ডা. এস এম আতিকুর রহমান
সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
আধুনিকতার বদৌলতে আমাদের জীবনযাপনের কনসেপ্ট বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর এই আধুনিকতার দর্পণে আমরা দেখি সোশ্যাল মিডিয়ার নানাবিধ ব্যবহার। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে হোক বা কাজকর্ম থেকে এন্টারটেইনমেন্ট সবকিছুই যেন সোশ্যাল মিডিয়াকে কেন্দ্র করে। একটা সময় ছিল আমাদের কাজের ক্ষেত্র ছিল ভিন্ন: আমাদের অবসর যাপনের প্রক্রিয়া ছিল ভিন্ন। কিন্তু এখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর জীবনযাপন করছি। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই আগে ফোন স্কুলিং বা ই-মেইল চেক করার মাধ্যমে আমাদের দিন শুরু হয়। ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম বা বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটে আমরা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করি, মত বিনিময় করি বা নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই শেয়ার করে থাকি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার এই অবাধ ব্যবহার আমাদের জীবনকে যেমন সহজ ও অফুরন্ত আনন্দময় করে তুলেছে তেমনি এর মারাত্মক প্রভাব আমাদের জীবনের অনেকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে। তার মধ্যে যৌনতার সীমানা লঙ্ঘন একটা প্রধান কারণ।
সোশ্যাল মিডিয়া যৌনতার সীমানা লঙ্ঘন করছে
আমরা কেন যৌনমিলন করি?
প্রশ্ন হতে পারে আমরা কেন যৌনমিলন বা সেক্স করে থাকি। মানবজীবনে যৌনতা ওতপ্রেতভাবে জড়িত। শুধুমাত্র যে শারীরিক প্রয়োজনের জন্য যে যৌনমিলন তা কিন্তু নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরো বিভিন্ন বিষয়। মানুষের আবেগ, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। গবেষণায় যৌনমিলনের কিছু প্রধান কারণ লক্ষ করা যায়-
- ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ
- শারীরিক আনন্দ
- সম্পর্কের গভীরতা বাড়ানো।
- কৌতূহল বা অভিজ্ঞতা অর্জন
- বিভিন্ন উপলক্ষ ইত্যাদি।
এছাড়া সেক্স মডেলে যৌনমিলনের ৫টি কারণ নির্ধারণ করা হয়-
বংশ পরম্পরা
বংশ পরম্পরায় সেক্স আদিম প্রবৃদ্ধি। কেননা সেক্সের মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বৃদ্ধি পায়।
সেক্স ড্রাইভ
সেক্সের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো সেক্স ড্রাইভ। ব্যক্তি যৌন তাড়না থেকে সেক্স করছেন বা আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
মাচোম্যান
এরা নিজের পুরুষত্ব প্রকাশের জন্য সেক্স করে। নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে বিভিন্ন মেয়েদের নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করে থাকে এবং যৌনমিলন করে।
বিনোদন
এমন অনেকে রয়েছেন যারা শুধু বিনোদনের জন্য সেক্স করে থাকেন। বিনোদন ছাড়া এদের মধ্যে সেক্সের কোনো অর্থ নেই।
সম্পর্ককে পরিপূর্ণতা প্রদান
সম্পর্ককে পরিপূর্ণতা প্রদান করতে সেক্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ভালোবাসা বা একে অপরের প্রতি প্রবল আকর্ষণবোধ থেকে ব্যক্তি সেক্স করেন। অর্থাৎ ব্যক্তির যৌন জীবনে কোনো মোটিভেশনটা আসলে কাজ করছে তা মূল বিষয়। এ থেকেই নির্ধারণ করা যায় তার উদ্দেশ্যটা কী।
সোশ্যাল মিডিয়া ও যৌনতা
যৌনতা চিরাচরিত একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। যা প্রত্যেকটা সুস্থ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু যৌনতা যদি সীমানা লঙ্ঘন করে তবে যৌন জীবন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে এর আকার দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে।
কেইস স্টাডি
