সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ও দক্ষতা

সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ও দক্ষতা
সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ও দক্ষতা

যখনই আমরা কোন সমস্যায় পরি খুব অস্থির হয়ে যাই, দ্রুত সমাধান খুঁজি। সমাধানের জন্য পরিচিত-অপরিচিত মানুষের কাছে সাহায্য চাই। একই সাথে ভাবতে থাকি যা করছি ঠিক করছি তো, নতুন কোন ভুল করছি না তো! কারো কোনো সমস্যা হয়েছে শুনলেই চুলচেরা বিচার শুরু করে দেই। আলোচনা- সমালোচনা শুরু করি; আসলে দোষটা কার ছিল। যেন সমস্যা হওয়াটা খুব খারাপ ঘটনা, একটি অপরাধ! আমরা অনেকেই বলে থাকি “এতো ভেবে কি লাভ;যা হবার তাই হবে।” পরে আবার ফলাফল মনঃপূত নাহলে আফসোস করে বলি “ইশরে কেনো যে তখন একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে কাজটা করলাম না!” যারা খুব গুছিয়ে, পরিকল্পনা মাফিক সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের সফলতা দেখে বলে ফেলি “আমার কপালটা যদি ওর মত ভাল হত”। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি এই সফলতার পিছনে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার  রহস্যটা আসলে কি?
সমস্যা আসলে কি? একটি সমস্যা হল এমন পরিস্থিতি যা আমাদেরকে কোন কিছু অর্জন করা থেকে বাধা দেয়।  সমস্যা হলে অবশ্যই এটি সমাধানের উপায় বা “সমাধান” খুঁজে বের করতে হয়। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হই। জীবনের সাধারণ সমস্যা বা সংকটঃ সম্পর্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যা, বিবাহ বিচ্ছেদ, আঘাত, অসুস্থতা, স্বাস্থ্যগত সমস্যা, সন্তান লালন-পালনে সমস্যা, শোক, মৃত্যু, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, কর্মক্ষেত্রে সমস্যা, শারীরিক অক্ষমতা,দুঃখ,ক্ষতি এবং আত্মসম্মান সম্পর্কিত সমস্যার সাথে লড়াই করে জীবনযাপন করা বা এমনকি অজানা ভবিষ্যতের সাথে সমন্বয় করে চলা। সাধারণত মানুষ যখন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তিনটি কাজ করার প্রবণতা থাকেঃ
১। ভয় পায় বা অস্বস্তি বোধ করে এবং আশায় থাকে যে এটি নিজে নিজে দ্রুত দূর হয়ে যাবে
২। মনে করে যে তাদের একটি সমাধান বের করতে হবে এবং এটি সঠিক হতে হবে
৩। দোষারোপ করার জন্য কাউকে খুঁজে বের করে
সমস্যা সমাধান করতে সাধারণত যে কাজটি করি তা হল আমরা খুব দ্রুত সমাধান চাই। বারবার বলি, “এখন আমি কি করব”। আমরা হয়ত ভুলে যাই যে “সমাধান” হল একটি প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ কিন্তু আমরা তা প্রথমেই পেতে চাই। তাই ঠিক এখনই আমি কি করব এর উত্তর হতে পারে “আমি প্রথমেই নিজেকে শান্ত রাখব”।
যে কোন জটিল সমস্যা কিম্বা এমন পরিস্থিতি যা আমরা আগে কখনও মোকাবেলা করিনি তা সমাধানের জন্যও মানব মস্তিষ্কের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। গবেষকদের মতে এটি এমন একটি দক্ষতা যা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক করে। “স্ট্রাইটাম”, মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ মূলের “বেসল গ্যাংলিয়ার” অংশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাজ করে। মস্তিষ্কের সামনের কাছাকাছি “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” অন্যান্য সমস্যাগুলোর সাথে জটিল সমস্যা সমাধান করে। যখন সচেতনভাবে আমাদের সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা না করি তখনও কাজ করে। “ফ্রন্টাল লোব” শারীরিক চলাচল, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজের সমন্বয় করার কাজ করে; উচ্চতর জ্ঞানীয় দক্ষতা, যেমন সমস্যা সমাধান, চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা এবং পরিচালনা, ব্যক্তিত্ব এবং আবেগীয় দিকগুলোর কাজ করে।

