মানসিক রোগ চিকিৎসায় রোহিঙ্গাদের কুসংস্কার ছাড়াতে হিমশিম স্বাস্থ্যকর্মীরা

0
168

অশিক্ষা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানসিক রোগের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে পরিচয় করাতে হিমিশিম খাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
“যে কোনো অসুখকে রোহিঙ্গারা জিন-পরির প্রভাব বলে মনে করে। যে কারণে ডাক্তারি চিকিৎসার চেয়ে পানিপড়া, তাবিজ আর দোয়ায় বেশি বিশ্বাস তাদের,” বলেন কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল মতিন।
“এর মূল কারণ হচ্ছে অশিক্ষা আর কুসংস্কার। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের মাঝে ধর্মীয় গোঁড়ামিও বেশ প্রকট,” বলেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার ওপর সম্প্রতি জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গারা মানসিক রোগকে অভিশাপ, রোগির কর্মদোষ কিংবা জিন-ভূতের মতো অশুভ আত্মার প্রভাব হিসেবে বিশ্বাস করে।
ফলে এসব ক্ষেত্রে তাঁরা ঝাড়ফুক কিংবা তাবিজ-কবজ দিয়ে সমস্যার সমাধান খোঁজে। একই সাথে রোহিঙ্গারা মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘কাউন্সেলিং’ বা ‘সাইকোথেরাপির মতো চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত বলেও জানায় ওই প্রতিবেদন।
তবে কুসংস্কার থেকে রোহিঙ্গাদের বের করে আনতে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ফলে ইদানীং কিছু কিছু রেহিঙ্গা চিকিৎসাকেন্দ্রে আসতে শুরু করেছন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
“এ ধরনের কুসংস্কার ও গোঁড়ামি থেকে তাঁদের বের করে আনতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। সচতেনতামূলক পোস্টার-লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে,” জানান ড. আব্দুল মতিন।
উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী শিবিরগুলোতে এই ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করছে কমপক্ষে ১৮টি সংস্থা। মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সাইকোস্যোসিও সাপোর্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (এমএইচপিএসএস) নামের একটি মোর্চা গড়ে তুলেছে তারা। এই কর্মসূচির ফলে রোহিঙ্গাদের মাঝে সচেতনতা ‘কিছুটা বেড়েছে’ বলে বেনারকে জানান কর্মকর্তারা।
গ্রুপটির সমন্বয়ক ফারহানা রহমান ঈশিতা বলেন, “আগের তুলনায় রোহিঙ্গাদের সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে। ধীরে ধীরে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন তাঁরা।”
ইউএনএইচসিআর’র হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থানকারী ১৫-২০ শতাংশ শরণার্থী হালকা বা মাঝারি এবং তিন থেকে চার শতাংশ গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত। তাদের মাঠকর্মীরা গত নভেম্বর অবধি তিন লাখ ১২ হাজার রোহিঙ্গাকে এমএইচপিএসএস-এর কাছে পাঠিয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
যেসব রোগের প্রকোপ বেশি
ইউএনএইচসিআরের পর্যালোচনা মতে, শরণার্থীদের মধ্যে মনোবৈকল্য বা অসারতা, গুরুতর বিষন্নতা এবং উদ্বেগজনিত নিষ্ক্রিয়তার মতো মানসিক ব্যাধি দেখা যায়। হালকা বা মাঝারি মানসিক ব্যাধির মধ্যে রয়েছে মৃদু বিষন্নতা ও উদ্বেগ এবং আঘাত পরবর্তী মানসিক চাপের প্রকোপ।
এ ছাড়া স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মনোযোগহীনতা, উৎকণ্ঠা, পলায়ন প্রবণতা, ভয়, বিষাদ, অপরাধবোধ, নৈরাশ্য, অসারতা, অস্থিরতা, স্ফূর্তি-শূন্যতা ও বিপর্যস্ততায় আক্রান্ত অনেকে। মনস্তাত্ত্বিক কারণে ক্ষুধামান্দ্য, গায়ে ব্যথা, বদ হজম, পেটের পীড়া, নিষ্ক্রিয় যৌনতার সাধারণ দুর্দশায়ও ভুগছেন কেউ কেউ।
গত বছরের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থানরত প্রাপ্তবয়স্ক রোহিঙ্গাদের ৭৪ শতাংশ সবসময় দুঃখী, ৬৪ শতাংশ সব সময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এবং ৪৮ শতাংশ সর্বদা স্নায়বিক চাপে থাকেন। শিশুদের ক্ষেত্রে এর মাত্রা যথাক্রমে ৫০, ৫০ এবং ৫৮ শতাংশ।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এগুলো মানসিক সমস্যা হলেও ইউএনএইচসিআর জানায়, এসব ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা সচরাচর বৈদ্য-ইমামদের মতো ব্যক্তিদের কাছেই সাহায্য নিতে যান।
টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের ডেভেলপমেন্ট কমিটির আবদুল মোতালেব জানান, তাঁর ক্যাম্পে কমপক্ষে ১২ জন বৈদ্য আছেন। অসুখ ছাড়াও হারানো জিনিস পুনরুদ্ধারেও তাঁদের শরণাপন্ন হয় রোহিঙ্গারা।”
তবে সিভিল সার্জনের অভিমত, “রাখাইন রাজ্যে তারা আধুনিক চিকিৎসা সেবা পায়নি। ফলে তাদের ওপর বৈদ্য-কবিরাজের প্রভাব এত বেশি।”
বৈদ্যর পাশাপাশি কবিরাজ, ভবিষ্যৎ বক্তা, ধর্মীয় পণ্ডিত, মৌলভি, লাইসেন্সহীন গ্রাম্য ডাক্তার ও ভেষজ চিকিৎসকদেরও শরণাপন্ন হন রোহিঙ্গারা।
শরণার্থী শিবিরগুলোর শিশু এবং গর্ভবতী নারীদের প্রায় প্রত্যেকেই তাবিজ পরেন। আবার অনেকেই বিভিন্ন হুজুরের কাছ থেকে পানিপড়াও নিয়ে থাকেন।
তবে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গাদের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা বদলাতে শুরু করেছে বলে জানান এমএইচপিএসএস’র ঈশিতা।
তিনি বলেন, “অনেক পরিবার প্রচলিত চিকিৎসায় ফল না পেয়ে ‘শেষ চেষ্টা’ হিসেবে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বারস্থ হয়েছেন। এক্ষেত্রে অনেক রোগী সুস্থ হওয়ার কারণে রোহিঙ্গাদের দৃষ্টি ভঙ্গি বদলাতে শুরু করেছে।”
এদিকে ইউএনএইচসিআর’র দাবি, কক্সবাজারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মানসিক সমস্যা ক্রমাগত বাড়বে। মিয়ানমারে নিজগৃহ ছেড়ে আসার দুঃসহ অভিজ্ঞতার পাশাপাশি ক্যাম্পের কঠিন জীবনযাত্রা, জীবিকার অভাব, স্বাধীনভাবে চলাচলের সীমাবদ্ধতা, এমন অসংখ্য কারণে তারা নিত্যই প্রচণ্ড চাপে থাকে।”
তবে “ক্যাম্পগুলোয় রোহিঙ্গাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা আরও জোরদার করা হবে,” বলে জানান ইউএনএইচআরসি’র মুখপাত্র জোসেফ ত্রিপুরা।

মানসিক স্বাস্থ্যের সব খবর নিয়ে ‘মনের খবর’ জানুয়ারি সংখ্যা এখন সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। আজই সংগ্রহ করে নিন আপনার কপিটি।

Previous articleগর্ভাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ
Next articleআমার স্ত্রী বাসায় থাকতে চায় না, শুধু ঘোরাঘুরি করতে চায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here