সাফিয়া (ছদ্মনাম) যার বয়স ৫০ বছর। তার হাসব্যান্ড মারা যাওয়ার পর থেকে সে ফোন সেক্সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এমনকি তার হাসব্যান্ড জীবিত থাকাকালীন সময়েও সে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে ভার্চুয়াল সম্পর্ক গড়ে তোলে। স্বামীর মৃত্যুর পর সাময়িকভাবে সে দুইজনকে বিয়ে করলেও কোনো সংসারই টিকেনি। দুজনের মধ্যে একজন বিয়ের প্রথম রাতেই তার কাছ থেকে পালিয়ে চলে যায়। কেননা ভার্চুয়ালি বা ফোনে বেশিরভাগ সময় ব্যক্তির সঠিক পরিচয়, ব্যক্তির চেহারা, বয়স ইত্যাদি জানা সম্ভব হয় না। তাছাড়া মানুষ স্বভাবতই সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেকে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করে থাকে।
ফলে কোনো না কোনো পক্ষের প্রতারিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েই যায়। এমন সম্পর্কগুলোর কোনো পরিপূর্ণতা বা ভবিষ্যৎ নেই। কেননা এসব ব্যক্তিরা যৌন জীবনে একজন ব্যক্তির সঙ্গে সন্তুষ্ট নয়। একাধিক সঙ্গী খুঁজে তাদের সঙ্গে সেক্সুয়াল সম্পর্ক গড়ে তোলাটাই এদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে। পলিগ্যামি ব্যক্তিরা সাধারণত এমন হয়ে থাকে। ফলে দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় পরকীয়া প্রেমে আসক্ত হওয়ার দরুন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয়। একটা সময়ে ডিভোর্সের দিকে যেতে থাকে।
এমন একটি ঘটনার উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- সামাদ (ছদ্মনাম) সরকারি চাকরিজীবী। তার বয়স চল্লিশের মধ্যে। তার একটি সন্তান রয়েছে। সে সোশ্যাল মিডিয়ায় ডেটিং অ্যাপসের মাধ্যমে একটি কম বয়সি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তিতে তার স্ত্রীকে সে ডিভোর্সের জন্য চাপ দেয়; মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে। একটা সময় ডিভোর্স হয়েও যায়।
এমন ঘটনা খুব বিরল নয়। আমাদের চারপাশেই এর – অস্তিত্ব অহরহ। অনেকে সেক্সকে ভিন্নভাবে এক্সপ্লোর করতে চায়। কেননা একেক জনের সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি একেক রকম। ব্যক্তি যদি তার পার্টনারের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত চাহিদাকে পরিপূর্ণ করতে না পারে তখন সে ভিন্ন পথ খুঁজে থাকে। এদের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া একটি অন্যতম স্থান। কারণ এখানে অফুরন্ত অপশন রয়েছে। ডেটিং সাইটগুলোতে দেখা যায় প্রত্যেকেই ক্যাজুয়াল সেক্স পার্টনার খুঁজতে আসে। এসব সম্পর্কের স্থায়িত্বকাল খুবই অল্প। ফলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। এক্ষেত্রে কোনো কমিটমেন্ট প্রয়োজন হয় না। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় এসব ভার্চুয়াল যৌন সম্পর্ক বাস্তবেও রূপ লাভ করে।
যৌনতার সীমানা লঙ্ঘন ও মানসিক প্রভাব
সোশ্যাল মিডিয়াকে কেন্দ্র করে যৌন আসক্ত ব্যক্তিরা একটা সময় বিভিন্ন প্রকার মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকে। শুধু ব্যক্তিজীবন নয় পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও এর গুরুতর প্রভাব লক্ষ করা যায়-
সামাজিক দক্ষতা কমে যাওয়া
সোশ্যাল মিডিয়ায় অভ্যন্ত ব্যক্তিদের সামাজিক দক্ষতা আস্তে আস্তে কমে আসে। কারণ তারা তাদের অধিকাংশ সময়টাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করে থাকে। বিভিন্ন ডেটিং অ্যাপসে চ্যাটিং করা বা কথা বলাতে ব্যস্ত থাকার ফলে তারা বাস্তব জীবন থেকে অনেক দূরে সরে আসে। সবার সঙ্গে থাকলেও তাদের মনোযোগ ফোনের মধ্যে বা ডিভাইসে বিদ্যমান। যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার সম্পর্কগুলো একটা লুকোচুরির মতো হয়ে থাকে, ফলে তারা সবসময় একা থাকতে পছন্দ করে।
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক রোগ
ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলোর স্থায়িত্ব বেশিদিন না হওয়ার ফলে ব্যক্তি মানসিক অস্থিরতায় ভুগে থাকে। এছাড়া সম্পর্কের স্থায়িত্বকালে বেশি সময় হলেও সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমন কেউ স্থায়িত্বকাল বেশি হলে বিরক্তবোধ করতে পারেন; কেননা তার মধ্যে ঘন ঘন পার্টনার পরিবর্তন করার অভ্যাস বা ইচ্ছা থাকতে পারে। আবার কেউ কেউ সম্পর্ক ভেঙে গেলে ডিপ্রেশনে ভুগে থাকে। অনেকসময় দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় সেক্সুয়াল সম্পর্ককারী ব্যক্তিরা হঠাৎ পার্টনার খুঁজে না পেলে হীনম্মন্যতায় ভুগে থাকে। ফলে ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটিসহ নানান সমস্যা দেখা যায়।
পর্নগ্রাফিতে আসক্ততা
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে পর্নগ্রাফিতে আসক্ত হওয়া খুবই কমন একটা বিষয়। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই যৌন উত্তেজক ভিডিও চোখের সামনে চলে আসে যা মানসিক বিকৃতি ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অনেক শিশু-কিশোররা এ থেকে পর্নে আসক্ত হয়ে পড়ে। অনেক পর্ন সাইট রয়েছে যেখানে পর্ন সহজলভ্য। সেখান থেকে শিশু- কিশোর বা প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ নিয়মিত পর্ন দেখে থাকে। দীর্ঘদিন পর্ন দেখার ফলে তাদের মধ্যে ইরেকটাল ডিজফাংশন হবার সম্ভাবনা দেখা যায়। পরবর্তিতে পর্ন দেখা ছাড়া তারা কোনোভাবেই যৌন তৃপ্তি লাভ করতে পারে না। এতে করে ব্যক্তির স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরে। তাছাড়া পর্ন আসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অসামাজিক হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
বিজ্ঞাপন ও সোশ্যাল মিডিয়া
বর্তমানে নানান চটকদার বিজ্ঞাপন দিতে মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে থাকে। তেমনি স্কট সার্ভিস, স্পা সার্ভিস, অর্থের বিনিময়ে ভার্চুয়াল সেক্সের (ফোন, ভিডিও বা চ্যাট) মতো বিজ্ঞাপনগুলোও বিভিন্ন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে দেখা যায়। এই ফাঁদে অনেকেই পড়েন যা আমাদের দেশে অবৈধ। এমনকি এর মাধ্যমে প্রতারণা বা জীবনহানির সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও যৌনতাকে ফোকাস করা হয়ে থাকে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়।
যৌনতার সীমানা লঙ্ঘনের অন্যান্য কিছু কারণ
- অনুমতি ছাড়া কারো ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করা।
- সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যৌন হ্যারাসমেন্ট করা। অর্থাৎ কাউকে যৌন প্রস্তাব দেয়া বা আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও পাঠানো। অনেকে নিজের গোপনাঙ্গের ছবি পাঠিয়ে যৌন তৃপ্তি লাভ করে থাকে।
- ক্যাটফিশিং অর্থাৎ ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে আপত্তিকর বা ব্যক্তিগত ছবি সংগ্রহ করে পরবর্তিতে তা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা।
- কারো ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করে তাকে হয়রানি করা।
- সম্পর্কের ইতি ঘটলে প্রতিশোধ নিতে সাবেক সঙ্গীর ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করে দেয়া ইত্যাদি।
উত্তরণের উপায় ও করণীয়
আমরা চাইলেও সোশ্যাল মিডিয়া পরিত্যাগ করতে পারবো না। কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার আমাদের এ সকল সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি, আইনের প্রয়োগ, যথাযথ শিক্ষা ও কাউন্সেলিং। পাশাপাশি সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেউ অপরাধ করলে তার যথাযথ শাস্তি প্রদান করে ভুক্তভোগীদের মানসিক সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া আসক্ত ব্যক্তিদের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে উন্নত জীবনযাপনের প্রচেষ্টা করতে হবে।
- এপয়েন্টমেন্ট নিতে এখানে ক্লিক করুনঃ APPOINTMENT
আরও পড়ুন: