“আমার যখন ১৭ বছর বয়স, তখন আমি আমার মাকে হারাই। আমি আমার ছোট বোনের (যার বয়স তখন ১৬) খুব ঘনিষ্ট ছিলাম। সে ছিল আমার বন্ধু ও অন্তরঙ্গ সখা – এক বিশ্বাসযোগ্য মানুষ যার কাছে যে কোনও পরিস্থিতিতে পরামর্শ চাওয়া যায়। তাঁর কষ্ট আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আমার মা মারা যাওয়ার এক বছর পরেও আমি সেই ধাক্কা সামলে উঠতে না পারায়, আমায় থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বোন কিন্তু নিজেকে সামলে জীবনে এগিয়ে গিয়েছিল। মা’র কথা মনে পড়লে সে কাঁদত। কিন্তু আমার মতন তাঁর জীবন থেমে যায়নি।”
মীরা, যার অভিজ্ঞতার কথা উপরে লেখা হয়েছে, বরাবরই ভাবত যে কেন সে নিজের মায়ের মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছে না? তার এই অক্ষমতাকে নিয়ে সে ক্রমাগত নিজেকে প্রশ্ন করত। সবথেকে বড় কথা সে নিজেকে তার বোনের সাথে তুলনা করত এবং বুঝতে চাইত যে কিসের অভাবে সে এই রকম দুর্বল হয়ে পড়ছে।
স্থিতিস্থাপকতার অর্থ বোঝা
অনেকেই মনে করেন যে এমন কিছু রয়েছে যা একই পরিস্থিতিতে মানুষের আলাদা প্রতিক্রিয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে এই কারণ ব্যক্তিবিশেষে বা পরিস্থিতি হিসেবে পাল্টায় না। এমন কিছু রয়েছে যা আমাদের অন্তরে লুকোনো, যা আমাদের অপরাজেয় ও অভেদ্য করে তোলে। একেই সবাই স্থিতিস্থাপকতার নাম দেন এবং মনে করেন যে এই গুণটি মানুষকে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে, এবং ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে।
কিন্তু বর্তমানে এই শব্দটিকে আমরা ভিন্ন উপায়ে ব্যাখ্যা করি। স্থিতিস্থাপকতাকে এখন যে কোনও পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার গুণ হিসেবে দেখা হয়।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে আমরা ভূমিকম্প, বন্যা, ধ্বস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়া ব্যক্তিদের স্থিতিস্থাপকতার উদাহরণ খুঁজে পাই। সম্প্রতি, কেরলার বন্যায় এই রকম একটি ছবি আমাদের কাছে উঠে এসেছে, যেখানে কিছু লোক নিজের সর্বস্ব হারানোর পরেও, সাহসিকতা ও ইচ্ছাশক্তির উপরে ভর করে বাকি আর্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
স্থিতিস্থাপকতার আরেক নাম কি এসপার–নয়–ওসপার মানসিকতা?
স্থিতিস্থাপকতা কোনো এমন গুণ নয় যা ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে রয়েছে বা নেই। পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রত্যেকটি মানুষের স্থিতিস্থাপকতা আলাদা হয়।
যখন মীরাকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁর প্রতিক্রিয়া নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, তখন ঝটিতি তার উত্তর উড়ে এসেছিল, “আমার মনে হয় আমি দুর্বল। আমি কোনও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারি না।” আমি দেখলাম মীরার স্বামী পাশে বসে অস্ফুটে মাথা নাড়লেন। কী ভাবছেন জানতে চাওয়ায় তিনি বললেন, “আমার মনে হয় না এটা ঠিক। আমাদের বিয়ের পর যখন আমার বাবা-মা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিতে চাইছিলেন না, সেই সময়টা আমাদের মানসিক টানাপড়েনের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল। আমরা ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম, আর আমার কথা ভেবে মীরা আগাগোড়া আমার বাবা-মার সাথে ভাল ব্যবহার করেছে ,এবং তাঁদের দুর্ব্যবহার এবং বদমেজাজের পরিবর্তে শুধুই ভালবাসা দিয়েছে।”
বাকিদের মতই, মীরাও, জটিল পরিস্থিতিতে নিজের স্থিতিস্থাপকতা উপলব্ধি করতে পারছিল না, এবং অবিচল ভাবে আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছিল।
