হোম কোয়ারেন্টাইন সময়ে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন

হোম কোয়ারেন্টাইন সময়ে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন
হোম কোয়ারেন্টাইন সময়ে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন

টিভিতে সন্ধ্যার খবর দেখার পর থেকেই সুমির গলা বারবার শুকিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে গলার কাছে কি যেন আটকে আছে তাঁর! স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন করোনা ঝুঁকিপূর্ণ! কি হবে তাঁর এখন! উন্নত দেশের খবরগুলো আরো অস্থির করে তোলে সুমিকে! সে মরে গেলে কি হবে তাঁর বাচ্চাটার! আবার ভাবে তাঁর স্বামীর কিছু হলে কে তাদের দেখবে! বাসায় তাঁর বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি, উনাদের কিছু হলে এখন কোথায় যাবে, কি করবে! এসব ভেবে তাঁর সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে! হঠাৎ বাচ্চার কান্নায় খেয়াল হয় তাঁর! দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে!
সুমির মতো করোনা আতংক এখন কমবেশি সবারই। আর এই সময়ের জন্য এটি খুবই স্বাভাবিক। একই ঘটনায় একেক জন একেক ভাবে প্রতিক্রিয়া করে। এটি নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব, পূর্ব অভিজ্ঞতা, মনোভাব, মূল্যবোধ, সমস্যা সমাধান ক্ষমতা ইত্যাদির উপর। আর এই ভিন্নতার কারনেই সময়ের সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ভিন্নতা দেখা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কোভিড-১৯ মোকাবেলায় যে Strategic Plan গ্রহণ করেছে তার ৮ টি পিলারের ৭ ও ৮ নং পিলারে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
এ সময়ে নিজের যত্ন নিতে কি কি করা যেতে পারে:
১. নিজের অনুভূতির সাথে পরিচয়ঃ আপনার ভয় হচ্ছে! এতে লজ্জার কিছু নেই, লুকানোরও কিছু নেই। কারন যেকোন বিপর্যয়ে এরকম ভয়, হতাশা, অনিশ্চয়তা, একাকীত্ব এই অনুভূতিগুলি হওয়াই স্বাভাবিক। বরং এই অবস্থা অতিক্রম করতে আপনার জীবনের পূর্ব অভিজ্ঞতাগুলো মনে করে দেখুন। আপনি জীবনে যখনই কোন বিপদে পড়েছেন সেটি কাটিয়ে উঠতে কি কি করেছিলেন, কার কার সাহায্য নিয়েছিলেন। হয়ত ভাবছেন “করোনা তো আগে ছিলনা”। একটু ভেবে দেখুন আপনি যখন এসএসসি এক্সাম দিতে প্রথম দিন গেলেন কিম্বা প্রথম চাকুরীর ইন্টারভিউ দিতে গেলেন সেই সময়ও আপনার ভীষণ ভয় হয়েছিল এবং আপনি সেটা কাটিয়েই এত দূর এসেছেন।
২. বর্তমানকে মেনে নেয়াঃ আগে হয়ত কখনো এভাবে বাসায় বসে থাকেননি, ভাবতেও পারেননি যে এভাবে থাকা যায়। এখন একটু ভিন্ন ভাবে ভাবুন, এ সময়টাকে অভিশাপ নয় বরং আপনি নিজেকে জানার সুযোগ পেয়েছেন। যত ব্যস্ত জীবনেই অভ্যস্ত হন না কেন বর্তমান সময়কে যত দ্রুত মেনে নিতে পারবেন তত দেখবেন বাসায় থাকাটা মোটেও কঠিন নয়। ৬ মাস, ১ বছর পর অবস্থা আরও কত খারাপ বা ভাল হবে এই চিন্তা করে এখনকার আনন্দ মাটি করবেন না। মনে রাখবেন ভবিষ্যৎ আমাদের কারই জানা নেই।
৩. ভীত নয় সতর্ক হোনঃ ভীত না হয়ে করোনা সম্পর্কিত সব ধরনের সতর্কতা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। যেমন, ২০ সেকেন্ড সময় নিয়ে হাত ধোয়া, কনুই দিয়ে ঢেকে হাঁচি-কাশি দেয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, মাস্ক ব্যবহার , সামাজিক দূরত্ব ইত্যাদি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হল বাসায় থাকা।
৪. যত্ন সহকারে অন্যের সাথে কথা বলা এবং শোনাঃ যখনই কথা বলবেন মনোযোগ দিতে চেষ্টা করুন। তাড়াহুড়ো না করে গুরুত্ব দিয়ে শুনুন। কেউ করোনা আতংকে আছেন শুনলে তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উত্তর দিন। এমন কিছু বলা থেকে বিরত থাকুন যাতে তাঁর ভয় আরো বাড়ে। কারন তাঁর ভয়–আতংক আপনাকেও ভীত করে তুলতে পারে। যারা একটু বেশি টক্সিক তাদের এ সময়টায় এড়িয়ে চলুন। পরিবারের শিশুদের কথা কিম্বা গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনুন যা এতদিন ব্যস্ততার জন্য করতে পারেননি।
