লেখক লেখকই, লেখকের কোনো জেন্ডার নেইঃ সেলিনা হোসেন

উৎস থেকে নিরন্তর; সচল তাঁর লেখনী। বর্ণময় সাহিত্যজীবন। অর্জনের মুকুেট সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক স্বাধীনতা পুরস্কার। আগেই পেয়েছিলেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ আরো অনেক পুরস্কার। তিনি সেলিনা হোসেন। বাংলা সাহিত্যের অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক। মনের খবরএর পক্ষ থেকে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন সাদিকা রুমন
আপনার কোন বৈশিষ্ট্যটির জন্য আপনি আজকের সেলিনা হোসেন?
আমার শৈশব-কৈশোর ছিল অসাধারণ। কারণ এই শৈশব-কৈশোরে আমরা আব্বার চাকরিসূত্রে গন্ডগ্রাম নামে একটা জায়গায় ছিলাম। সেই পঞ্চাশের দশকের কথা বলছি। আমার তো সাতচল্লিশ-এ জন্ম, তার ছয়সাত বছর পরে অর্থাৎ তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন সালের দিকে আমার দুটো জিনিস দেখার সুযোগ হয়েছিল; আমি অবাধ প্রকৃতি দেখেছি− মাঠ-ঘাট-পথ-প্রান্তর-নদীগাছপালা; গাছে উঠে পাখির ডিম ভাঙা, মাছ ধরতে নামা−এইসব। একটা দুরন্ত শৈশব ছিল আমার। আরেকটা দিক ছিল; সেই সময়ে আমি মানুষ দেখেছি, যেই মানুষগুলো খুবই হতদরিদ্র, গণমানুষ, যাদের অভাব ছিল প্রবল। যাদের সামনে শিক্ষা ছিল না। স্বাস্থ্যের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এইসব মানুষদের দেখে আমি দরিদ্র জনজীবন বুঝতে শিখেছিলাম। এই দুটো বিষয় আমার মাথায় গেঁথে ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার মাথার ভেতরে কাজ করে যে, আমার অভিজ্ঞতার এই সঞ্চয় দিয়ে আমি গল্প-উপন্যাস লিখতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমি শুধুই গল্প লিখেছিলাম, উপন্যাস ধরিনি তখনো। সেই গল্প নিয়ে আমার একটি বই বেরিয়েছিল ১৯৬৯ সালে− উৎস থেকে নিরন্তর। আমি লেখক হবো ভেবে এই বইটি প্রকাশ করিনি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল হাফিজ বলেছিলেন, ‘তোমাকে তো চাকরি করতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অর্থনৈতিক শক্তির যোগান দিতে হবে। সুতরাং যে গল্পগুলো বেরিয়েছে সেগুলো নিয়ে একটা বই বের করো, তাহলে সিভিতে একটা কিছু যোগ হবে। অন্য ছেলেমেয়েরদের থেকে তুমি এগিয়ে থাকবে।’ তখন আমি বললাম, ‘স্যার, আমার বই কে করবে? আমি তো একজন নতুন লেখক।’ স্যার বললেন, ‘কেউ করবে না। তুমি তোমার বাবার কাছে যাও, টাকা আনো। আমি বই প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেবো।’ তখন আমি গিয়ে আমার মাকে বললাম। মা বললেন, ‘ঠিক আছে। এ জন্য যদি তোমার চাকরি হয়, আমরা তোমাকে টাকা দেব।’ বাবাও রাজি, বললেন, ‘ঠিক আছে। বই করার জন্যে যা খরচ হয়, আমরা তোমাকে দেব, তুমি বইটা বের করো।’ এবং ১৯৭০ সালে ঢাকায় আমি পাবলিক সার্ভিস কমিশনে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিই। ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। আমি তো কখনো ঢাকায় থাকিনি, অচেনাঅজানা শহর, আমি কাউকে চিনতামও না। স্যার তখন বললেন, ‘তোমার কি এই বইটা? উৎস থেকে নিরন্তর?’ আমি বললাম, ‘জ্বী, স্যার।’ স্যার বললেন, ‘ভালোই তো লিখেছ।’ ইন্টারভিউ বোর্ডে এই ছিল আমার যোগ্যতার একটি জায়গা। আর বাংলা একাডেমিতে আমি যখন চাকরির ইন্টারভিউ দিলাম ওই বইটিই আমার সামনে বড় শক্তির জায়গা হয়ে দাঁড়ালো। আমার বাংলা একাডেমির চাকরিও হলো। দুটো চাকরিই আমার একসাথে হলো, একটি বইয়ের জন্য।
তখনই কি মনস্থির করেন যে আপনাকে লেখকই হতে হবে?
