৎসা অনুষদ ও মানসিক/মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা এবং ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের ভাষাবিদ শিক্ষকগণ, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খা অনুযায়ী ভাষাবৈকল্য রোগীদের সেবা প্রদানের কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর যাতে এসব রোগীরা একটি অর্থবহ জীবন অতিক্রম করতে পারে। পরবর্তী প্রজন্ম যেন ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে মাতৃভাষার সম্মানকে অক্ষুন্ন রাখতে পারে তার জন্য পালিত হয় “ভাষা পদযাত্রা”।
প্রতি বছর মহান একুশ উপলক্ষ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে নিয়মিত ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে ভাষা শহীদদের স্মরণে তাদের অবদানকে জাতির কাছে তুলে ধরতে এবং ইতিহাসকে অম্লান, অক্ষুন্ন রাখতে ও পরবর্তী প্রজন্মকে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় “ভাষা পদযাত্রা”। এই ভাষা পদযাত্রা শুরু হয় কলা ভবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত অপরাজেয় ভাষ্কর্য্য থেকে ভাষা শহীদের বিনম্র চিত্তে স্মরণ করে ভাষা পদযাত্রা শুরু হয় ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের সকল শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে ভাষা পদযাত্রার সমাপ্তি হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাঙ্গনে অবস্থিত শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি পুষ্প নিবেদন করে। এই ভাষা পদযাত্রার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্দীপিত করা হয় যেন তারা মাতৃভাষার সম্মানকে অক্ষুন্ন রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সাফল্যের দারপ্রান্তে।
ডাঃ ফাহমিদা ফেরদৌস
মনোরোগ/মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসা ভাষাবিদ
সহকারী অধ্যাপক (মনোরোগ বিদ্যাবিভাগ)
জেড.এইচ সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।