৫. নতুন কিছু করাঃ নতুন কিছু করা মানেই নতুন কোন এক্সপেরিমেন্ট করা নয়। সব নতুন করে শুরু করা কিম্বা এই মুহূর্তে জীবনে বড় কোন পরিবর্তন আনা নয়। সৃষ্টিশীল ছোট ছোট নতুন কাজ করা যেতে পারে যা করতে ভাল লাগবে এবং আত্নবিশ্বাস বাড়বে। ভেবে দেখুন আপনার লিস্টে এমন অসংখ্য অপূর্ণ শখ আছে। আগে কোন দিন করেননি বলে যে আর হবেনা তা কিন্তু নয়।
৬. পারিবারিক সম্পর্কের উন্নতিঃ যে বিষয় গুলো নিয়ে কথা হলে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পারস্পারিক দ্বন্দ্ব হয় এই সময় সেগুলো এড়িয়ে চলাই ভাল। বরং এমন কিছু করা যাতে সম্পর্কের উন্নতি হয়। যেমন, পরস্পরের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করা, একসাথে পছন্দের রান্না করা, পুরনো আনন্দের স্মৃতিচারন করা। পুরনো কোন রাগ বা ক্ষোভ নিয়ে কথা না বলাই ভাল হবে এ সময়।
৭. প্রার্থনা এবং কৃতজ্ঞতাঃ প্রতিদিন বাসায় নির্দিষ্ট সময়ে প্রার্থনা করুন যার যার ধর্ম অনুযায়ী। ৫ ওয়াক্ত নামায পড়া, খাবার টেবিলে পরিবারের সবার সাথে প্রার্থনা করা ইত্যাদি। আপনার জীবনে ভাল কিছুর জন্য যাদের অবদান, তাদের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞ হোন। সম্ভব হলে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে ধন্যবাদ দিন।
৮. তথ্য নির্বাচনঃ শুধুমাত্র আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা না দেখে সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে কতজন সে সংখ্যাটি দেখলে আপনার মনোবল বাড়বে। সারা দিনরাত করোনার খবর না নিয়ে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করলে আপনি মানসিক ভাবে ভাল বোধ করবেন। করোনার লক্ষন এবং সংক্রমণ হলে কি কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে প্রয়োজনীয় ফোন নাম্বার সংগহে রাখুন। কোন কোন খাবার খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে সেটি সঠিক ভাবে জেনে নিজের পছন্দের খাবারের তালিকার সাথে মিলিয়ে নিন।
৯. ডেইলি রুটিনঃ বাসায় আছেন বলে ঘড়ির এলার্ম বন্ধ করে দিয়ে থাকলে সেটি আবার চালু করুন। বাসায় কিম্বা বাইরের কাজে যেখানেই থাকুন না কেনো দৈনন্দিন কাজের রুটিন আপনাকে গতিশীল রাখবে যা শারীরিক এবং মানসিক প্রশান্তি এনে দিবে। গান শুনুন, বই পড়ুন, নিজেকে রিফ্রেম করুন। পরিবারের বাচ্চাদের রুটিন করে দেয়ালে লাগিয়ে দিলে ওরাও সেটি আনন্দ নিয়ে মেনে চলবে। ইয়োগা, মেডিটেশন, মাইন্ডফুলনেস, ডীপ ব্রেথ ইত্যাদি করুন। খালি জায়গায় হাঁটা-চলাফেরা করুন। এ সময়ে ত্বক এবং চুলের যত্ন নিন। পছন্দের পোশাক পরুন। খাওয়া, ঘুম ঠিক রাখুন।
১০. নিজেকে জানাঃ আপনি হয়ত নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভুলেই গেছেন। দিনের কিছুটা সময় একা চুপ চাপ থাকুন। এই সময়টায় নিজেকে নিয়ে ভাবুন। আপনার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, ভাল লাগা, মন্দ লাগা, হাতে চায়ের মগ নিয়ে প্রিয় গানের সুর শুনতে শুনতে কিম্বা আকাশ দেখতে দেখতে নিজেকে আবিষ্কারের সুযোগও হয়ে যেতে পারে।
পরিশেষে বলব, জীবন এখনও ফুরিয়ে যায়নি। নিজেকে নিয়ে ভাবুন। নিজেকে ভালোবাসুন। নিজের যত্ন নিন। আপনি নিজে সুস্থ্য থাকলেই অন্যের বিপদে পাশে থাকতে পারবেন। নিজের অনুভূতি অন্যের সাথে শেয়ার করুন। প্রয়োজনে মনোবিজ্ঞানী ও মনোঃ চিকিৎসকের সাহায্য নিন।
 

Previous articleকরোনা লক্ষণযুক্ত মায়ের নবজাতক শিশুর যত্ন নেবেন যেভাবে
Next articleকোভিড-১৯: অন্যান্য রোগের উপসর্গ নিয়েও আবির্ভূত হচ্ছে
ফারজানা ফাতেমা (রুমী)
Psychologist, Bangladesh Early Adversity Neuro imaging Study, icddr, b. Mental Health First Aider, Psycho-Social counselor. BSC & MS in Psychology, University of Dhaka; Masters in Public Health, State university of Bangladesh.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here