সেটা তো ছিলই। তারপর আমি যখন যোগদান করলাম বাংলা একাডেমিতে, গবেষণার কাজ ইত্যাদি অনেক কিছু দেখে আমার মনে হলো, এই কাজগুলোর সাথে আমার লেখালেখি যুক্ত করতে হলে আমার লেখক জায়গাটা তৈরি করতে হবে এবং আমি লেখক হবো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি নিজে অভিনয় করতাম, আবৃত্তি করতাম। বিতর্ক আমার প্রিয় বিষয় ছিল, গিটার বাজাতাম। আমি লেখালেখির জন্য সব বাদ দিয়েছি। কারণ আমার মনে হয়েছিল, এতো কিছু করলে আমি কোনোটাই পারবো না। তারচেয়ে আমি আমার শ্রম-সাধনা একটা ক্ষেত্রেই নিয়োগ করি। এজন্য আমি সবকিছু বাদ দিয়ে লেখালেখিতে মনোযোগ দেই।
একটা লেখার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেন?
গল্প হোক, উপন্যাস হোক, প্রথম প্রস্তুতি হলো- যা লিখব তার বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে। গল্পের বিষয়টা বা উপন্যাসের পটভূমিটা কী হবে− সেটা কি একজন ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হবে নাকি একটি সামাজিক বড় বিষয় হবে নাকি সাধারণ মানুষের জীবনের জায়গা থেকে উঠে আসবে− এগুলো আমি চিন্তা করি; বিষয়টা ঠিক করে আমি লিখতে বসি।
আপনার তো আরো অনেক ব্যস্ততা। সেসব সামলে লেখার সময় বের করতে কি বেগ পেতে হয়?
না। বাংলা একাডেমির ৩৪ বছরের চাকরিজীবনে অজস্র কাজ ছিল- বিশেষ করে প্রকাশনার কাজ, গবেষণার কাজ। কিন্তু আমি সবসময় চেষ্টা করেছি, লেখার জন্য সময় রাখার। বাংলা একাডেমিতে সব দিন তো কাজের চাপ সমান থাকত না। কোনোদিন হয়তো দুই-চারটা ফাইলে নোট দিয়ে জমা দিলেই কাজ শেষ হয়ে যায়। লেখালেখির কাগজপত্র সবসময় আমার সাথেই থাকে। কাজের চাপ কম থাকলে আমি একাডেমিতেই লিখতে বসে যেতাম বা পড়তাম। আবার বাড়িতে থাকা অবস্থায় বাচ্চাদের হয়তো কাজের মেয়ের সাথে খেলতে পাঠিয়ে দিতাম বিকেলে। এই ফাঁকে হয়তো আমি দু পৃষ্ঠা লিখে ফেলতাম। এটা ১৯৭০ সালের কথা বলছি। এইভাবে আমি সময়টাকে আমার পক্ষে কাজে লাগিয়েছি। আমার একটা বড় ভাবনা ছিল, আমি যেন কখনো সময়টাকে নষ্ট না করি।
আমাদের সমাজে একজন নারী লেখকের যুদ্ধটা কি বেশি? একজন পুরুষ যেভাবে সময় পায়, নারীর পক্ষে সময় ও সুযোগ বের করাটা কি তার থেকে কঠিন হয়ে যায়?
আমি প্রথমত নারী লেখক, পুরুষ লেখক মনে করি না, স্বীকার করি না। লেখক লেখকই, লেখকের কোনো জেন্ডার নেই। মেইল না ফিমেইল− এভাবে কোনো লেখকের নির্বাচন হবে না। কোনো পুরুষ কিছু লেখে নাই, পুরুষ বলেই তাকে ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখবে সেটা কিন্তু সত্য নয়। আবার ৪০০ বছর আগে রামায়ণের ওপর যে কাব্যটি চন্দ্রাবতী রচনা করেছেন সেটি কিন্তু হারিয়ে যায়নি। তিনি কিন্তু ৪০০ বছর পরেও মানুষের জ্ঞানের জায়গায়, পাঠের জায়গায় আছেন। সুতরাং লৈঙ্গিক পরিচয় দিয়ে লেখককে মূল্যায়ন করা যাবে না। লেখকের শক্তির ওপর, লেখকের সৃজনশীলতার ওপর, তিনি কতটা ঠিকভাবে তাঁর নিজের জিনিসটাকে উপস্থাপন করতে পারছেন তার ওপরই নির্ভর করে তাঁর সৃষ্টির মান। আমি বলেছি আমি কীভাবে সময় বের করেছি। সাহিত্য কিন্তু একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি না যে দলে দলে নারীরা ঢুকবে, তাদের বের হয়ে আসতে হবে লেখক হয়ে। এই কাজটি তার করতে হবে তার সময় বের করে, মেধা দিয়ে, সৃজনশীলতার জায়গা দিয়ে- সবকিছু মিলিয়ে। আমি কিন্তু আমার কাজের সবটুকু করে আমার সে জায়গাটা বের করেছি। আমি কখনোই কাউকে অস্বীকার করিনি, বলিনি এ কাজটি আমি পারবো না। বাচ্চাকে স্নান করানো, খাওয়ানোর মতো কাজগুলো আমি করিনি বা আমার একজন গুরুজন, আমার শ্বশুর আমার কাছে এসেছেন, তাঁকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাইনি- এটা আমার জীবনে কখনোই হয়নি। আমি প্রয়োজনে রাত জেগেছি, প্রয়োজনে দিনে সময় বের করেছি এবং লেখার কাজটা আমি চালিয়েছি। প্রতিদিন দু পৃষ্ঠা, তিন পৃষ্ঠা- এভাবে একটু একটু করে হলেও লেখার জায়গাটা আমি ঠিক রাখতে পেরেছি। আমি আমার সব বোনদের বলব, মেয়েদের বলব- তারা যেন এভাবেই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে, পরিপার্শ্বের কাউকে বঞ্চিত না করে নিজের সাধনার জায়গাটা পূর্ণ করে। তার সাথে এটাও চাইব তার আশেপাশে যেসব পুরুষেরা আছেন তারা যেন তাকে সহযোগিতা করেন।
কিন্তু বাস্তবতাটা কি এরকম না যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীকে একটু বেশিই প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়?
