শিশুর মানসিক বিকাশে পরিবেশ সরাসরি জড়িত

শিশুর মানসিক বিকাশে পরিবেশ সরাসরি জড়িত
শিশুর মানসিক বিকাশে পরিবেশ সরাসরি জড়িত

প্রাকৃতিক পরিবেশ একটি শিশুর সাধারণ শিক্ষা, বেড়ে ওঠা ও গতিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে উপযুক্ততার উদ্দীপক উপাদান হিসেবে কাজ করে। ঢালু পর্বতময় পরিবেশ শিশুকে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা জয়ের সামর্থ্য যোগায়, গাছ-গাছালি প্রাকৃতিক আশ্রয় দেয়, তৃণভূমিতে শিশু দৌড়-ঝাঁপ করে আর গড়াগড়ি দেয়।
প্রাকৃতিক পরিবেশের চিত্র অঙ্কনে সাধারণত এর স্বরূপ ও স্বাভাবিক ক্রিয়া উভয়ের প্রতিই দৃষ্টিপাত করা হয়। কিন্তু সমাজ বিজ্ঞানী হেফট ১৯৮৮ সালে পরিবেশের সঙ্গে শিশুর সম্পর্কের বর্ণনায় এর স্বাভাবিক ক্রিয়ার প্রতিই গুরুত্বারোপ করেছেন। শিশু স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তার প্রাকৃতিক পরিবেশকে খেলাধুলা, আর প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র ভাবে, সে তার ভূ-চিত্রের কাজ অনুধাবন করে চলতে সচেষ্ট হয়।
এতসব কিছু পর্যবেক্ষণ করেই সমাজ বিজ্ঞানী গিবসন পরবর্তীতে প্রাকৃিতক পরিবেশের ভিন্নতায় ও সাদৃশ্যে শিশুর মনে কী কী বোধগম্যতার পরিবর্তন হতে পারে তা নিয়ে কাজ করেছেন। উদাহারণস্বরূপ বলা যেতে পারে, একটি শিলাখন্ড যদি এমন বড়ো হয় যে তা হাতে আঁকড়ে ধরে রাখতে কষ্ট হয় তাহলে শিশু উপলব্ধি করবে যে হয় এটি ধরে রাখতে হবে নয় তো ছুুড়ে ফেলে দিতে হবে। সুতরাং এর দ্বারা শিশু পরিবেশের নানা সঙ্গতি বা অসঙ্গতি অর্থাৎ আঁকড়ে ধরবে নাকি ছুড়ে ফেলবে তা হৃদয়াঙ্গম করতে পারে।
পরিবেশের ভিন্নতা ও শিশুমন
আমাদের পরিবেশ আমাদের কাছে বহুমূল্যবান। একটি মা পাখি ঠিক যেভাবে তার ছানাদের রক্ষা করে তেমনি আমাদেরও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশকে রক্ষা করা কর্তব্য। জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশেরও পরিবর্তন হয়। এর ফলে রোগের বোঝা বাড়ার নজির দিন দিন বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে ডায়রিয়া এবং ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রামক রোগ বিশ্বব্যাপী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিষণ্ণতা, আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষকগণ যদিও এই বয়সে বিষণ্ণতার কারণ নির্ণয়ে বংশগতি, দরিদ্রতা ও জীবনের মন্দ ঘটনাকে এগিয়ে রাখবেন কিন্তু পরিবর্তিত প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুত্ব এতে কোনো অংশে কম নয়। শুধু এর বিরূপ ও ক্ষতিকর প্রভাব এখনো তুলনামূলকভাবে অবিশ্লেষিত। গত তিন দশক ধরে বৈশ্বিক উষ্ণতা ০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বেড়েই চলছে, যার ফলে গ্রহপ্রভাবজনিত ও পরিবেশগত কারণে সকলের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য আজ হুমকির মুখে। তাই শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যার তীব্রতা নির্ধারণে আবহাওয়াকেন্দ্রিকতা পরিবর্তনশীলতার মূল্যায়ন এখন অপরিহার্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, তীব্র ঝড়, বন্যা উপকূলবর্তী এলাকার ক্ষয়সাধন এবং বিপর্যস্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামো মানসিক স্বাস্থ্যের পরিবর্তনের সত্যতাকে জোরালোভাবে সমর্থন করে। এই কাঠামোর ভেতর উন্নয়শীল দেশগুলোয় শিশুকিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
শিশুর মানসিক বিকাশ ও আচার-আচরণে পরিবেশের ভিন্নতার প্রভাব
চলমান জলবায়ু পরিবর্তন মাটির গুণাগুণ ও কৃষি সম্পদ নষ্ট করে, বাহ্যিক ক্রিয়া ধ্বংস হয়, খাদ্যের প্রতুলতা ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে যা দরিদ্রতা, অপুিষ্ট ও রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়। এর প্রতিটি উপাদান শিশু মনে বিষণ্ণতার ঝুঁঁকি হিসেবে কাজ করে।

