ডা. মাহাবুবা রহমান
এমবিবিস, এমডি (চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি)
রেজিস্ট্রার, ডিপার্টমেন্ট অব সাইকিয়াট্রি
মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন এন্ড হসপিটাল, ঢাকা৷
নিকটজন থেকে আকস্মিক বিচ্ছেদ যে কারো জন্যই বেদনাদায়ক। বিশেষত বিচ্ছেদের কারন যদি হয় মৃত্যু এবং সেটি যদি হয় শিশুর জীবনে তবে সেটি আরো বেশি কষ্টের। হঠাৎ অভিভাবকহীন হয়ে পড়া শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
গবেষকদের মতে এই প্রভাব শিশুর বয়স অনুপাতে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সাধারনত চার থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের থেকে কম বয়সী বাচ্চাদের মৃত্যু সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকেনা। তবে হঠাৎ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ার কারণে তাদের মধ্যে হতাশা, উদ্বিগ্নতা এবং বিভিন্ন আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
অন্যদিকে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুরা মৃত্যু সম্পর্কে মোটামুটি সুস্পষ্ট ধারণা রাখে বিধায় অভিভাবকের আকস্মিক মৃত্যুতে তাদের মধ্যে দেখা যেতে পারে তীব্র শোক, বিষন্নতা, এমনকি আত্মহত্যার মত চিন্তা। আর ১১ বছর বয়সের পর থেকে কিশোরদের মৃত্যু বিষয়ক চিন্তাভাবনা এবং প্রতিক্রিয়াগুলো বড়দের মতই হয়ে থাকে।
বাড়ন্ত বয়সী শিশুদের মনে চাপ সৃষ্টিকারী যেকোনো ঘটনার প্রভাব হয়ে থাকে দীর্ঘমেয়াদি যার প্রতিফলন দেখা যায় পরিনত বয়সী ব্যক্তির ব্যক্তিগত, সামাজিক, কর্মপরিধি ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে। তাই আসুন জানি, হঠাৎ অভিভাবকহীন হয়ে পড়া শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের কিছু করণীয় সম্পর্কে-
প্রথমত মৃত্যু সম্পর্কে শিশুকে তার বয়সানুযায়ী একটি পরিষ্কার ধারনা দিতে হবে। এক্ষেত্রে একটি শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশে শিশুকে নিয়ে বসুন। ছোট শিশুর ক্ষেত্রে তার পছন্দের কোনো খেলনা বা বস্তু যেটা সে সবসময় তার সাথে রাখতে পছন্দ করে, তেমন কিছু নিয়ে বসতে দিন।
এরপর ধীরে ধীরে আপনার কথা শুরু করুন। কথার মাঝখানে একটু বিরতি নিন, জানার চেষ্টা করুন শিশু আপনার কথা কতটুকু বুঝতে পারছে৷ সহানুভুতিশীলতার সাথে বিষয়টি তাকে বোঝান৷ তবে এক্ষেত্রে কোনো পরোক্ষভাব বা কাল্পনিক কথা যেমন, “মা হারিয়ে গেছে” বা ” ঘুমিয়ে গেছে” এসব ব্যবহার করবেন না । এতে শিশু বিভ্রান্ত হতে পারে।
সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিন যে মৃত্যু একটি অপরিবর্তনীয় ঘটনা, অর্থাৎ যার মৃত্যু হয়েছে তিনি আর আমাদের মাঝে আসবেন না। আপাতদৃষ্টিতে এটা বলা খুব কঠিন মনে হতে পারে তবে শিশুর মানসিক সুস্থতার জন্যই বিষয়টি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারনা প্রদান প্রয়োজন।
শিশু এসময় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, সেজন্য আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন। শিশু আবেগী হয়ে পড়লে বা কান্না করলে তাকে জড়িয়ে ধরে স্বান্ত্বনা দিন। তাকে আশ্বস্ত করুন যে এখন থেকে আপনারাই তার অভিভাবক হিসেবে সমস্ত দ্বায়িত্ব পালন করবেন।