আমি দেখেছি, আমি জানি, আমি শুনেছি এমন। অনেক মেয়েই আমাকে বলেছে যাদের হাজব্যান্ড হয়তো লেখক; ঘরে এসে চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে বলে, ‘চা আনো।’ তারপর তাকে ঢুকতে হয় রান্নাঘরে। সেক্ষেত্রে যদি সামর্থ্য থাকে একটা ইলেকট্রিক কেটলি কিনে রাখলে একটু গরম পানি করে এক কাপ চা বানিয়ে দেয়া খুব কঠিন কাজ না। বিষয়টা নির্ভর করে কীভাবে আমি ম্যানেজ করব তার ওপর। এই সিস্টেমটার মধ্যে তো আমাদের জীবন চলবে! আমি সিস্টেমটাকে হুট করে অস্বীকার করতে বলব না। বোঝাপড়াটা বাড়াতে হবে। তা নাহলে হয়তো দ্বন্দ হবে, ছাড়াছাড়ি হতে পারে- আমি সেটাও বলছি না। ভালোবাসার জায়গা থাকলে এই সংকাগুলো অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব। তবে সেটা যেন দু দিকেই থাকে। নারীও ভালোবাসা দিবে, পুরুষও ভালোবাসা দিবে। আমি যদি আমার হাজব্যান্ড-এর কথা বলি সে কিন্তু কোনোদিন আমাকে বলেনি যে, ‘আজকে কাজের মেয়ে ভালো রান্না করেনি, তুমি যাও রান্নাঘরে গিয়ে রান্না করে নিয়ে আসো।’ সবসময় বলেছে, তুমি যেহেতু একটা কাজ পারো, তুমি টেবিলেই থাকো। আর ও যা করেছে ঠিক আছে, যদি ভালো না লাগে চলো বাচ্চাদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসি।’ এভাবেই সংসার ম্যানেজ হয়েছে। ও কিন্তু কখনো দাবি করেনি এক্ষুণি এই কাজটি করো। কাজেই ঘরের ভেতরে নারী-পুরুষের সমতা তৈরি করাটাও জরুরি বিষয়। নারীর দায়টা একটু বেশি, সেটাও ঠিক। কিন্তু ভালোবাসা থাকলে বোঝাপড়ার জায়গাটা তৈরি হবে। সমতা তৈরি করা সম্ভব হবে। লেখার জায়গাটাও এই ভালোবাসায় সম্পন্ন হবে।
আপনি বলেছেন, ‘লৈঙ্গিক পরিচয় দিয়ে লেখককে মূল্যায়ন করা যাবে না’; তারপরও তো সমালোচকরা অনেক সময় নারী লেখক, পুরুষ লেখক এভাবে ক্যাটাগরি করে সমালোচনা করেন, লেখাকেও বিচার করেনপুরুষের আধিপত্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসব কথা বলেন আপনার লেখাকে কেউ সেভাবে বিচার করলে আপনার কী অনুভূতি হয়?
আমার তো ভীষণ রাগ হয়! এই যে একটু আগে বললাম লেখার ব্যাপারে কোনো মেইল সেক্স, ফিমেইল সেক্স নেই। ওখানে কেউ নারী-পুরুষ না, ওখানে তিনি একজন লেখক। তিনি প্রাকৃতিকভাবে নারী, এটা তো জীবনের সত্য। কিন্তু যখন তিনি লিখবেন তখন তিনি একজন লেখক। তিনি হোন নারী, হোন পুরুষ, একজন হিজরাও হতে পারেন। অসুবিধা তো নেই, যদি তিনি লিখতে পারেন। সুতরাং তাঁকে কেন আমরা নারী লেখক, পুরুষ লেখক, হিজড়া লেখক এভাবে আলাদা করব? এটা তো উচিত না।
 
**মনের খবর বর্ষ-১, সংখ্যা-৩ এ প্রকাশিত

Previous articleজাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত
Next articleজেন্ডার বৈষম্যের শিকার নির্যাতিত নারী ও শিশুদের মনো-সামাজিক স্বাস্থ্যসেবা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here