সজিব, ২১ বছরের তরুণ। এসএসসি এবং এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে পাশ করে এখন একটি সরকারী ভার্সিটিতে পড়ছে। বাবা-মা দুজনেই শিক্ষকতা পেশায় আছেন। দুই বোন আর এক ভাইর মধ্যে সে সবার ছোট। পড়ালেখার পাশাপাশি, ভালো কবিতা লিখতো এবং গান করতো। অর্থাৎ মেধাবী ছাত্রের সকল গুনই সজিবের ছিলো। কিন্তু ভার্সিটিতে হলে থাকার বছর খানেক পর থেকেই সজিবের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আসতে থাকে। প্রথম সেমিস্টারে বেশ ভালো রেজাল্ট হলেও, পরবর্তি সেমিস্টার গুলোতে রেজাল্ট খুবই খারাপ, সাথে কয়েকটা রি-টেকও আছে। আগে সজিব বন্ধু মহল এবং পরিবারে একজন বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ হিসেবে সমাদর পেলেও, এখন চিত্র পুরো উল্টো। তার এই পরিবর্তন বুঝতে বাবা-মা কিছুটা দেড়ি করে ফেলে। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে, তারা খোজ খবর নিয়ে জানতে পারে, ছেলে মাদকে আসক্ত হয়ে পরেছে। চিকিৎসার জন্য তারা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সরনাপন্ন হোন। চিকিৎসক সজিবকে রিহ্যাবে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। দীর্ঘ ৩ মাস রিহ্যাবে চিকিৎসা নেয়ার পর, সজিব আসক্তি থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু তার পড়ালেখা, গান , কবিতা যেন ঠিক আগের মত আর হচ্ছে না। কেমন যেনো নিজেকে মেধাহীন, ভোতা মনে হয়। কিছু মনে রাখতে খুবই সমস্যা হয়, নতুন কিছু চিন্তা করতে, নতুন কিছু ভাবতে অনেক কষ্ট হয়। এরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে খুব বিষন্ন মনে হয় তার কাছে। ফলো-আপে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে, তিনি তাকে কিছু ওষুধ ও কিছু কাউন্সেলিং করে দেন। সজিব বুঝতে পারে, দীর্ঘমেয়াদি মাদক নেয়ার ফলে তার ব্রেইনে কিছু পরিবর্তন হয়েছে, যা তার বুদ্ধিমত্তা কমিয়ে দিয়েছে। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে, তাকে নতুন করে শুরু করার পরামর্শ দেয়া হয়। নিয়মিত ব্যায়াম করলে, নিজেকে সকল প্রকার মাদক থেকে দূরে রাখলে, সে আবার আগের বুদ্ধিদিপ্ত সজিব হয়ে উঠতে পারে বলে চিকিৎসক তাকে অভয় দেন।
উপরের সজিব হয়তো একটি কাল্পনিক চরিত্র। কিন্তু, সত্য হচ্ছে, এরকম সজিব আমাদের সমাজের এক করূন বাস্তবতা। শুধু তরুনরাই না, যুবক, মধ্য বয়স্ক, শিশু কিশোর এমনকি মেয়েরাও আজকে মাদকের থাবায় আসক্ত। কেউ হয়তো পড়ালেখায় পিছিয়ে, কেউ চাকুরীতে আগের মত ভালো করতে পারছে না, কেউ ভুলে যাচ্ছে তার সৃজনশীলতা। নিয়মিত মাদক নেয়ার ফলে তাদের এরকম পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ মাদক তাদের বুদ্ধিমত্তা কমিয়ে দিচ্ছে।
মাদক কিভাবে বুদ্ধিমত্তা কমায়? এটা বুঝতে হলে, প্রথমেই বুঝতে হবে বুদ্ধিমত্তা কী?