  • পরিবর্তিত জলবায়ু বিদ্যমান মানসিক দুর্বলতাকে প্রকাশ করে। প্রাণোচ্ছলতার অভাবে পরিবর্তিত বিরূপ পরিবেশে শিশু মানিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়। চরম দুর্দশাপূর্ণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়।
  • বলা চলে শিশু ও কিশোররাই তাদের নাজুক চাপ মোকাবেলার কৌশলের ফলে অতি সহজেই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়।
  • বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃৃৃদ্ধির সঙ্গে মানসিক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীর সেবা কার্যক্রমের পারস্পরিক সম্পর্ক আছে। গ্রীষ্মের মাসগুলোতে কিছু কিছু মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব অন্যান্য সময়ের তুলনায় শতকরা ৫-১০ ভাগ বৃদ্ধি পায়।
  • বিজ্ঞানীরা আরো দেখিয়েছেন যে, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও অত্যধিক জলীয় বাষ্প মানসিক দৈন্যতা বৃদ্ধি করে।
  • অল্প কয়েকজন গবেষকই শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তনের সম্পর্ক দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন।
  • বিজ্ঞানী নরিস ও তার সহকর্মীবৃন্দ নিকারাগুয়ান শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৯৯৮ সালের হ্যারিকেন ‘মিচ’ এর পরে একটি জরিপে দেখান যে, তাদের মধ্যে বিষণ্ণতার ও পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের তীব্রতা ছিল অত্যধিক। পিতা-মাতা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মৃত্যু বা শারীরিক বিকলাঙ্গতা এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

সুস্থ পরিবেশে শিশুর মানসিক বিকাশ
গর্ভাবস্থায় মায়ের বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থানের কারণেও গর্ভস্থ শিশু পরবর্তীতে আবেগীয় অস্থিতিশীলতা, স্নায়বিক ও জ্ঞানীয় দুর্বলতায় ভুগতে পারে। ফলে গর্ভবতীর জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

  • প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশুর বাতাস গ্রহণ ও পানি নির্গমনের হার বেশি, তারা বেশি সময় ঘরের বাইরে থাকে। ফলে সে সংক্রামক রোগ ও পরিবেশ দরূষণের শিকারও বেশি হয়। এ লক্ষ্যে খেলার জায়গাকে দূষণমুক্ত রাখা অতীব জরুরি, খেলার মাঠের পাশে ইট, সিমেন্ট, সুরকি ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
  • পরিবারের সদস্যদের ধমূপান থেকে বিরত থাকতে হবে। শিশুর সম্মুেখ ধূমপান অক্রিয়ভাবে শিশুর মস্তিষ্ক ও শ্বাসযন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
  • নীতিনির্ধারকগণের সামাজিক কাঠামো মজবতু করার বিভিন্ন পন্থা শনাক্ত করে পরিবর্তিত জলবায়ু ও প্রাকৃিতক পরিবেশে শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা বা অন্য যেকোন ধরনের দায়  সর্ম্পূণই লেখকের।

Previous articleদর্শকশূন্য মাঠে খেলার জন্য মনোবিদের কাছে স্টুয়ার্ট ব্রড
Next articleঅভ্যাস কী বদলানো সম্ভব?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here