মানসিক রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে না ঘুমানোর জন্য ইতালির চিকিৎসকরা বেশ কিছু রোগীকে পরামর্শ দিচ্ছেন, যে রোগে সারা পৃথিবীতে প্রায় ছয় কোটি মানুষ ভুগছে। বাইপোলার রোগের অংশ হিসাবে থাকা বিষণ্ণতার চিকিৎসা করার জন্য এটি একটি অভিনব পদ্ধতি।
নোরমার সঙ্গে যখন মিলানের স্যান র্যাফায়েল হাসপাতালের যোগাযোগ হলো, সে ছিল বেপরোয়া। তাকে যে সমস্ত ওষুধপাতি দেয়া হয়েছে, তার কোনটাই তার বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কারণে তৈরি হওয়া বিষণ্ণতা দূর করতে পারছিল না। ”কেউ একজন এটাকে বলেছে আত্মার ক্যান্সার- তার সঙ্গে আমিও একমত,” বলেন নোরমা। ”আমি একটাকে বলবো একটা দানব।” নিজের রোগের অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলছেন। সুতরাং যখন তিনি একটি ভিন্ন রকম থেরাপির কথা শুনলেন, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা একবার পরীক্ষা করে দেখবেন।
মানসিক রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে বাইপোলার রোগীদের আধুনিক প্রচলিত চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি,সারারাত জেগে থাকতে বলছেন মিলানের অন্যতম প্রধান বিদ্যায়তন স্যান র্যাফায়েল হাসপাতালের চিকিৎসকরা। রোগীদের পরামর্শ দিচ্ছেন, এই রোগীরা রাতে জেগে থাকলে আচরণ পরিবর্তনে আর তাদের বিষণ্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে।
এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে এই ‘ঘুমহীনতা’ থেরাপি নিয়েছেন এবং এখন এটি ইতালির জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগেও চালু হয়েছে।
”যখন আমি এখানে আসলাম, তখন আমার এতটাই খারাপ লাগছিল যে, আমার মরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল,” বলছেন নোরমা।
প্রথমবার যখন তিনি ক্লিনিকে গেলেন, তিনি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। ” আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম কারণ যখনি আমি নাজুক বোধ করতাম, তখন আমি শুধুমাত্র ঘুমাতে চাইতাম। কিন্তু এখানে যখন তারা টের পায় যে আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন, তখন তারা বাধা দেয়। আমি বুঝতে পারছিলাম, এটা আমাকে সাহায্য করার জন্যই তারা করছে, সুতরাং আমি সেটা মেনে নিয়েছিলাম।” তিনি বলছেন।
এক সপ্তাহের পুরো তিন রাত তিনি জেগে থাকেন এবং হাসপাতালে সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য তাকে আরো ১৭ দিন কাটাতে হয়। ”শুরুর দিকে এটা ছিল খুবই কঠিন,” বলছেন নোরমা। ” কিন্তু সব শেষে মনে হচ্ছিল, তারা আমার শিরার ভেতরে কিছু একটা যেন ঢুকিয়ে দিয়েছে, এতটাই ভালো লাগছিল। আমার অনেক শান্তি লাগছিল, অনেক আরাম বোধ হচ্ছিল।” ”এটা যেন জাদুর মতো।”
স্যান রাফায়েল হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসকদের নজরদারি মধ্যে নিদ্রাহীনতার এই থেরাপি বিশেষ অবদান রাখতে পারে, যা ৭০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই ইতিবাচক হয়েছে।
”আমরা দেখতে পেয়েছি, এই চিকিৎসার পরে আমাদের রোগীরা ভালো বোধ করছে,” বলছেন ফ্রান্সিসকো বেনেডেক্ট, হাসপাতালের একজন মনোরোগবিদ। ”তারা ভালোভাবে থেকেছে, তাদের পেশায় ফিরে গেছে। যখন তারা ওয়ার্ড থেকে ছাড়া পেয়েছে, তারা হাসিমুখে গেছে। তারা আত্মহত্যার কথা ভাবতো আর শেষে যখন তারা বাড়ি ফিরে গেছে, তখন তারা নতুন করে তাদের পেশাজীবন ভাবতে শুরু করেছে।” রোগীরা অনেক সময় ক্লিনিকে তখনি আসেন, যখন তারা অন্য সব চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
