দাম্পত্যজীবনে সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব

0
452

প্রযুক্তির এক বড় উপহার বর্তমানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। এটি এখন আমাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। বৃহৎ থেকে বৃহত্তর দূরত্ব এই মাধ্যমে কমে আসছে নিমিষেই! দূরে থাকা আপনজনকে দেখতে পাওয়ার জন্য আছে মেসেঞ্জারে ভিডিও কল, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার কিংবা স্কাইপ। অনবরত চ্যাটিংয়ের জন্যও রয়েছে জানা-অজানা আরও অনেক যোগাযোগ মাধ্যম
যারা পরিবার ছেড়ে কাজের বা পড়াশোনার জন্য দূরে থাকছেন, তাদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা একরকম অক্সিজেনের মতোই প্রয়োজনীয়। দিন শেষে একবার স্বজনদের দেখতে পাবার জন্য বা তাদের খোঁজ নেবার জন্য এছাড়া আর যে কোনো উপায়ই নেই।
কিন্তু এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কি কেবলই আশীর্বাদ, নাকি এর সাথেও জড়িয়ে আছে কোনো অপকারিতা? এর ফলে আমাদের অজান্তেই কি কোনো খারাপ প্রভাব পড়ছে? দাম্পত্যজীবনের মতো অনুভূতিপ্রবণ সম্পর্কে এর প্রভাবই বা কতখানি? এ নিয়েই থাকছে পাঠকদের জন্য আমাদের আজকের এই আয়োজন।
দাম্পত্যজীবনে খুবই সাধারণ কিছু সমস্যা হলো অপর্যাপ্ত সময়, বন্ধুবান্ধবকে সময় দেয়া, অফিসের কাজ বাসায় নিয়ে আসা ইত্যাদি। এমন নাজুক একটি সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বিভিন্নভাবে আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। চলুন দেখা যাক সাধারণ কিছু অভিযোগ।
“তুমি ফেসবুকে অনেক বেশি সময় কাটাও”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফেসবুক। সারাদিন ক্লাস, কাজ বা অফিসের ফাঁকে, ঘুমাতে যাবার আগে অথবা ঘুম থেকে উঠেও কখনও প্রথম কাজটাই হয় নিউজফিড একবার চেক করে দেখা। ‘Computer in Human Behavior’ এর একটি  গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ডিভোর্সের সাথে ফেসবুকের বেশ নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ২.১৮%-৪.৩২% বিয়েতে ছাড়াছাড়ি হবার পিছনে ফেসবুকের অত্যধিক ব্যবহারই দায়ী। এ গবেষণায় আরও উঠে এসেছে যে, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন, তারা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দম্পতির চেয়ে ১১% বেশি সুখী হয়ে থাকেন।
সন্দেহ, ঈর্ষা, লুকোচুরি
অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দাম্পত্য জীবনে সন্দেহের হার বাড়ায়। লুকিয়ে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ফোন চেক করা, মেসেজ চেক করা, এমনকি অফিসিয়াল মেইলগুলো চেক করার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। অনেক দম্পতিই একজন আরেকজনের সাথে মন খুলে কথা বলতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে তারা একাই এই বিষয়গুলো নিয়ে ভুক্তভোগী হন।
কেউ কেউ বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে থাকেন। সবসময় পরামর্শের ফলাফল ভালো হয় না। তাই অনেক দম্পতিই টিকে থাকতে পারেন না অথবা শুধুমাত্র সামাজিকতা রক্ষার খাতিরে একসঙ্গে অসুখী হয়েও বসবাস করে থাকেন।
অস্বচ্ছতা
দুর্ভাগ্যবশত অনেকেই তার সঙ্গী বা সঙ্গিনীর কাছে খুব কাছের বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু বা বান্ধবীর কথা গোপন করে যান। যেকোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা যোগাযোগ রাখলেও মেসেজ বা ফোনকল এর লিস্ট বাসায় পৌঁছানোর আগেই মুছে ফেলেন। কখনও হঠাৎ করেই সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সামনে বেজে ওঠে মুঠোফোন এবং ভেসে ওঠে অনাকাঙ্ক্ষিত নামটি। এটা নিয়েই এককথা- দু’কথায় পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। অথচ হয়ত তারা শুধু খুব ভালো বন্ধুই ছিলেন। এমন একটা সম্পর্কের কারণেও ভেঙ্গে যায় সংসার অথবা প্রশ্ন ওঠে যেকোনো একজনকে বেছে নেয়ার।
স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাঘাত
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার অনেকের কাছে এখন অন্যান্য কাজের চেয়েও জরুরি হয়ে পড়েছে। এক দুই মিনিট পর পর ফেসবুকের নিউজফিড চেক করা, ইন্সট্রাগ্রামে আপলোড করার জন্য রোজ ছবি তোলা, ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করা, এমনকি পত্রিকা পড়ে খোঁজ নেয়ার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো খবর নেয়াটা বেশি বিশ্বাসযোগ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয়।
এই বিষয়গুলো অপরজনের কাছে কোনোভাবেই কাম্য নয়। বারবার এভাবে কারণে-অকারণে ফোনের কাছে ছুটে যাওয়াটা দৃষ্টিকটু এবং সন্দেহজনক হওয়াটাই স্বাভাবিক। অনেকেই রাত জেগে ফেসবুক, টুইটার, স্কাইপে বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের সাথে যোগাযোগ করে থাকেন। এই ব্যাপারটি যখন কোনো একটা সময় সঙ্গী বা সঙ্গিনীর চোখে পড়ে তখন তার সাথে সম্পর্ক ভালো রাখতে পাসওয়ার্ডের মতো ব্যক্তিগত জিনিস তার হাতে তুলে দেয়া ছাড়া আর কোনো গতি থাকে না।
এরপরেও ঘটনা শেষ হয় না। যখনই মনে একটু সন্দেহ উঁকি দেয় তখন অপরজনের ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা ভাইবারে একটা ঢুঁ মেরে আসাই হয়ে যায় নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। এসবের ভিড়ে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়।

