সামাজিক মনোবিজ্ঞানের মজার কিছু বিষয়

সাহায্য চাওয়া দুর্বলতার লক্ষণ নয়

জন্মগত ভাবেই আমরা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপন করতে ভালোবাসি। আর এক সঙ্গে থাকার প্রয়োজনে আমরা ‌একে অন্যের দিকে  সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই। কখনো জেনে আবার কখনো বা অবচেতনেই। আর এ কারণেই মনোবিজ্ঞানেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। যাকে আমরা বলি সামাজিক মনোবিজ্ঞান বা মনোসামাজিক বিজ্ঞান।
মনোবিজ্ঞানের একটি আকর্ষণীয় অধ্যায় হলো সামাজিক মনোবিজ্ঞান। যা একটি গোষ্ঠী বা দলের মানুষের আচরণ নিয়ে কাজ করে। সামাজিক অনেক বিখ্যাত ঘটনার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করে এ বিজ্ঞান।
সামাজিক মনোবিজ্ঞানের ১০টি মজার বিষয় হলো-
১. চলতি পথে আমরা কখনো কখনো অন্য মানুষকে দুর্ঘটনায় পড়তে দেখি, কখনোবা নিজেও দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হই। তখন কিন্তু সবাই ‌আপনাকে এ বিপদ থেকে রক্ষায় এগিয়ে আসবে না। আপনি বিপদগ্রস্ত হয়েছেন দেখে যে উৎসুক মানুষগুলো আপনার চারপাশে ভিড় জমান তাদের মধ্যে হাতোগোনা কয়েকজনই আপনার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। একে বলে-bystander effect.
২.  আবার আপনার চারপাশে এমন অনেক মানুষের দেখা পাবেন যারা কোনো মহান, কখনোবা বিপজ্জনক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একে বলে obedience experiments। মনোবিজ্ঞানি Stanley Milgram এক গবেষণায় দেখেছেন যখন কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিপদে পড়তে বা কোনো দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হতে দেখেন তখন তিনি নিজের শরীরে এক ধরনের ইলেক্ট্রনিক শক অনুভব করেন যা তাকে দুর্ঘটনাক্রান্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করতে তাড়িত করে।
৩. আপনার কি কখনো এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে যে আপনি বা আপনার দলনেতা কোনো একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর দলের অন্যসবাই অনেকটা না বুঝেই সেই একই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তারপর দেখলেন সবাই একই সঙ্গে দিব্যি ভুল করে বসে আছেন!  অনেকটা চিলে কান নিয়েছে শুনে কান পরীক্ষা না করেই চিলের পেছনে দৌড়ানোর মতো! 
এমন অনেক সময়ই দেখা যায়, একটি গ্রুপ ভুল করছে জেনেও অনেকে সে গ্রুপের সঙ্গে নিজেকে তাল মিলিয়ে নেন। Solomon Asch`s একটি সাদৃশ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছেন, তিনটি প্রায় কাছাকাছি লাইনের মধ্যে কোন লাইনটি সবচেয়ে বড়, তা বেছে নেওয়ার জন্য বলা হলে, যখন দলের কোনো নির্ভরযোগ্য সদস্য ভুল লাইনটি বেছে নেন, তখন বাকি সদস্যরাও একই লাইনটি বেছে নিয়েছেন।
৪. পরিবর্তিত পরিস্থিতি সামাজিক আচরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন- একজন ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে কোনো একটি কাজ করছেন, যখন তাকে সে পরিবেশ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তখন তিনি সে কাজ আর বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেন না।
মনোবিজ্ঞানী Philip Zimbardo, Stanford Prison পরীক্ষণে আবিষ্কার করছেন যে, অংশগ্রহণকারীদের যখন কারাগারে প্রেরণ করা হয়, তখন তারা একটি সাধারণ নিয়ম ‍ছয়দিনের বেশি ধরে রাখতে পারেননি। ছয়দিন পর তারা নিয়মটি ভুলে যাচ্ছেন, বা এর ব্যত্যয় ঘটাচ্ছেন। এর ফলে সেই স্থানের কারারক্ষীরাও তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করে।
৫. আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি কেন আমরা একটি জিনিসকে বা একজন মানুষকে বেশি পছন্দ করি! কারণ মানুষ সাধারণত সেই জিনিসটাই খুঁজে পেতে চায় যা তাদের বিদ্যমান বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে যায়। আর সেই তথ্য বা সেই ব্যক্তিকে উপেক্ষা করেন যা, তার বা তাদের চিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিষয়টি প্রত্যাশা নিশ্চিতকরণ বা expectation confirmation হিসেবে পরিচিত।
৬. যখন আমরা সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে শ্রেণিবিভক্ত করি, তখন আমাদের লক্ষ্য থাকে বিভিন্ন গ্রুপের  মধ্যকার পার্থক্যগুলো তুলে ধরা এবং নিজেদের গ্রুপের মধ্যে সে পার্থক্যগুলো কমিয়ে আনা। এটা সামাজিক বিধিনিষেধ বা কুসংস্কারের কারণে হয়ে থাকে।
৭. আমাদের আচার-আচরণ কিংবা বিভিন্ন জিনিস বা ধারণার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ভিত্তিতেই বাহ্যিক বা আভ্যন্তরিণ ভাবে মানুষের মূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। সচেতনতার মাধ্যমে স্পষ্ট আচরণগুলো আয়ত্ব করা যায়। অন্যদিকে আমাদের অবচেতন কার্যকলাপ অন্তর্নিহিত আচরণের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে।
৮.কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের অনুভূতি বা মনোভাব প্রায়ই প্রত্যাশিত ভূমিকা, সামাজিক নিয়ম এবং সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। এমন কি আমরা এও আশা করি যে সমাজের নির্দিষ্ট শ্রেণি বা গ্রুপ সে অনুযায়ী আচরণ করবে। যেমন একজন শিক্ষিত লোক আর একজন অশিক্ষিত লোকের আচরণ এক হবে না। আবার গ্রাম ও শহরের লোকের আচরণের ক্ষেত্রেও বিপুল ফারাক দেখা যাবে।
আবার প্রথম দর্শনেই একটা মানুষের মনোভাব সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক ধারণা সৃষ্টি হয়। এবং আমরা সে অনুযায়ী সেই ব্যক্তির কাছ থেকে পরবর্তী ব্যবহার আশা করি। আর এ কারণেই বোধ হয় চাকরির ইন্টারভিউর জন্য গেলে চাকরি প্রার্থীদের নিজেদের আচার আচরণ বা পোশাক সম্পর্কে সচেতন থাকতে বলা হয়।
৯.  মানুষের আচরণ ব্যাখ্যা করার সময়, কোনো ভালো বিষয়ের অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে আমাদের সৌভাগ্যকে এবং  খারাপ বিষয়গুলো বাইরে থেকে আসে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু যখন এটা অন্য মানুষের ক্ষেত্রে হয় তখন চিরাচরিত ভাবে আমরা মনে করি এটা মানুষের আভ্যন্তরীণ বা আন্তঃচরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি কোনো একটি বিষয়ে খারাপ নম্বর পাই তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা শিক্ষকের দোষ দেই। কিন্তু যদি তা অন্য কোনো শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ঘটে, তখন আমরা বলি, সে হয়ত ভাল করে যথেষ্ট পড়াশুনা করেনি। এই বিষয়টি  actor-observer bias বা পর্যবেক্ষক পক্ষপাত বলা হয়।
১০. অনেক সময় কোনো ধরনের যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই দলের কোনো সদস্যের যুক্তিকে অন্যরা সহজেই গ্রহণ করে।  এ ধরনের ঘটনাকে বলা হয় গ্রুপ থিঙ্ক বা দলীয় চিন্তা। বিষয়টি বারবার ঘটে যখন দলের প্রায় সব সদস্য একই বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
বিষয়টি এমনও হতে পারে যখন দলের সদস্যরা কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত থাকেন। অনেক সময় দলের নেতার ওপর অগাধ আস্থা থেকেও এমনটি হয়।

Previous articleমনের ওপর রঙের প্রভাব
Next articleযা রয়েছে মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনের মে সংখ্যায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here