মনের ওপর রঙের প্রভাব

আপনি কি হলুদ রঙের কক্ষে বসলে অস্থিরতা অনুভব করেন? কিংবা নীল রঙের কক্ষ কি আপনাকে কিছুটা স্বস্তি আর প্রশান্তি দেয়?
বিষয়টা অবাক করার মতো হলেও মানুষের মনের ওপর রঙের অদ্ভুতরকম প্রভাব রয়েছে। কখনো কোনো রং আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে, আবার কখনো কোনো রঙের কারণেই হতাশার একটি ভাব আমাদের আচ্ছন্ন করে।
রং কীভাবে মানুষের মেজাজ, আবেগ অনুভূতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে, সে ব্যাপারে দীর্ঘকাল ধরে ধারণা রয়েছে শিল্পী, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার, মনস্তাত্ত্বিকদের। ব্যক্তি নিজে হয়ত প্রক্রিয়াটির ভেতর দিয়ে যান, কিন্তু বিষয়টি বুঝতে পারে না।
তবে এটা ঠিক যে কোনো ব্যক্তির ওপর রঙের প্রভাবটা অনেকটা ব্যক্তিগত। অর্থাৎ সব রঙের প্রভাব সবার ওপর সমান নয়। অনেকসময়ই এটি নির্ভর করে ব্যক্তি কোন পরিবেশে বা কোন সমাজে বেড়ে উঠছে তার ওপর।
যেমন- পশ্চিমা বিশ্বে সাদাকে শুদ্ধতা ও সরলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আবার এ সাদা রংকেই পূর্বের অনেক দেশে শোক-সন্তাপের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। যেমন পশ্চিমা বিশ্বে বিয়ের পোশাক সাদা রঙের আর আমাদের দেশ সহ পূর্বের অনেক দেশেই বিধবাদের পোশাকের রং হয় সাদা।
স্বভাবতই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন রং এত শক্তিশালী? কীভাবে এটি আমাদের জীবনের এক শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে কাজ করে? আমাদের শরীর ও মনে এর প্রভাবই বা কতোটুকু?
তবে তার আগে আমাদের রং ব্যবহারের ইতিহাস এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে।
রঙ কী?
১৬৬৬ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন আবিষ্কার করেন, যখন পরিপূর্ণ সাদা আলো একটি স্বচ্ছ প্রিজমের মধ্য দিয়ে যায় তখন এর ভেতরে থাকা প্রতিটি রং আলাদাভাবে দৃশ্যমান হয়। নিউটন এও আবিষ্কার করেন যে, প্রতিটি রং একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (মধ্যবর্তী ব্যবধান) হয়ে থাকে, যাকে এর চেয়ে বেশি ভাগ করা যায় না।
আরও গবেষণার পর জানা গেল, একাধিক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো মিশিয়ে কোনো নির্দিষ্ট একটি রং তৈরি করা সম্ভব। যেমন- লাল আলোকে হলুদ আলোর সঙ্গে মেশানো হলে পাওয়া যায় কমলা রং। আবার হলুদ ও বেগুনির মতো কিছু আলোকে পরস্পরের সঙ্গে মেশালে এর মিশ্রণ সাদা রঙে পরিণত হয়। একরঙের সঙ্গে আরেক রং মিশিয়ে কীভাবে নতুন একটি রং তৈরি করা যায়, তা সবচেয়ে ভালো বোঝেন শিল্পীরা।
রঙের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
রঙের উপলব্ধি অনেকটা ব্যক্তিগত হলেও কোনো কোনো রঙের একটি বিশ্বজনীন অর্থ আছে। সাধারণত লাল আভাযুক্ত বিভিন্ন রং যেমন- লাল, কমলা কিংবা হলুদ উষ্ণ রং হিসেবে পরিচিত। এ রংগুলো আমাদের উষ্ণ অনুভূতিগুলোকে তাড়িত করে। আমাদের আবেগ অনুভূতির প্রকাশও হতে পারে এ রংগুলো। রাগ, প্রতিহিংসার মতো অনুভূতির সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে।
অন্যদিকে, নীল আভাযুক্ত বিভিন্ন রং, যেমন- নীল, বেগুনি ও সবুজ শান্ত শীতল রং হিসেবে পরিচিত। শান্তির প্রতীক বলা হলেও নীলকে কখনো আবার দুঃখ বা উদাসিনতার প্রতীক হিসেবেও ধরা হয়।
থেরাপি হিসেবে রং
অনেক প্রাচীন সমাজে, বিশেষ করে মিশর ও চীনে চিকিৎসার জন্য রং ব্যবহার করা হতো, যাকে আজকের যুগে ক্রোমোথেরাপি বলা হয়। একে অনেকে আলো চিকিৎসা বা রং চিকিৎসাও বলে থাকেন। আজকের দিনেও বিকল্প পদ্ধতির চিকিৎসা হিসেবে এর প্রচলন রয়েছে।
ওই চিকিৎসায় লাল রং ব্যবহার করা হত চেতনা ও শরীরকে উদ্দীপিত করতে এবং শরীরের রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে।
হলুদ রঙকে স্নায়‍ু উত্তেজক ও শরীর শুদ্ধিকারক ভাবা হত। কমলা রংকে ব্যবহার করা হত ফুসফুসের আরোগ্যের কাজে। একে বলবর্ধক হিসেবেও ধরা হত।
নীল রংকে অসুস্থতা উপশমকারী এবং ব্যাথা নিরাময়কারী বলা হত। আর বৃক্ষজাত নীল চামড়া বা ত্বকের রোগ উপশম করবে বলে মনে করা হত।
অবশ্য অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীই এ রং চিকিৎসা পদ্ধতিকে সন্দেহের চোখে দেখে থাকেন। রঙের প্রভাব নিয়ে প্রচলিত ধারণাগুলো তারা মনে করেন অতিরঞ্জিত।
রঙের পরিচয়
লাল
লালকে বলা হয় বিপ্লব ও ভালবাসার রং। যাবতীয় আলোর মধ্যে লালেরই তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি, যে কারণে একে সবচেয়ে শক্তিশালী রং বলা হয়। তীব্র উজ্জ্বলতার গুণেই এ রং আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। যার কারণে বিশ্বব্যাপী ট্রাফিক লাইট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া এটি আমাদের উদ্দীপিত করতে এবং হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিতে পারে। লাল রঙের সংস্পর্শে থাকলে সময় তুলনামূলক দ্রুত অতিবাহিত হচ্ছে বলে মনে হতে পারে। একে শৌর্যবীর্য ও যুদ্ধের সহজাত প্রবণতা হিসেবে ধারণা করা হয়। এটি আক্রমণাত্মকও হতে পারে। আবার কখনো এটি হতে পারে বিপদের প্রতীকও।
লাল রং একইসঙ্গে দৃঢ়, মৌলিক ও খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। এ রং আবার ভালবাসারও প্রতীক। আর এ কারণেই হয়ত আমাদের দেশে প্রিয় মানুষটির হাতে অনেকেই লাল গোলাপ তুলে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
নীল
নীলকে বলা হয় মনের রং বা ভালবাসার রং । লাল রঙের প্রভাবটা যেখানে অনেকটাই শারীরিক, সেখানে নীল রঙের প্রভাবটা মানসিক বলা যায়।
গাঢ় নীল স্পষ্ট চিন্তার অনুপ্রেরণা দেয়। হালকা নীল আমাদের মনে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় ও মনযোগ স্থির রাখতে সাহায্য করে। একে আবার অনেকে স্পষ্ট যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেও অভিহিত করেন।
তবে লাল রং যেমন অনেক দূর থেকেও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, নীল ততটা করে না। সময় এবং গবেষণার বিচারে দেখা গেছে  নীল রং পৃথিবীতে সরচেয়ে পছন্দের রং।
তবে অনেকে নীলকে শীতলতা, আবেগহীনতা ও বেদনার প্রতীক বলে থাকেন।
হলুদ
হলুদ স্নায়ু উত্তেজক রং। এটি আমাদের আবেগ-অনুভূতিকে উদ্বেলিত করে। আবার মানসিকভাবেও হলুদ সবচেয়ে প্রভাবশালী রং। খাঁটি হলুদ আমাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাসকে ত্বরান্বিত করে। এটি আশাবাদেরও প্রতীক। অবশ্য অতিরিক্ত মাত্রার হলুদ এর মূল ধর্মকে কিছুটা বিচ্যুত করতে পারে। আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে ভীতি ও শঙ্কার জন্ম দিতে পারে।
প্রাচীন সমাজে হলুদ রংকে স্নায়‍ু উত্তেজক ও শরীর শুদ্ধিকারক ভাবা হত। কমলা রংকে ব্যবহার করা হত ফুসফুসের আরোগ্যের কাজে। একে বলবর্ধক হিসেবেও মনে করা হত।
বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগেও আমাদের দেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক দেশে আজও হাত বা পায়ে ব্যাথা পেলে ব্যাথানাশক হিসেবে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে হলুদকে ব্যবহার করা হয়। আর শারীরিক বলবর্ধক হিসেবে দুধের সঙ্গে হলুদ গুলে খাওয়ানো হয়।
সবুজ
ঘুম থেকে উঠে যদি কেই ঘাসের ওপর হেঁটে যায়, যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজের সমারোহ, তবে কেমন অনুভূতি হবে আপনার! একরাশ প্রশান্তি আর সজীবতার পরশ কি আপনাকে ছুঁয়ে যাবে না!!
সবুজকে মনে করা হয় সবচেয়ে পরিপূর্ণ রং। পৃথিবীতে সবুজের বিস্তৃত উপস্থিতি প্রাণের অস্তিত্ব নিশ্চিত করে। ফলে একে নিশ্চয়তার প্রতীক বলেও মনে করা হয়। তবে সঠিকভাবে ব্যবহার করা না হলে একে মলিন মনে হতে পারে।
বেগুনি
বেগুনিকে বলা হয় উচ্চ চিন্তশক্তির প্রতীক। একে আধ্যাত্মিকতার বাহকও বলা হয়। এটি অন্তর্মুখী, গভীর চিন্তা ও ধ্যানের প্রতীক। একে বলা হয় রাজকীয় রং। বেগুনির অতিরিক্ত ব্যবহার অনেক বেশি আত্মনিষ্ঠা আনতে পারে।
বেগুনির তরঙ্গদৈর্ঘ্য অত্যন্ত কম। এটিই সর্বশেষ দৃশ্যমান আলো। যার ফলে এটি সময়, মহাশূন্য ও নক্ষত্ররাজির সঙ্গেও জড়িত বলে মনে করা হয়।

ধূসর

শীতকালে যখন গাছের পাতা ঝরে যায়, পৃথিবী যখন তার সবটুকু সবুজ হারায় তখন আপনার মনের অনুভূতিটা কেমন হয়! একরাশ বিষ‍াদ কি আপনার মনে ভর করে না!! মনের এ অবস্থাকেই আমরা ধূসরতার সঙ্গে তুলনা করতে পারি।

কোনো রঙের প্রকৃত অবস্থার পরিবর্তে সেখানে যখন একটা বিষণ্ণভাব চলে আসে, ঠিক সে অবস্থাটাকেই আমরা ধূসর বলবো।
শীতকাল এলেই যেন পৃথিবী ধূসর রূপ নেয়। অন্যভাবে বলা যায়, ধূসর হলো অন্য যে কোনো রঙের উচ্ছিষ্টাংশ। তবে ধূসর রঙের অতিরিক্ত ব্যবহার আত্মবিশ্বাসের অভাব ও শঙ্কার প্রতীক।
কালো
কালো এমন এক রং যা সব রংকে হরণ করে। মানসিকভাবে এর প্রভাব মোটামুটি। এটি একটি সুরক্ষার দেয়াল তৈরি করে, যা বাইরে থেকে আমাদের সব শক্তি শুষে নেয় এবং ব্যক্তিত্বকে রক্ষা করে।
এ কারণেই আমাদের দেশে শিশু জন্মের পর থেকে তাদের কপালের একপাশে কালো কাজলের টিপ দেওয়া হয়, যেন কোনো ধরনের খারাপ কিছু তাদের স্পর্শ করতে না পারে।
কালো কিন্তু মূলত কোনো রং নয়, বরং আলোর অভাবেই এর সৃষ্টি। এটি কোনো তরঙ্গও বিকিরণ করে না। সে কারণেই হয়তো অন্ধকারকে বেশিরভাগ মানুষ ভয় পায়।
এছাড়া কালো স্বচ্ছতা, স্পষ্টতার প্রতীক। এটি সূক্ষ্ম, অভিজাত এবং সাদার সঙ্গে খুবই মানানসই।
সাদা
কালোর বিপরীতই সাদা। কালো যেখানে সব শোষণ করে নেয়, সাদা সেখানে সব প্রতিফলিত করে।

সাদা বিশুদ্ধতা ও স্থবিরতার প্রতীক। তবে এ রং সম্পর্কে কিছু নেতিবাচক ধারণাও কাজ করে মানুষের মনে। মনের শূন্যতার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া এটি উষ্ণ রং গুলোকে বিবর্ণ করে দিতে পারে।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, মনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রঙের আছে ঠিকই, কিন্তু তা অল্প সময়ের জন্য। যেমন- একটি নীল রঙের কক্ষ কিছু সময়ের জন্য মনে প্রশান্তির পরশ এনে দিতে পারে, কিন্তু তা দীর্ঘসময় স্থায়ী হয় না।
তবে মানুষের কর্মক্ষমতার ওপর নির্দিষ্ট রঙের প্রভাব আছে বলেও গবেষণায় জানা যায়। যেমন- পরীক্ষার আগে কোনো শিক্ষার্থীকে লাল রঙের সংস্পর্শে রাখা হলে এর প্রভাব তার পরীক্ষার ফলাফলের (নেগেটিভ) ওপর পড়ে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আরেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, লাল রঙের সঙ্গে গতি ও শক্তির সম্পর্ক আছে, যা বিশেষ করে খেলাধুলার সময় কাজে লাগানো যায়।

Previous articleহঠাৎ তিনি মা এবং আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন
Next articleসামাজিক মনোবিজ্ঞানের মজার কিছু বিষয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here