এই মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা এমনি এমনি বা জোর করে তৈরি হয় না। মানুষ স্থিতিস্থাপক হয় পরিস্থিতি বুঝে। পরিস্থিতি অনুসারে স্থিতিস্থাপকতাও পাল্টে যায়। একটানা অনেকটা সময় জুড়ে মানসিক চেপে থাকলেও একজন ব্যক্তির স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস পায় এবং তার পক্ষে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
এটা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে স্থিতিস্থাপকতা মানুষের মধ্যে গড়ে তোলা যায় এবং এটি বিরল কিছু সৌভাগ্যবান ব্যক্তির কোনও অলৌকিক ক্ষমতা নয়।
স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করা
স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির নিজের, তার পরিবারের এবং তার পরিবেশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একজন ব্যক্তির স্থিতিস্থাপকতা গড়ে ওঠার পেছনে অনেকগুলি কারণ কাজ করে।
১. স্থিতিস্থাপক হলে অনেক সময় জটিল মানসিক পরিস্থিতি,আঘাত ও যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আপনাকে যেতে হয়। কিন্তু এই সময় যে অভিজ্ঞতা হয়, তা আপনাকে শক্ত করে তোলে, এবং পরিস্থিতি মোকাবিলা করার শক্তি যোগায়। আপনি যদি কখনও কঠিন পরিস্থিতি নাই দেখেন, তাহলে মোকাবিলা করার উপায় শিখতে পারবেন না। স্থিতিস্থাপকতাও একই রকম। নিজের অন্তরের যন্ত্রণা ও দুঃখকে বিশ্লেষণ না করলে আপনার মধ্যে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি হবে না।
২. পাশে কেউ রয়েছে জানলে স্থিতিস্থাপকতা আসে। নিজের পাশে এক দৃঢ় ও ভরসাযোগ্য সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের বাড়িতে, বন্ধুদের সাথে ও কর্মক্ষেত্রে এক সুস্থ সম্পর্ক হল আপনার স্থিতিস্থাপকতার চাবিকাঠি।
৩. নিজেকে বোঝা ও নিজের শক্তি বা দুর্বলতা সম্বন্ধে অবগত থাকা যাতে দুঃসময়ের আগে মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকা যায়। স্থিতিস্থাপকতার জন্যে নিজের প্রকৃত ক্ষমতার জ্ঞান থাকা খুবই আবশ্যিক। এর ফলে আপনি পরিস্থিতি বিরূপ হতে দেখলেই সাহায্যের সন্ধান করতে পারবেন।
৪. পরিস্থিতি অনুসারে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টান। ভেবে দেখুন যে এমন কোন পরিস্থিতি রয়েছে যেখানে আপনি মোটেই ঘাবড়ান না। মনে রাখবেন, যা আজকে কঠিন মনে হচ্ছে, তাই কাল সহজ হতে উঠবে – পরিস্থিতি বদলে যাবে, আর আপনিও ঠিক সমাধানের রাস্তা খুঁজে পাবেন।
৫. নিজের ভেতরে সমস্যার সমাধান ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করুন। নিজের ভেতরে এই গুণাবলিগুলো আয়ত্ব করতে পারলে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। এই রকম ইতিবাচক মানসিকতা থেকেই নিজের ওপরে বিশ্বাস জন্মায়, যা আপনাকে যেকোনও পরিস্থিতিতে অটুট থাকতে সাহায্য করে।
৬. নিজের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতায় ভারসাম্য আনার চেষ্টা করে। নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর সময় শুধু পরিস্থিতির ভাল দিকগুলোই দেখুন। সব ফল আশানুরূপ হবে না, সমস্যাও একেবারে গায়েব হয়ে যাবে না। কিন্তু বৃহত্তর বৃত্তটি কথা মনে রাখলে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আপনি স্থিতিস্থাপক থাকতে পারবেন।
ব্যক্তিবিশেষে উপরোক্ত কৌশলগুলির কয়েকটি বা সবক’টি লাভদায়ক হতে পারে। কিন্তু কোনটি সবথেকে সেরা কৌশল হবে সেটা বুঝতে পারবেন আপনার অতীতের অভিজ্ঞতাগুলি বিশ্লেষণ করলে। তাহলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে জটিল পরিস্থিতিতে এর আগে কোন কৌশলে আপনি স্থিতিস্থাপক থাকতে পেরেছিলেন।
লেখক:কামনা ছিব্বর, কনসালট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও মনোবিভাগ প্রধান,মনোরোগ ও আচরণবিজ্ঞান বিভাগ,ফর্টিস হেলথকেয়ার।