”অনেক সময় তারা আমাদের কাছে এসে বলে, আমার আর কোন উপায় নেই, আর কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না।” বলছেন বেনেডিক্ট। ”তারাই হচ্ছে এই কার্যকরী, দ্রুতগতির, বিশেষ কষ্টের চিকিৎসার জন্য আদর্শ রোগী, যাদের আচরণ বদলাতে পারে।”
বেনেডিক্ট স্বীকার করছেন যে, মনে হতে পারে যে এটা একটা অদ্ভুত চিন্তা যে, সেইসব মানুষকে রাতে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করা, যারা এমনিতেই রাতে ঘুমাতে পারছেন না।
”এটাকে একটা পাল্টা-চেতনা বলে দেখা যেতে পারে: যখন একজন সাধারণ ব্যক্তি সারারাত জেগে থাকেন, যার এই মনোরোগ নেই, তিনি সাধারণত পরের দিন ক্লান্ত হয়ে থাকেন।” তিনি বলছেন।
কিন্তু বাইপোলার রোগ যাদের রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে নিদ্রাহীনতা ঠিক বিপরীত ব্যাপারটি ঘটায়। এটা তাদের সেরোটোনিনে (যে হরমোনের সঙ্গে ভালো থাকা এবং আনন্দের অনুভূতি জড়িত থাকে এবং রোগীদের ঘুম-সজাগ চক্র ঠিক রাখে) একটা ইতিবাচক ব্যাপার ঘটায়।
তিনি বলছেন, এটা আসলে শক্তিশালী একটা প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে। তবে রোগীদের সতর্কতার সঙ্গে নজরদারি করা হয়, যাতে এটা তাদের মধ্যে কোন উন্মাদনার সৃষ্টি না করে।
কীভাবে এটি কাজ করে, সেটা দেখার জন্য চিকিৎসাধীন থাকা রোগীদের একটি ছোট গ্রুপকে পর্যবেক্ষণ করেন বিবিসির সাংবাদিক।
এই রোগীদের টানা ৩৬ ঘণ্টা ধরে সজাগ থাকতে হবে, সপ্তাহে তিনবার। সময় কাটানোর জন্য রোগীরা ধাঁধা খেলে, গল্প করে, টিভি দেখে এবং কফি খায়।
যখন তারা আর নিজেদের চোখ মেলে রাখতে পারে না, তখন তারা বাগানে হাঁটাহাটি করার জন্য যায় অথবা চোখেমুখে ঠাণ্ডা পানির ঝটকা দেয়। র্যাচেল নামের একজন রোগীর কৌশল ছিল- এসব সময়ে কাপড় বুনে যাওয়া।
৬১ বছর বয়সী গর্গিও একজন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী, যার বিশ বছর ধরে বাইপোলার রোগ রয়েছে। তিনি বেশ কয়েকটি থেরাপি এবং অনেক ধরণের ওষুধ খেয়ে দেখেছেন, কিন্তু কোনটাতেই কোন উপকার হয়নি। সুতরাং তিনি এমন কিছু খুঁজছিলেন, যা তার সাহায্যে আসবে।
”বিষণ্ণতাটি এতো জোরালো ছিল যে, আমি নিজের চাকরি করতে পারছিলাম না, কোন কিছুই করতে পারছিলাম না। আমি শুধু বলতে পারি, আমি মরে যেতে চাইছিলাম।”
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে, সারা রাত ধরে জেগে থাকতে গর্গিওয়ের মতো রোগীদের কোন সহায়তা দরকার হয় না। কিন্তু তারা বিছানায় যেতে চায় না, বলছেন, বেনেডিক্ট, তারা এখানে এসেছে চিকিৎসা করার জন্য।
ভোর রাত তিনটার দিকে রোগীদের এমন একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে দিনের মতো শক্তিশালী বাতি জ্বলছে, যার ফলে রোগীদের মনে হতে পারে যে, এটা একটা রৌদ্রোজ্জ্বল গ্রীষ্মের দিন।
”আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পেয়েছি যে, এটা হলো আচরণ পরিবর্তনের বিশেষ মুহূর্ত, যখন খুব সকালের দিকে তারা নিজেদের ভেতর একটা প্রতিষেধক অনুভূতি বোধ করতে শুরু করেন। তিনটার সময় এই বাতি চিকিৎসার পরে তারা সাধারণত ভালো বোধ করতে শুরু করে।” বলছেন বেনেডিক্ট।
দিনের বেলাতেও পুনরায় এই বাতি চিকিৎসা দেয়া হয় এবং পরবর্তী সপ্তাহগুলোতেও।
”রোগীদের চোখের ভেতরে প্রবেশ করে আলো এবং এটা তাদের জেগে থাকতে সাহায্য করে, ঘুম ভাব কাটিয়ে দেয় এবং তাদের ভেতর প্রতিষেধক তৈরি করে,” বলছেন বেনেডিক্ট।
র্বোপরি রোগীদের লিথিয়াম দেয়া হয়, যা আচরণের স্থিতাবস্থা ধরে রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু এমন কোন নিশ্চয়তা নেই যে, এটা সবার ক্ষেত্রে কাজ করবে।
গর্গিওয়ের ক্ষেত্রে প্রথম কয়েকটি সেশনে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়নি। কিন্তু নিদ্রাহীনতার দ্বিতীয় রাতে তিনি নিজেকে খানিকটা কম বিষণ্ণ বোধ করতে শুরু করেন।
”আমি জেগে উঠলাম এবং বুঝতে পারলাম না যে, আমি কোথায় আছি। আমি বিষণ্ণতার একটি খারাপ ধরণের অনুভূতি বোধ করছিলাম, যেন অত্যন্ত খারাপ।” বলছেন গর্গিও।
”এটাকে আমরা বলি পুষিয়ে নেয়া ঘুমের পরে বিষণ্ণতার অবনতির অবস্থা,” ব্যাখ্যা করছেন বেনেডিক্ট। ” গর্গিও খুবই জটিল একটি রোগী- এবং এ কারণেই এ ধরণের চিকিৎসা হাসপাতালে করা হয়। আমার রোগীদের সেই সময়ে পাশাপাশি থাকতে চাই, যখন তারা আচরণ পরিবর্তনের রোলার কোস্টারের ভেতর দিয়ে যায়।”
তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, এটা চেষ্টা করে দেখা উচিত, বিশেষ করে সেই সব রোগীদের জন্য, যাদের ক্ষেত্রে ওষুধে উপকার পাওয়া যাচ্ছে না।
এমনকি নোরমার জন্যও এটা একেবারে সহজ পথচলা ছিল না। ২০১৬ সালে তার প্রথম থেরাপির পরে অবস্থার অবনতি হয়। এবং পরে আরো দুইবার এই চিকিৎসা নিতে হয়েছে।। কিন্তু প্রতিবারেই সে একই ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পেয়েছে।
সর্বোপরি, নোরমা অনুভব করছেন যে, তার জীবনে পরিবর্তন এসেছে। ”আমি আমার চিকিৎসককে দেবদূত বলে ডাকি- এই স্থানটি হলো আমার মুক্তির জায়গা।”
মনোরোগবিদদের মধ্যে নিদ্রাহীনতার এই থেরাপি নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে বেনেডিক্টকে একজন প্রবর্তক বলে বর্ণনা করেন, আবার অনেকে মনে করেন, তার চিকিৎসার প্রমাণ যথেষ্ট জোরালো নয়। এতো বছর ধরে এই কর্মসূচীটি চলে আসলেও, এটি কতটা কার্যকরী, সেটি নিয়ে নিরীক্ষা করা হয়নি।
”যখন কেউ এমন চিকিৎসার উন্নয়ন ঘটান, যেটা নিয়ে তাদের প্রবল আবেগ রয়েছে, তখন অনেক একপেশে বিষয় চলে আসতে পারে, এ কারণেই আমাদের সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হয়।” বলছেন জন গেডেস, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক।
”আমি মনে করি, নিদ্রাহীনতার সঙ্গে বাতির থেরাপি এবং প্রচলিত থেরাপিগুলো একসাথে মিশিয়ে চিকিৎসা দেয়ার আইডিয়াটি খুবই ভালো-কিন্তু আমাদের, অনেক বেশি রোগীকে নিয়ে নিরীক্ষা মানদণ্ডের বিচার বিশ্লেষণ করার পর চূড়ান্ত উপসংহারে পৌঁছানো যাবে যে, এটা আসলে কতটা কার্যকরী হচ্ছে।”
‘র্যানডোমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়ালস’ নামের এই নিরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে বেনেডিক্টের। তিনি বলছেন, এই যাচাই পদ্ধতি তৈরি হয়েছে ওষুধের কার্যকারিতা নিরীক্ষার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এ ধরণের চিকিৎসার গুণ যাচাই করার জন্য ওই পদ্ধতি আদর্শ নয়।
কিন্তু এই ট্রায়ালের মাধ্যমে তিনি যদি চিকিৎসার প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে এই থেরাপি সত্যিই কার্যকরী, সেটা তিনি বিশ্বের মনোরোগবিদদের কাছে তুলে ধরতে পারবেন না।
বিবিসি তাদের পর্যবেক্ষণে ৭০ শতাংশ সাফল্যের হার দেখতে পায়নি এবং তিনমাস পরে, যে চারজন রোগীকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, তারাও খুব ভালো হয়ে গেছেন বলে জানাননি।
কিন্তু এই ধারণাটি বিশ্বের অনেক স্থানেই সমর্থন পেয়েছে। নরওয়ে, জাপান, এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন স্থানে এই পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যেও ছোটখাটো আকারে পরীক্ষা চলছে।
এর মাঝে চিকিৎসকরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন যে, চিকিৎসকদের নজরদারির বাইরে যেন এই থেরাপি কোনভাবেই প্রয়োগ করা না হয়।
সূত্র: বিবিসি (বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের পিপল ফিক্সিং দ্যা ওয়ার্ল্ডের প্রতিবেদন।)