জীবনের চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হতে কিছু কৌশলঃ

১।রাতের ঘুম
ঘুমন্ত বা জাগ্রত অবস্থার চেয়ে, র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট (REM) ঘুম সরাসরি মস্তিষ্কে সৃজনশীল প্রক্রিয়াকরণ বাড়ায়। সহযোগী নেটওয়ার্কগুলিকে উত্সাহিত করে। মস্তিষ্কে নতুন এবং দরকারী সংযোগ তৈরি করে যা জেগে উঠলে ঘটে। তাই শান্তিপূর্ণ রাতের ঘুম আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুমিকা রাখে।
২। জীবনকে নিখুঁতভাবে গ্রহণ করা
প্রায়শই আমরা জীবন থেকে দূরে সরে যাই।  আমাদের অবশ্যই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার দিকে নিজেকে আলোকিত করতে হবে। একসময় যা কষ্টসাধ্য ছিল, আমাদের আতঙ্কিত করেছিল তা হতে পারে এখন নিজেকে চেনা। অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের আরও আস্থাশীল, শক্তিশালী করে।  জীবনবোধের স্বাধীনতা হল খারাপের সাথে ভাল, কষ্টের সাথে বিস্ময়, বেদনার সাথে প্রেম এবং মৃত্যুর সাথে জীবন! যখন এই সমস্ত বিষয়গুলোকে মেনে নিতে পারি, তখন আমাদের কাছে জীবন উপভোগ্য। যখন বাস্তবতার কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করি তখন নিজেকে সর্বোচ্চ সুযোগ দিয়ে ঢেলে সাঁজাতে পারি।
৩। সময় নেয়া
কচ্ছপ এবং খরগোশের গল্পটি আমাদের সবারই জানা। কচ্ছপ ধীর এবং অবিচলিতভাবে দৌড় প্রতিযোগিতাটি জিতেছিল। তাড়াহুড়ো করে, আমরা আসলে সফলতা থেকে আরও দূরে সরে যাই। সহজ এবং সংক্ষেপ উপায় খুঁজতে গিয়ে আরও ভুল করি। পুরানো প্রবাদে আছে, “যত ধীরে, শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে যান, তত তাড়াতাড়ি সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যান”। এ ধরণের পদ্ধতি স্থায়ী পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত হওয়ার সর্বোত্তম উপায়।
৪। কৃতজ্ঞতা অনুশীলন করা
আশীর্বাদের চেয়ে সমস্যার সংখ্যাই তুলনামূলক কম। আমাদের জীবনের অফুরন্ত আশীর্বাদগুলোর জন্য আমরা প্রকৃতপক্ষে কতটুকু কৃতজ্ঞ হই? বারবার সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলি। মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন জীবনে ভীষণ পরিবর্তন আনতে পারে। ভাল কাজ খুঁজে বের করা এবং কৃতজ্ঞতার সাথে তা গ্রহণ করা মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য এক যাদুকরি উপায়।
৫। সকল অনুভূতির (এমনকি বেদনাদায়কও) সাথে থাকা
প্রায়শই আমরা আমাদের অনুভূতিগুলোকে ভীতিকর, ভারী এবং বিভ্রান্তি মনে করি। তবে জীবনে সন্তুষ্টি, অর্থ-সম্পদ এবং আনন্দ খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাদের অনুভূতিগুলো দরকার। অনুভূতি থেকে মুক্তি পাওয়া কেবল ব্যাকফায়ারই নয় এটি আমাদের মনস্তাত্ত্বিক শক্তি থেকেও সরিয়ে দেয়। অনুভূতি হল আমাদের ব্যক্তিত্বের ইঞ্জিনের গ্যাস। প্রেরণার উত্স। এগুলো হল শক্তি, প্রাণশক্তি, জীবনের রস। এগুলো ছাড়া আমাদের জীবনে কোনও ব্যক্তিত্ব, মাত্রা বা রঙ থাকবে না। কোনও আনন্দ, সৃজনশীলতা, বা মজা থাকবে না। আপনি, আমি আলাদা করে আমরা কেউই আমাদের অনুভূতি ছাড়া কিছুই নই।
৬। জীবন যাত্রার অংশ হিসাবে সাফল্য এবং ব্যর্থতা গ্রহণ করা
আমরা সবাই শিখছিঃ সহানুভূতিশীল মনোভাব, জীবনের গতিশীল প্রক্রিয়া- চেষ্টা করা, সফল হওয়া, ব্যর্থ হওয়া এবং পুনরায় চেষ্টা করা নিজের মধ্যে স্থায়ী আস্থা অর্জনের একমাত্র উপায়। আমরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখি যেখানে সফল এবং ব্যর্থ উভয়ই হতে পারি। তবে জীবনে সবসময়ই অন্যের সহায়তা ও সমর্থন প্রয়োজন।
৭। সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ থাকা
সম্পর্কগুলো এমনি এমনি যাদুর মত হুট করে হয়ে যায় না। মনোযোগ, যত্ন এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা বেড়ে ওঠে এবং টিকে থাকে। বিবাহ, পরিবার বা বন্ধুত্ব হল গতিশীল, জীবন্ত অভিজ্ঞতা। প্রতিদিন একটু একটু করে উপার্জন করতে হয়, যার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার প্রয়োজন। দূরত্ব অতিক্রম এবং সম্পর্ককে সম্মান করা একটি দৈনিক প্রক্রিয়া। আমরা কখনও একে অপরকে আঘাত করব এবং একে অপরের দ্বারা আহত হব এই বাস্তবতাটি গ্রহণ করতে হবে। এই ব্যথা এড়ানো যায় না। আমরা কেবল মেরামত করতে পারি, সংশোধন করতে পারি, নিজেকে নিবেদিত করতে পারি। নিজেদের ভুলগুলির দায় গ্রহণ করি, দুঃখিত হই। নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করি। ক্ষমা করতে শিখি; অন্যের ক্ষমা গ্রহণ করি। আমরা নীচে পড়ি, নীচে পড়ে আবার উঠি। আর এটাই হল সম্পর্কের বন্ধন।

