শিশু ও বয়ঃসন্ধিদের অবসাদ এবং উদ্বেগঃ পর্ব-৩

0
33
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সন্তানকে সচেতন করার কৌশল
অভিভাবক হিসেবে একটা শিশুর অবসাদ বা উদ্বেগের সমস্যা বুঝতে কারোর অসুবিধা হতেই পারে। বাচ্চার অসুস্থতার জন্য অভিভাবকরা খুবই চিন্তায় পড়তে পারেন ও নিজেদের দোষী বলেও ভাবতে পারেন। পরিচর্যাকারী হিসেবে একজন তখনই তার সন্তানের ভালো করে দেখভাল করতে পারবে যখন সে অসুখ সম্পর্কে ঠিকঠাক ধারণা করবে। এজন্য অসুখ সম্বন্ধে অভিভাবকদের মনের সব সন্দেহ দূর করার জন্য চাই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের সঙ্গে কথা বলা। সেই সঙ্গে বাচ্চা যাতে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয় সেজন্য অবিলম্বে চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে।
বাচ্চাদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের পর্যাপ্ত সময় কাটানো এক্ষেত্রে একান্ত জরুরি। অভিভাবকদের ক্ষেত্রে বাচ্চাদের লক্ষণগুলোকে ছোট করে দেখা উচিত নয়, তাদের আচরণের সমালোচনা ও অন্যদের আচরণের সঙ্গে তুলনা করা একেবারেই অনুচিত। সমস্যাগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে ও ধৈর্য ধরে শুনতে হবে।
বাচ্চাদের মধ্যে যদি অবসাদ বা উদ্বেগের সমস্যা খুব গভীর হয়ে দেখা দেয় তখন তাদের মাথায় আত্মহত্যার চিন্তাও আসতে পারে। সেক্ষেত্রে অভিভাবকদের একজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে ও তাঁর কথা মতো বাচ্চার নিরাপত্তার দিকটি সুনিশ্চিত করতে হবে। যদি অভিভাবকরা দিশাহারা বোধ করেন তাহলে কাউন্সেলরের সাহায্য অবশ্যই দরকার।

যদি দেখা যায় যে উদ্বেগ বা অবসাদের কারণে ক্লান্ত বা দিশাহারা বোধ হচ্ছে তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এই কারণে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিপর্যয়মূলক চিন্তাভাবনা আসতে পারে ও তারা দিশাহারা এবং মনমরা হয়ে থাকতে পারে।
যদি এরকম লক্ষণ দেখা যায় তাহলে তখনই একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি। বিশ্বাসভাজন কোনও বয়স্ক মানুষকে নিজের সমস্যার কথা জানানো দরকার। একবার মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে পরিকল্পনামাফিক চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হয়।
যদি মনে বিপর্যয়মূলক চিন্তাভাবনা হয় তাহলে মনকে তা থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করতে হবে। সেজন্য আঁকা, খেলাধূলা, গান শোনা, বই পড়ার সঙ্গে ঠিকঠাক ওষুধ খাওয়া ও যোগচর্চা করা খুবই উপকারী। এ বিষয়ে কোন কৌশল অবলম্বন করলে  তা যথাযথ হবে, তা নিয়ে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
এই অবস্থায় একজন কাছের মানুষের সাহায্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়। তাদের কাছে নিজের অনুভূতির কথা বলতে হবে ও সঠিক সাহায্য চাইতে হবে।

স্কুলে বরাবর খুব ভাল ফল করা আর্শিয়ার মধ্যে সবসময়ে ক্লাসে প্রথম হওয়ার চাপ থাকত। স্কুলের শেষ বছরে সে ক্রমশ পড়াশোনা নিয়ে অধীর হয়ে উঠছিল। তার সবসময়ে মনে হচ্ছিল যে সে কি বোর্ডের পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারবে? নিজের পছন্দমতো কলেজে কি ভর্তি হতে পারবে? তার চিন্তা হচ্ছিল যে যদি কোনও কারণে সে পরীক্ষায় খারাপ ফল করে তাহলে কী হবে?
এসব কারণে আর্শিয়া খুব মনমরা হয়ে থাকত এবং মাঝে মাঝে তার মাথায় আত্মহত্যা করার চিন্তা আসত। কিছুতেই সে তার লেখাপড়ার দিকে মন দিতে পারত না। সবসময়ে অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করত ও মাথায় ব্যথা অনুভব করত।
যখন আর্শিয়ার বাবা-মা এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করতে শুরু করলেন তখন একজন কাউন্সেলর তাদের বোঝাতে সাহায্য করলেন যে আর্শিয়ার নিজের স্বত্তার মধ্যে পড়াশোনায় অসাধারণ হওয়ার চিন্তা একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে। বোর্ডের পরীক্ষায় সবচেয়ে সেরা হওয়ার নেশা তাকে পেয়ে বসেছে। যদি সে কোনও কারণে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারে তাহলে কী হতে পারে, সেই বাস্তবটা দেখার কোন চেষ্টাই করছিল না আর্শিয়া। এই কারণে কয়েক মাসের জন্য আর্শিয়ার মনে উদ্বেগ ও অবসাদের জন্ম হয়েছিল।
সাধারণ মানুষের মনে একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে অল্পবয়সি ছেলে-মেয়ে এবং বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েরা নিজেদের গভীর অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। আর তাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা, যেমন- অবসাদ ও উদ্বেগের জন্ম হতেও  পারে না।
বাস্তব চিত্র: সাত বছরের নীচে থাকা শিশুদের মধ্যে অন্ততপক্ষে চার শতাংশের ক্ষেত্রে শৈশবকালীন মানসিক অবসাদ বা উৎকণ্ঠার জন্ম হয়।
আট বছর বা তার বেশি বয়সের বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে প্রায় ৯ শতাংশের ক্ষেত্রে অবসাদজনিত সমস্যা দেখা দেয়। পূর্ণবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও প্রায় এই হারেই এমন মানসিক অসুখ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এই ধরনের মানসিক সমস্যার চিকিৎসা না হলে তা ক্রমে লাগাতার মানসিক অসুখে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। শৈশবে হওয়া অসুখ বয়ঃসন্ধি বা বড়  বয়সেও তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে। তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসা একজন বাচ্চাকে তার সমস্যা কাটিয়ে সুস্থ হতে সাহায্য করে।
একজন শিশু যখন আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে তখন তার মধ্যে দুঃখ, মনমরা ভাব এবং নানারকম আবেগ দেখা দিতে পারে। কিছু বাচ্চার ক্ষেত্রে এই ধরনের বোধগুলো অনেক সময় ধরে স্থায়ী হয় এবং তাদের অনুভূতি ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর তার প্রভাব পড়ে।
শিশু এবং বয়ঃসন্ধিদের মধ্যে মানসিক অবসাদ এবং উদ্বেগ খুবই বাস্তব একটা সমস্যা। সেই সঙ্গে প্রায়শই এই সমস্যা দুটোর সহাবস্থান ঘটে। একজন বাচ্চার চিন্তা, বোধ, আচরণ তথা তার সমগ্র জীবনযাপনের মধ্যে অবসাদ ও উদ্বেগজনিত সমস্যার প্রভাব পড়তে দেখা যায়।
Previous articleদাম্পত্যজীবনে সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব
Next articleআসক্তি মুক্ত হওয়ার উপায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here