ছোটোখাট আরও কিছু সমস্যা
“ও তোমার ছবিতে লাইক দিলো কেন?”, “এই মেয়েটা ইদানিং তোমার সাথে এত চ্যাট করছে কেন?”, “ শুধুমাত্র ফেসবুকে বন্ধু হয়েও ও কেমন করে তোমার ফোন নম্বর জানলো?”– এসব প্রশ্ন আজকাল খুব বেশিই শোনা যায়। এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হননি এমন একজন স্বামী বা স্ত্রী এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না।
অনেক সময় সাধারণ কোনো ঝগড়ার ডালপালাও গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ায় এবং এমন এমন কিছু কারণ উঠে আসে যা হয়ত আপনি কখন ভাবেননি। এসব কারণে তিক্ততার সৃষ্টি হয় অনেক বেশি। একপক্ষ হয়ত ভাবছেন এটুকু বিষয় নিয়ে কেমন করে এতগুলো কথা আপনাকে শুনতে হলো, আবার অপরপক্ষ ভাবেন কিভাবে আপনি তার সাথে এমনটি করতে পারলেন। যার যার জায়গায় নিজেকে সঠিক মনে করে সৃষ্টি হয় অসমাধানযোগ্য সমস্যার।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সত্যিকার অর্থেই আমাদের জীবন আরও সহজ করে তুলেছে। কিন্তু এই মাধ্যম যখন আমাদের বাস্তব জীবন থেকেও বেশি গুরুত্ব পায় তখনই শুরু হয় ঝামেলা। কিছু বাড়তি অভ্যাস আপনাকে এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে।

  • গল্পের বই পড়ুন। বই পড়লে সাধারণত সামাজিক মাধ্যমের দিকে ঝোঁক কমে আসে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় সঙ্গী বা সঙ্গিনীর কিছুটা মন খারাপ হলেও আপনার পুরানো বদভ্যাস থেকে সরে আসতে দেখে অবশ্যই তার কষ্ট ম্লান হয়ে যাবে।
  • ফোনে এলার্ম দিন। প্রাথমিক অবস্থায় এক ঘণ্টা করে এলার্ম দিতে পারেন। মনে মনে ঠিক করুন এলার্ম না বেজে ওঠা পর্যন্ত আপনি কোনোমতেই মুঠোফোনের কাছে যাবেন না।
  • গান শুনুন। একটানা কাজ করলে শরীর এবং মন দুটিই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন বিরতি হিসেবে ফেসবুক স্ক্রল না করে একটা পছন্দমত গান শুনে ফেলুন।
  • সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যখন আপনার সমস্যা তখন ফোনের মাধ্যমেই আপনার সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব। অবাক হচ্ছেন? এখন কিছু অ্যাপ এসেছে যেগুলো আপনাকে নির্দেশনা দিয়ে আপনার আসক্তি কমিয়ে আনবে প্রায় শূন্যে। এমনই কিছু অ্যাপ হলো Forest (Android, iOS, Windows), Checky (Android, iOS), Unplug (2$, iOS), Onward ইত্যাদি। এগুলো আপনাকে সময় বেঁধে দিয়ে বা মজার মজার কুইজ এবং ধাঁধা দিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে এমনভাবে ব্যস্ত করে ফেলে যে আপনি আপনার ফোন ধরার চেষ্টাও করবেন না।

আমাদের জীবনে যখন প্রযুক্তি ছিলো না তখনও আমাদের পাশে আমাদের পরিবার ছিল। “মানুষ সামাজিক জীব” কথাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ে নয়, বরং বাস্তবিক অর্থে প্রয়োগের মাধ্যমেই সত্যি হয়ে উঠুক।

Previous articleমানসিকভাবে শক্তিশালী নারীরা যেসব কাজ করে না
Next articleশিশু ও বয়ঃসন্ধিদের অবসাদ এবং উদ্বেগঃ পর্ব-৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here