সাধারন ভাবে বুদ্ধিমত্তা বা ইন্টেলিজেন্স বলতে, জ্ঞান আহরণ করা এবং তাকে কাজে লাগানোর ক্ষমতাকে বোঝায়। বিভিন্ন প্রকার বুদ্ধি পরিমাপকের আবিষ্কারক, সাইকোলজিস্ট ডেভিড ওয়েসলারের মতে, বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে উদ্দেশ্যপূর্ন কাজ করার, যুক্তিযুক্ত ভাবে চিন্তা করার এবং পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী কার্যকর ভাবে মোকাবেলা করার ক্ষমতা। এই বিস্তৃত সজ্ঞার মতে, একজন ব্যক্তি তখনি বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে কাজ করতে পারে, যখন সে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিখে, তার প্রতিদিনকার সমস্যার জন্য কার্যকরী সমাধান খুঁজে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়।
মাদক গ্রহন করলে, মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক রাসায়নিক পদার্থের অধিক পরিমানে বেড়ে যায়, যার ফলে এক ধরনের আনন্দদায়ক বা অতি চঞ্চলতা অনুভূত হয়। এভাবে বারবার মস্তিষ্কে ডোপামিনের আধিক্যের ফলে মস্তিষ্কের কোষ সমূহ ক্ষতিগ্রস্থ হয় বা মারা যায়।
কিছু কিছু মাদক মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু রিসেপটরের সাথে সংযোগ ঘটায়, ফলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজ যেমন, তথ্য বা সংকেত আদান-প্রদান এবং তার ব্যখ্যা খোঁজার ক্ষমতা ব্যাহত হয়। যেহেতু মাদক ঐসব রিসেপ্টরকে পরিব্যাস্ত করে রাখে, তাই শরীরের স্বাভাবিক নিউরোট্রান্সমিটার ঐসব রিসেপটরের সাথে সংযোগ ঘটাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এরমানে হলো ,নিউরোট্রান্সমিটার তাদের কাজ সঠিকভাবে করতে পারে না অর্থাৎ মস্তিষ্ক থেকে তথ্য বা সংকেত শরীরে আদান-প্রদান ঠিকভাবে হয় না। এছাড়া মাদক মস্তিষ্কের বিভিন্ন সংকেতকে ব্যাহত করে এবং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় নিউরোট্রান্সমিটার তৈরিও বন্ধ করে দেয়।
মাদকের প্রভাবে রক্তনালী সংকুচিত হয়ে যায়, এবং শরীরের সকল জায়গায় রক্ত প্রবাহ কমে যায়। সময়ের সাথে সাথে এথোরোস্ক্লেরোসিস (রক্তনালীতে প্লাগ জমা) হয়ে রক্তনালি শক্ত ও সংকুচিত হয়ে যায়। মস্তিষ্কের রক্তনালীতেও একই ঘটনা ঘটে, এবং এতে মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ন স্থানে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। বারংবার একই ঘটনা ঘটে এক সময় মস্তিষ্কের কোষ মারা যায় এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাপ বা ফাঁকা স্থান তৈরি হয়। যারফলে মস্তিষ্ক যথাযত ভাবে চিন্তা করে, কার্যকরি কাজ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
দূর্ভাগ্যজনক ভাবে মাদক অপব্যবহার মস্তিষ্কের সেসব জায়গায় বেশি ক্ষতি করে, যেগুলো আমাদের কার্যকরি ভাবে চিন্তা করতে, স্মৃতিশক্তি যথাযথভাবে ব্যবহার করতে এবং নতুন কিছু শিখতে ভূমিকা রাখে। কোনকিছু শেখার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা এবং যুক্তিযুক্ত কাজ করার ক্ষমতা, এগুলো সবই হচ্ছে আমাদের মদ্ধিমত্তার সাথে সম্পর্কিত। যখন মাদকের অপব্যবহারের ফলে মস্তিষ্কের এই গুরুত্বপূর্ন জায়গাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়, ফলস্বরূপ বুদ্ধিমত্তাও কমে যায়।
আরো দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, যদিও মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত কোষ সমূহকে বিভিন্ন চিকিৎসায় পূর্বের অবস্থায় ফেরানো সম্ভব হয়, কিন্তু, যদি মস্তিষ্কের কোন কোষ মারা যায়, তারা আর কখনো নতুন ভাবে তৈরি হয় না, অর্থাৎ পিছনে ফেরার রাস্তা বন্ধ। এজন্যই, যারা দীর্গমেয়াদী মাদক গ্রহন করে, তারা নতুন কোন কিছু মনে রাখতে পারে না, সহজেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পরে যায়, এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যার্থ হয়।
ক্রমবিকাশমান মস্তিষ্ক মাদকাসক্ত হওয়ার জন্য বিষেষভাবে ঝুকিপুর্ন; জন্মপূর্ব, শৈশব এবং কৈশরে মাদকের অপব্যবহার হলে তা আমাদের চিন্তাশীল কার্যকলাপে টেকশই পরিবর্তন করে। চিন্তাশীল কার্যকলাপের পরিবর্তন লেখাপড়ার উপর মারাত্বক প্রভাব পরে এবং নতুন জ্ঞান আহরণ বাধাগ্রস্ত হয়।
লেখাপড়ায় খারাপ করা এবং মাদক গ্রহন, দুটোর মধ্যে পরস্পর দ্বিমুখী সম্পর্ক বিদ্যমান। কারো কারো মতে, বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশীলতার অভাবে শিশু কিশোরদের মাদকের দিকে ঝুঁকে পরার সম্ভাবনা অন্য যেকোন কিছুর থেকে বেশি; বিপরীতভাবে অন্যরা বলেন, মাদকাসক্তিই হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার উৎস।
যেভাবেই হোক, মাদক আমাদের বুদ্ধিমত্তার উপর মারাত্বক বিরূপ প্রভাব ফেলে। আমাদের স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা কমিয়ে দেয়। মাদক গ্রহন করলে সকল বয়সী মানুষের ক্ষেত্রেই এরকম হতে পারে, তবে, শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে এই প্রভাব খুবই মারাত্বক। তাই বুদ্ধিদীপ্ত ও চিন্তাশীল মানুষ হতে হলে মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে।
ডা. মেজবাউল খাঁন ফরহাদ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে