জীবন একটাই। এই জীবনকে সুন্দর করার জন্যে অনেক বস্তু বা উপকরণের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হচ্ছে সঠিক জীবনদৃষ্টির। বিশিষ্টজনেরা বলেন, ধনসম্পদের অভাবে মানুষ দরিদ্র হয় না, দরিদ্র সে-ই, যার সঠিক জীবনদৃষ্টি নেই। জীবনদৃষ্টি সঠিক হলে আপনি রক্ষা পাবেন হোঁচট খাওয়া থেকে, বেঁচে যাবেন ভুল করা থেকে। মনে প্রশান্তি থাকবে, সুখ থাকবে।
বাবা-ছেলের দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত একটি গল্প বলি- বিত্তশালী পরিবারের এক সন্তান। বেড়ে উঠেছেন ধন-দৌলতের মধ্যে। দারিদ্র্য কী তা দেখানোর জন্যে বাবা ছেলেকে নিয়ে গেলেন শহরের বাইরে একটি কৃষি ভূমিতে এক হতদরিদ্র পরিবারে। সেখানে ছেলেকে নিয়ে কাটালেন কয়েকটি দিন। শহরে ফিরে এসে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন তার ভ্রমণ কেমন লেগেছে? ছেলে উত্তর দিল, খুব ভালো। বাবা বললেন, তুমি কী দেখছ দারিদ্র্য কত নির্মম? ছেলে উত্তর দিল, হ্যাঁ- তাই তো বাবা। একটু বিস্তারিত বলো তো তুমি কী দেখলে, কী বুঝলে। ছেলে বলতে লাগল- বাবা আমি দেখলাম, আমাদের বাগানে একটি সুইমিং পুল রয়েছে, আর ওদের রয়েছে এক বিশাল নদী- যার কোনো শেষ নেই। আমাদের আছে বিশাল এক ঝাড়বাতি, আর ওদের রয়েছে আকাশ ভরা তারা। আমাদের বাড়ির সীমানা এই টুকু আর ওদের সামনে বিশাল দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। আমরা খাবার কিনে খাই আর ওরা খাবার চাষ করে পেয়ে যায়। আমাদের আছে উঁচু পাঁচিল যাতে আমরা সুরক্ষিত থাকি, আর ওদের তার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ ওদের প্রতিবেশী ও বন্ধুরা যে-কোনো বিপদ-আপদে সাহায্য করে।
বাবা অবাক বিস্ময়ে শুনলেন, কিন্তু কোনো কথা বলতে পারলেন না। ছেলে একটু থেমে বলল, তোমাকে ধন্যবাদ বাবা, আমাকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্যে যে, আমরা কত দরিদ্র! আসলে ঘটনা কিন্তু একই, দৃষ্টির ভিন্নতার কারণেই এই পার্থক্য তৈরি হলো।
জীবনে সাফল্যের মূলমন্ত্র হচ্ছে এই দৃষ্টিভঙ্গি। সেলিব্রেটিদের জীবনযাপন দেখে আমরা মনে মনে ভাবি যে, কী সুখের জীবন তাদের। আসলেই যদি সুখের হতো তাহলে এত খ্যাতি, বিত্ত, ভক্ত, অর্থ থাকা সত্ত্বেও তাদের কাউকে কাউকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় আত্মহত্যা করতে হতো না। বিষণ্নতাজনিত কারণে বছর কয়েক আগে আত্মহত্যা করলেন অস্কারজয়ী জনপ্রিয় মার্কিন কৌতুকাভিনেতা রবিন উইলিয়ামস। বৈষয়িক অনেক কিছু তারা অর্জন করলেও, জীবন-যাপন করার যে বিজ্ঞান, জীবনকে সুন্দর করার জন্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন সেটা তারা অর্জন করতে পারেনি বলেই হতাশা, বিষাদ আর নৈরাশ্যে তারা আত্মহত্যা করেন। তাই জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্যে সঠিক জীবনদৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে ? কী এই সঠিক জীবনদৃষ্টি? এক কথায় উত্তর দিলে বলা যায়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি-কে গ্রহণ করা। আরও সহজ করে বলতে গেলে যা সত্য, শাশ্বত ও কল্যাণকর তাকেই গ্রহণ করা। দৃষ্টিভঙ্গির দুটি ধরন হচ্ছে : ১. ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ২. নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি
যিনি সবকিছু ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন তিনি সাফল্যকে আমন্ত্রণ করেন আর যিনি নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন তিনি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হন।
ইতিবাচকতা (সঠিক জীবনদৃষ্টি) মানে বিশ্বাস করা যে পৃথিবীতে সবকিছুর মধ্যে ভালো বলে একটা ব্যাপার আছে। যারা ইতিবাচক, শত দুঃখ-কষ্টেও তারা কৃতজ্ঞচিত্ত। আর যারা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে তারা সবকিছুতে খুত খুঁজে বের করে। হবে না, পারব না, হতাশা, হীনম্মন্যতা তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
একবার এক রাজার মনে হতে লাগল তার প্রজাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে এক সময় তার রাজ্য শেষ হয়ে যাবে। তার চিন্তাটি ঠিক কিনা দেখতে তিনি তার রাজ্যের লোকদের নিয়ে খুব ভোরে বাজারে ঢোকার রাস্তায় বড়সড় একটি পাথর রেখে নিরাপদ দূরত্ব থেকে অপেক্ষা করতে লাগল। সকালবেলা মানুষজন আসতে শুরু করল, কিন্তু তারা বাজারে প্রবেশ করতে পারল না। ব্যবসায়ীরা তার মালপত্র সমেত এসে পাথরটি দেখে সবাই ফিরে গেল। কিন্তু সরানোর চেষ্টা করল না। তারা অভিযোগ করতে করতেই গেল যে এ রাজ্যের রাজা এতটাই অবিবেচক যে পাথরটি সরানো ব্যবস্থা করছেন না। অথচ তাদের মধ্যে থেকে কেউ ব্যাপারটি রাজাকে জানানোর চিন্তাও করছে না। একটু পর রাজার একদল টহলদার সৈন্য বাজারে ঢোকার পথে পাথরটি দেখে তারাও ফিরে গেল আর বলতে লাগল, আজ কেউ বাজারে আসবে না তাই আমাদের টহলও দিতে হবে না। রাজা সবই দেখল ও হতাশ হলো। তার বিশ্বাসও দৃঢ়মূল হলো।
কিছুক্ষণ পর এক বৃদ্ধ সবজি ওয়ালা এলেন। তিনি পাথরটি দেখে কোনো অভিযোগ না করে সরাসরি গিয়ে ঠেলতে লাগলেন এবং বেশ কিছুক্ষণ ঠেলার পর পাথরটিকে তিনি পথ থেকে সরাতে পারলেন। যখন তার শাকসবজির বস্তা নিতে যাবেন তখন খেয়াল করলেন পাথরের নিচে একটা থলে। তিনি খুলে দেখলেন সেটি স্বর্ণমুদ্রায় পূর্ণ এবং একটি চিরকুটে লেখা আছে‘এই স্বর্ণমুদ্রাগুলি আপনার জন্যে রাজার পক্ষ থেকে পুরষ্কার স্বরূপ, কেননা আপনি জানেন বড় বাধা আপনাকে বড় সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাবে।
পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে, যারা সবসময় দায়িত্ব এড়াতে চায়। আর কিছু মানুষ আছে যারা দায়িত্ব গ্রহণ করতে চায়। এটিও এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি। চারপাশের সবাই যখন দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে লাগল যে কারণে তারা পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত হলো। আর বৃদ্ধ জানতেন,‘যতব ড় দায়িত্ব নেবেন তত বড় সুযোগ তার জন্যে তৈরি হবে। তাই সমস্যা সমাধানের জন্যে এগিয়ে গেলেন ও পুরষ্কৃত হলেন