হঠাৎ অভিভাবকহীন হয়ে পড়লে প্রথম প্রথম শিশুর দৈনন্দিন রুটিনের ব্যঘাত ঘটত্র পারে। ধীরে ধীরে তাকে তার পুরোনো রুটিনে ফিরিয়ে আনুন৷ নিয়মিত স্কুলে যাওয়া, ঘুম, খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি অন্য শিশুদের সাথে মেলামেশা, খেলাধুলা করা, বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে অংশ নেয়া, শিশুর সুকুমারবৃত্তিগুলোর চর্চা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো যেন অব্যহত থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।
শিশুর জন্য একটি নিরবচ্ছিন্ন ভালবাসা ও নিরাপত্তার জায়গা নিশ্চিত করুন। ছোট শিশুরা সাধারনত শারিরীক সংস্পর্শ, যেমন জড়িয়ে ধরে আদর করা, কোলে নিয়ে দোল খাওয়া, গান গাওয়া ইত্যাদি ভালবাসে এবং নিরাপদ বোধ করে। বড় শিশুদের ক্ষেত্রেও তাদের ভাল কাজগুলোর প্রশংসা করুন ও তার ছোট ছোট প্রচেষ্টাগুলোতে উৎসাহ দিন।
শিশুকে মন খুলে কথা বলার সুযোগ করে দিন। মৃত ব্যক্তির স্মৃতি রোমন্থন করতে উৎসাহ দিন। অনেকসময় শিশুরা এমনকি বড়রাও দেখা যায় মৃত ব্যক্তির স্মৃতি মনে করতে চাননা বা তার স্মৃতি বহন করে এমন যেকোনো বস্তু দেখলে সেটিকে এড়িয়ে চলেন। তারা ভাবেন এতে হয়ত কষ্ট বাড়বে।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি উল্টো। মৃত ব্যক্তির সাথে কাটানো সময়ের স্মৃতিচারন করলে মনের চাপ কমে। তাই শিশুকে মৃত ব্যক্তির স্মৃতিচারন, তার কবর জিয়ারত করা কিংবা স্ব- স্ব ধর্মানুযায়ী তার জন্য প্রার্থনা করা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে অংশ নিতে উৎসাহ দিন।
শিশু অনাকাংক্ষিত আচরন করলে, জেদ করলে কিংবা কথা শুনতে না চাইলে তাকে বকাঝকা না করে শান্ত থাকুন। অনেকসময় শিশুর মনের কষ্টের বহিপ্রকাশ হয় আচরনগত সমস্যার মাধ্যমে। তাকে ধৈর্য্য ধরে মনের ভাব প্রকাশের সঠিক আচরনটি বুঝিয়ে দিন।
শিশুর স্কুলের শিক্ষকদের বিষয়টি সম্পর্কে জানান, যাতে করে তাদের মাধ্যমে ক্লাসের অন্য ছাত্ররাও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকে এবং শিশুকে সবরকম মানসিক সহায়তা দিয়ে থাকে।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও যত্নবান হন। পরিমিত সুষম খাবার এবং নিয়মিত ঘুম নিশ্চিত করুন। মৃত ব্যক্তির প্রতি আবেগগুলো মনের মধ্যে চেপে না রেখে প্রকাশ করুন। মনে রাখবেন, আপনি মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে কখনোই শিশুর মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারবেন না।
সবশেষে আপনার শতভাগ প্রচেষ্টার পরেও যদি হঠাৎ অভিভাবকহীন হয়ে পড়া শিশুর মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে না পারেন, তার মধ্যে নতুন নতুন আবেগীয় বা আচরনগত সমস্যা দেখতে পান এবং তাকে দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন তবে অবশ্যই দেরি না করে নিকটস্থ একজন শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরনাপন্ন হন।