সর্বোত্তম সমাধান কীভাবে পাওয়া যায় তা আমরা নিশ্চিত নই এবং এটি একেক জনের কাছে একেক রকম। আমরা দ্বন্দ্ব মোকাবেলায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা। মনে হয় যে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কয়েকটি ধাপ মেনে চলতে চেষ্টা করবঃ

১। সমস্যা চিহ্নিতকরণঃ প্রধান সমস্যা কোনটি তা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকলে প্রকৃত সমস্যা সম্পর্কিত বিষয়গুলো চিহ্নিত করা সহজ হয়। অনেক সময় দেখা যায় আশেপাশের সমস্যা নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকি। বুঝতে পারিনা যে মূল সমস্যাটি সমাধান হলে অনেকটাই স্বস্তি।
২। অনর্থক আলোচনা এড়িয়ে চলাঃ একেক জনের মতামত, দৃষ্টিভঙ্গী এবং চিন্তাধারা একেক রকম। তাই  সহানুভূতিশীল এবং ইতিবাচক ব্যক্তির সাথে সমস্যা নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। একই সাথে সবার মতামত গ্রহণ করলে আরো নতুন দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে।
৩। বিকল্প সমাধান বিশ্লেষণঃ সম্ভাব্য বিকল্প সমাধানগুলো তালিকাভুক্ত করতে হবে। প্রতিটি উপায় কে আলাদা করে ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং বিশ্লেষণ করাই শ্রেয়। উপায়গুলোর সাথে জড়িত ব্যক্তি, স্থান কিম্বা প্রয়োজনে অর্থায়নের উৎস চিহ্নিত করতে হবে।
৪। সুবিধা এবং অসুবিধাঃ প্রতিটি বিকল্প সমাধানের সুবিধা এবং অসুবিধা নিয়ে ভাবতে হবে। সেরা উপায়টি কী হতে পারে এবং কেন তা সেরা তা নিয়ে ভাবতে হবে। অবশ্যই যেখানে অসুবিধা কম সেই উপায়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৫। লিখিত ডকুমেন্টেশনঃ সব সময় স্মৃতির উপর ভরসা না করাই শ্রেয়। উপায়গুলোর বিবরণ ও প্রভাব লিখিত আকারে থাকলে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। এটি ভবিষ্যতের কোন পরিকল্পনায়ও কাজে লাগতে পারে।
৬। ব্যর্থ হলে পুনরায় ভাবতে হবেঃ  সবসময় পরিকল্পনা মাফিক সমাধান নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথম ধাপে ফিরে যেতে হবে। জরুরী অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন করতে হবে। বিকল্প উপায় নির্বাচন করতে সমস্যা হলে, পুনরায় সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে ভাবতে হবে।
৭। নির্দিষ্ট সময়সীমাঃ সমস্যা নিয়ে অনন্তকাল বসে থাকলে চলবে না। সমাধান পরিকল্পনার একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। সমস্যার ধরণ অনুযায়ী হতে পারে সেটি একদিন,একমাস, দশবছর কিংবা তারচেয়ে বেশী।
পরিশেষে মানুষ জন্মগতভাবে সমস্যা সমাধানকারী। সমস্যা এবং দ্বন্দ্ব জীবনে প্রায় সর্বদা ঘটে থাকে। তত্ক্ষণাত সমাধান করার প্রবণতাটি অতিক্রম করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য প্রয়োজনে মনোবিজ্ঞানী এবং মনোচিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করার মানসিকতা রাখা জরুরী। তবে কিছু কিছু সমস্যা থাকবেই যার কোন সমাধান নেই, তা নিয়ে বারবার ভেবে সময় নষ্ট না করে এগিয়ে যেতেই হবে; আর এটাই হতে পারে সফলতার গোপন রহস্য।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন

Previous articleইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই পারে হতাশা এবং বিষণ্ণতা দূর করতে: বুশরা শাহরিয়ার
Next articleকোভিড ১৯ এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির সভা অনুষ্ঠিত
ফারজানা ফাতেমা (রুমী)
Psychologist, Bangladesh Early Adversity Neuro imaging Study, icddr, b. Mental Health First Aider, Psycho-Social counselor. BSC & MS in Psychology, University of Dhaka; Masters in Public Health, State university of Bangladesh.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here