‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে…আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ নতুন কিছু সৃষ্টির নেশা, নিজকে একক হিসেবে দেখার আকাঙক্ষা, শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের অভিপ্রায়, অসীমে রূপান্তরের বাসনা-ইত্যাদি সবকিছু যুগ যুগ ধরে মানুষকে তাড়িত করে, করে আলোড়িত; দেহ-মনে চলে তুর্কি নাচন। মানুষ হয়ে ওঠে দুর্বার, গতিশীল। আর এই গতিময়তা মানুষকে এগিয়ে নেয় বহুদূর। এই বিশাল পথ পাড়ি দিতে যত কষ্ট হোক, যত পরিশ্রম হোক-বৃহত্তর কিছু অর্জনের আশায় মানুষের কাছে তা তুচ্ছ মনে হয়।
এই সৃষ্টির নেশা, এই তাড়না মানুষকে সম্মোহিত করে রাখে, তার মাঝে অজানা সুখের অনুভূতি তৈরি করে-মানুষকে বিরক্ত করে না। মানুষ তার এই তাড়না, তাগিদকে স্বাগত জানায়। চিন্তা আর কাজের মাঝে নিজেকে আরো বেশি নিয়োজিত করে, তখন কর্মক্ষেত্র হয়ে ওঠে চুম্বকক্ষেত্র।
পক্ষান্তরে, কোনো পুনরাবৃত্তিমূলক, অবাঞ্ছিত, অশ্লীল, বিরক্তিকর চিন্তাভাবনা এবং তার বিপরীতে কিছু পুনরাবৃত্তিমূলক, বাধ্যতামূলক আচরণ দ্বারা যখন কোনো ব্যক্তি চালিত হয় তখন তার মাঝে প্রচন্ড পরিমাণ উদ্বেগ, অস্থিতার সৃষ্টি হয় এবং তার জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্ম অক্ষমতার সৃষ্টি হয়, অনেক সময়ের অপচয় হয়। তখন ঐ ব্যক্তিকে অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়।
দেশ বিদেশে এর অনেক খ্যাতনামা শিল্পী, বিজ্ঞানী, লেখক, গায়ক এর মাঝে ক্রিয়েটিভ অবসেশন বা ক্রিয়েটিভ ম্যানিয়া পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু তাঁরা কেউ অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার বা ওসিডি এর রোগী নন। তাঁদের এই অবসেশন অবাঞ্ছিত নয়। বরং একজন সৃজনশীল ব্যক্তি ভালোবেসে সেই প্রেষণামূলক সৃষ্টিশীল চিন্তাযুক্ত কাজে লেগে থাকেন। নিজ আবেগের মূল্য দিতে গিয়ে অনেক শিল্পীই দুঃসাহসী হয়ে ওঠেন, ঝুঁকি নেন।
সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে এবং সৃজনশীল ধারণাকে উপলব্ধি করতে কিছু মাত্রার আবেগ প্রয়োজন হয়, কিন্তু এটি ব্যাধি নয়। উদাহরণস্বরূপ, চলচ্চিত্র নির্মাতা জেমস্ ক্যামেরনের নাম উল্লেখ করা যায়-যিনি টাইটানিক, টার্মিনেটর, এলিয়েন্স এর মতো বহুল জনপ্রিয় ছবি নির্মাণ করেছেন। তাঁর নির্মিত সর্বশেষ ছবি এপিক সায়েন্স ফিকশন মুভি অ্যাভেটার। এই সিনেমাটি তৈরিতে তাঁর সুদীর্ঘ দশ বছর সময় লেগেছে। সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তি, নতুন স্পট এবং ভিন্ন আঙ্গিকের এই মুভিতে নীল এলিয়েন গোত্রের অ্যাভেটার বা হিউম্যান হাইব্রিডদের কার্যকরী ভাষা তৈরির জন্য তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিদ্যা বিভাগ এর একজন অধ্যাপককে নিয়োগ করেন। তিনি ছিলেন একজন উৎপাদনশীল আবেগপ্রবণ বিজ্ঞান সাংবাদিক রেবেকা স্ক্লুট, যিনি The Immortal Life of Henrietta Lacks-এর লেখক।
১৯৫০ সালে তরুণ আফ্রিকান-মেরিকান নারী হেনরিয়েটা ল্যাক্সের শরীর থেকে নেয়া কোষকলার লাইন সম্পর্কে লিখেছেন-যা গবেষকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। স্ক্লুট তার কিশোর বয়স থেকেই বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা শুরু করেন। এই বইটি প্রকাশ করতে তিনি তিনটি প্রকাশনা ঘর এবং চারজন সম্পাদকের কাছে গিয়েছেন। বইটি লিখতে গিয়ে তিনি দশ বছর তার নিজের শহরে যাননি। এমনকি সন্তান গ্রহণও করেননি। স্ক্লুট দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন দীর্ঘদিনের চিন্তার রোমন্থন এবং জানার চেষ্টা তাঁকে এই জটিল কাজটি করতে সক্ষম করেছিল। আর তাঁর এই অধ্যবসায় এবং আবেগ বইটিকে নিউইয়র্ক টাইমস এর সেরা বই বিক্রির তালিকায় নিয়ে এসেছিল।
ডিসকভারি চ্যানেলের টিভিসিরিজ মিথবাস্টার-এর সহকারী হোস্ট অ্যাডাম সেভেজ ‘ডো ডো স্কাল্পচার’ নামক একটি ভাস্কর্য তৈরি করেন-যা একটি ডো ডো পাখির কঙ্কাল। এটি তৈরির জন্য তিনি নিষ্ক্রিয় পাখি সম্পর্কে হাজার হাজার চিত্র এবং নথি সংগ্রহ করেছিলেন। এভাবে একজন চিত্রশিল্পী তাঁর পেইন্টিং বা চিত্রকর্ম সম্পর্কে বা সেগুলোর দিকনির্দেশনা নিয়ে হয়ত দিন-রাত ভাবতে পারেন। কিন্তু সে ভাবনা তাঁকে ভোগায় না, আনন্দ দেয়, সুখী করে। তাই সে ভাবনা হয় স্বাস্থ্যকর, বিরক্তিকর নয়।
এরিক মেসেল এবং অ্যান মেসেল তাঁদের নিবন্ধ ‘ব্রেইন স্টর্ম : উৎপাদনশীল মনোবল শক্তি দমন’ এ কার্যকর, অর্থপূর্ণ আবেগের ক্ষেত্রে সর্বান্তঃকরণে নিয়োজিত থেকে এগিয়ে যেতে বলেছেন। এই স্বাস্থ্যকর নিয়োগ, বিরক্তি এবং নিষ্ক্রিয়তার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। কারণ, যাঁরা সংকীর্ণ স্বার্থে কাজ না করে সর্বসাধারণের স্বার্থে, বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করার আবেগ পোষণ করেন, তাঁদের প্রেরণা আসে বাহির এবং ভেতর উভয় দিক থেকে।
কখনো কখনো সৃজনশীল ব্যক্তিগণ সৃষ্টির ব্যাপারে আগ্রাসী হয়ে ওঠেন। ক্যামেরন এবং অন্যান্য অনেকের ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল বলে আমরা দেখতে পাই। ক্যামেরনের স্ত্রী লিন্ডা হ্যামিল্টন তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাই, সৃজনশীলতার অবশেসন যদি বিধ্বংসীভাবে কাজপাগল করে তোলে, গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের অবসান ঘটনায়-সেটি কখনোই কাম্য নয়।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে