মানসিক পুনর্বাসন: স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য গুরুত্বপূর্ণ

মানসিক রোগের চিকিৎসার দুটো ভাগ হল – চিকিৎসা ও পুনর্বাসন। রোগীকে সম্পুর্ণ সারিয়ে তোলাই চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্যে। পুনর্বাসনের সাহায্যে চিকিৎসার পরে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়া সম্ভব।

শারীরিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে যেমন ওষুধ বা শল্যচিকিৎসায় রোগীকে সারিয়ে তোলা যায়, মানসিক রোগের চিকিৎসায় ওষুধের পাশাপাশি অন্য ধরণের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এবং সেই চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ভর করে রোগ নির্নয়, রোগের মাত্রা এবং রোগীর শারীরিক ও মানসিক স্থিতির ওপর। বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি যেমন ওষুধ, থেরাপি, কাউন্সেলিং, হাসপাতালে ভর্তি, মস্তিষ্কে উদ্দীপক প্রবাহ ঘটানো এবং মানসিক পুনর্বাসনের একটি মিশ্রণ প্রয়োগ করা হতে পারে।
মানসিক পুনর্বাসন চিকিৎসার একটি অংশ যেখানে রোগীকে স্বাভাবিক ভাবে দৈনন্দিন জীবনের ন্যূনতম কাজকর্মগুলি করার যোগ্য করে তোলা হয়। চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন আসলে একে অপরের পরিপূরক।
সমস্ত মানসিক রোগীর কিন্তু পুনর্বাসনের প্রয়োজন হয় না। অনেকের জন্যই ওষুধ এবং কাউন্সেলিংই যথেষ্ট হয়।
কেন পুনর্বাসন জরুরি?
স্কিৎজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার বা মানসিক প্রতিবন্ধকতার মতো অসুখের ক্ষেত্রে রোগীকে শুধুমাত্র পুনর্বাসনের সাহায্যেই স্বাভাবিক কাজকর্ম করার যোগ্য করে তোলা যেতে পারে।
(পুনর্বাসনের সময় খালি রোগীকে দৈনন্দিন কাজকর্ম নতুন করে শেখানো হয়। কিন্তু যারা প্রথমবার নতুন কিছু শিখছেন তাঁদের শেখানোর পদ্ধতি আলাদা হবে।)
এই প্রক্রিয়াটির মূল উদ্দেশ্যই হল সমাজে মানসিক রোগীদেরকে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে সাহায্য করা। ভেদাভেদ মিটিয়ে তাঁদেরকে সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমেই তা সম্ভব।
চিকিৎসারত মানসিক রোগীদেরকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ

  • চিকিৎসার পরে যারা সুস্থ বোধ করছেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে অসুখের সামান্য প্রভাব লক্ষণীয়। (এইধরনের রোগীদের পরিস্থিতি অনুযায়ী চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যায়)
  • স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও যাদের সমাজে বিদ্রূপ ও ঘৃণার শিকার হতে হচ্ছে।
  • সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও সুযোগের অপেক্ষায় যারা ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছেন।
  • জটিল কোনও মানসিক রোগের ফলে যারা একেবারেই অক্ষম হয়ে পড়েছেন। (মানসিক রোগীদের মধ্যে এদের সংখ্যা খুবি সামান্য)

একজন মানসিক চিকিৎসকের কাজ হল যে প্রথমেই ক্ষতিয়ে দেখা যে রোগীকে এর মধ্যে কোন ভাগে ফেলা উচিৎ।
অধিকাংশ জটিল মানসিক রোগ ১৮-২৫ বছর বয়েসের মধ্যে দেখা দেয়। এই বয়েসে আমরা সাধারণত নিজেদের জীবন গড়ে তুলি। ফলে এমতাবস্থায় অসুখ ধরা পড়লে আমাদের জীবন থেকে মুছে যায় বহু দিন, মাস বা বছর। লেখাপড়া ও চাকরি জীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তাঁর চেয়েও খারাপ হল যে সুস্থতা লাভের পরেও একজন মানসিক রোগী কে বহু যায়গায় কাজের সুযোগ দেওয়া হয় না। পরিবারের সদস্য আর বন্ধুবান্ধবের নিন্দা ও কুৎসার ফলে তাঁর আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
কাজেই পুনর্বাসনের সময় দেখা হয় যেঃ

  • ব্যক্তির যোগ্যতা কী এবং তিনি কী কী কাজ পারেন?
  • অসুস্থতার কারণে তাঁর সীমাবদ্ধতাগুলি উপলব্ধি করা।

এইগুলো বিচার করার পরেই একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক স্থির করেন যে কীভাবে বা কীরকম কাজে সেই ব্যক্তিকে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে।
ধরা যাক একজন ৩০ বছর বয়সী ব্যক্তি ৫ বছর যাবৎ স্কিৎজোফ্রেনিয়াতে ভুগেছেন অসুখ ধরা পড়ার বেশ কয়েক বছর পর তাঁর চিকিৎসা আরম্ভ হয়। চিকিৎসার পর সে নিজের জগতে ফিরতে গিয়ে দেখে যে তাঁর সমস্ত বন্ধু এবং সহপাঠিরা ভাল চাকরি করছে এবং বিয়ে করে সংসার পেতেছে। তাঁর পরিবারের লোকরা তাঁকে বেকার না বসে থেকে একটি কারখানায় শ্রমিকের চাকরি করতে বলে। এতে সে ভেঙ্গে পড়ে। একই সাথে সে নিজের যোগ্যতা ও কার্য্যক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন। এমতাবস্থায় তাঁর একজন মনোবিদের সহায়তা প্রয়োজন, যিনি তাঁকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন। তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকেও তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে।
অন্য দিকে একজন ২০ বছরের ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রের স্কিৎজোফ্রেনিয়া ধরা পড়ে। তিন বছর ধরে তাঁর চিকিৎসা চলেচিকিৎসার পরে সে আর কলেজে ফিরে গিয়ে পড়াশুনো করতে চায় না। তাঁর ইচ্ছা অন্য কিছু করার। কিন্তু তাঁর পরিবারের লোকেরা বেঁকে বসেনতাঁর বলেন যে তাঁর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে কোনও আই টি কোম্পানিতে কাজ করা উচিৎ। কারণ অন্য কিছু তাঁদের পরিবারের জন্য সম্মানজনক নয়। এই ক্ষেত্রে তাঁর পরিবারের লোকজনকে বুঝতে হবে যে তাঁদের সন্তান আর আগের মত নেই। তাঁর আশা আকাঙ্ক্ষা এবং কাজের ক্ষমতা বদলে গিয়েছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁর পাশে দাড়িয়ে তাঁকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনাই পরিবারের প্রধান কর্তব্য।
পুনর্বাসন প্রক্রিয়া
প্রথমেই সংশ্লিষ্ট মনোবিদ রোগী এবং তাঁর বাড়ির লোকেদের সাথে কথা বলেন; তিনি জেনে নেন যে রোগীর পছন্দের এবং ভাললাগার কাজগুলির বৃত্তান্ত। রোগীর পরিবারকে তাঁর বর্তমান অবস্থার সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে। তাঁর অসুস্থতার কারণে তিনি এখন অনেক কাজ করতে পারবেন না, ফলে তাঁর থেকে অবাস্তব আশা করে কোন লাভ নেই।
মনোবিদ এই সময় চিকিৎসারত ব্যক্তির সাথে ঘন ঘন আলোচনার মাধ্যমে তাঁর মানসিক পরিস্থিতি এবং তাঁর পরিবারের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করেন।
নতুন জিনিস শেখা
চিকিৎসা শেষ হবার পরে রোগী যদি স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে না ফিরতে পারেন তাহলে তাঁদের বিভিন্ন রকম কাজ শিখতে সাহায্য করা হয়। নতুন কাজ শিখতে পারলে এই পরিস্থিতিতে রোগীর মানসিকতায় এক ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
পরিবারের ভূমিকা
কারও মানসিক রোগ ধরা পড়া মানে, তাঁর পরিবারকেও সেই রোগের মোকাবিলা করতে শিখতে হয়। প্রথাগত চিকিৎসার পাশাপাশি নিজের নিকটজনেরা পাশে দাঁড়ালে রোগীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে কোন সমস্যা হয় না। সেই জন্য পরিবারের লোকজনেরও কাউন্সেলিং প্রয়োজন। রোগীর সাথে তাঁর প্রিয়জনেরা যতটা বেশী সমস্য কাটাবেন ততই উভয় পক্ষের অসুখের সাথে যুঝে উঠতে সুবিধা হবে।
সূত্র: মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট অবলম্বনে।

Previous articleকরোনার ভয় তবু পেটের দায়ে পথে রিক্শাচালকেরা
Next articleতরুণ বয়সে মানসিক দৃঢ়তা বাড়াতে করণীয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here