ডা. ফারজানা ওমর তানজু
সহকারী রেজিস্ট্রার, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
এক শীতের সন্ধ্যায় বসে ছিলাম এক প্রত্যন্ত গ্রামের উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। হঠাৎ করে ১০-১২ জন মানুষ একজনকে পাজাকোলে করে নিয়ে ঢুকল, রক্তে যার পুরো শরীর ভেসে যাচ্ছিল। শরীর ভর্তি ধারালো অস্ত্রের জখম। পাল্স অতি দুর্বল, শ্বাসপ্রশ্বাস অত্যন্ত ক্ষীণ। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন তাকে জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হলো, তখনই রাস্তায় সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
কলিমউদ্দিন, ৪৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি, যিনি খুন হয়েছিলেন নিজের মাদকাসক্ত বেকার ছেলের হাতে।
আচ্ছা, খারাপ জেনেও মানুষ কেন মাদক গ্রহণ করে? কেন একবার ছেড়ে দেওয়ার পরও মানুষ আবার মাদকে আসক্ত হয়ে যায়? কেন দিন দিন মাদকাসক্তি থেকে প্রতিকার কঠিন হয়ে উঠছে? আজ আমরা সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব এবং মাদকমুক্তির অন্যতম অন্তরায়—বেকারত্ব সম্পর্কেও জানব।
খুব সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে, মাদকের প্রতি যে নির্ভরশীলতা তৈরি হয়, সেটাই মাদকাসক্তি। বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানে মাদকাসক্তিকে এক ধরনের ডিজঅর্ডার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আমাদের দেশের প্রচলিত মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, মদ, আফিম, হেরোইন, কোকেন, প্যাথিডিন, বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ওষুধ, এমনকি জুতার আঠা পর্যন্ত। মাদক নেওয়ার ফলে মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ হয়, যা একধরনের ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করে। কোকেনের মতো মাদক আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী করে তোলে, হেরোইন প্রশান্তি ও তৃপ্তির অনুভূতি জাগায়। আবার কিছু কিছু মাদক মনোসংযোগ ঠিক রাখতে সাহায্য করে। ডিপ্রেশন, মানসিক অবসাদ, বিষণ্নতা ইত্যাদি কমাতেও মাদক সাময়িক সময়ের জন্য কাজে দেয়। তবে মাদক নিতে নিতে একসময় দেখা যায়, মাদক ছাড়া আর কোনো কাজেই মন দিতে পারছে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কে মাদকের টলারেন্স বাড়ে, ফলে একই অনুভূতি পাওয়ার জন্য বেশি পরিমাণে মাদক নিতে হয়। এবং কোনো কারণে মাদক না নিতে পারলে শরীরে মাদক নেওয়ার একটি প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় এবং নানা রকম অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়।
মাদকাসক্তির কারণে মানুষ তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, বিচার-বিবেচনা ও ঠিক-ভুল বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কর্মদক্ষতা কমিয়ে দেয় এবং উগ্র আচরণের জন্ম দেয়, অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। মানসিক পীড়ন বাড়িয়ে মানুষকে ঠেলে দিতে পারে আত্মহত্যার দিকেও।
মাদকের সহজলভ্যতা, সঙ্গদোষ, হতাশা ও দুশ্চিন্তা, নিছক আনন্দ এবং কৌতূহলবশত মানুষ মাদক নিলেও, মাদকের অন্যতম প্রধান কারণ হলো বেকারত্ব। বেকারত্ব ও মাদকাসক্তি একে অপরের সম্পূরক। বেকারত্ব থেকে মাদকাসক্তির উৎপত্তি হতে পারে, আবার মাদকাসক্তি ও বেকারত্বের কারণ হতে পারে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৫৭ শতাংশ বেকার মাদকাসক্তির সঙ্গে জড়িত। বেকারত্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হলো ব্যক্তির মানসিক অবস্থার পতন। অধিকাংশ বেকার সহজেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, কারণ আর্থিক অনটন তার পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এবং ব্যক্তির ওপর চাপ তৈরি হয়। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো একটি চাকরি বা উপার্জনের মাধ্যম। যখন তা হ্রাস পায়, ব্যক্তি বিষণ্নতায় পতিত হয়। মাদকাসক্তি এই সামগ্রিক সমস্যার একটি মিথ্যা সমাধান হিসেবে উপস্থিত হয়। ব্যক্তি বেকারত্বের হতাশা, অস্থিরতা, অসম্মান থেকে বাঁচতে আশ্রয় নেয় মাদকের, এবং মাদকের টাকা জোগাড় করতে অনেকেই নানা রকম অপরাধপ্রবণতা ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
লেখার শুরুতেই কলিমউদ্দিনের কথা বলেছিলাম, যিনি নিজের মাদকাসক্ত বেকার ছেলের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন মাদকের টাকা জোগাড় করতে না পেরে।
চব্বিশ বছর বয়সী বিদেশফেরত ইয়াকুব দেশে ফিরে কর্মসংস্থানের অভাবে অলস ও হতাশ জীবনযাপন করছিল। বাল্যবন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মজার ছলে মাদক নেওয়া শুরু করলেও, ধীরে ধীরে সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। মাদক কেনার জন্য বাড়িতে ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করা এবং টাকা না পেলে রাগারাগি, ভাঙচুর করা—এই ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। এবং শেষমেষ পিতৃহত্যার মতো নিকৃষ্টতম অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
বেকারত্ব সমস্যার সমাধানই হতে পারে মাদকাসক্তি নিরাময়ের প্রধান হাতিয়ার। সরকারের নেতৃত্বে বেকারত্ব রোধে কার্যকর নীতিনির্ধারণ, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন প্রোগ্রাম, দক্ষ জনবল তৈরি, ব্যবসা ও নিজস্ব উদ্যোগের সুবিধা, আর্থিক নিরাপত্তা—এসব উদ্যোগ বেকারত্ব রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একজন কর্মঠ ও উদ্যমী ব্যক্তি তার কাজে যেমন উৎফুল্ল থাকবে, তেমনি এই ব্যস্ততা তাকে মাদকাসক্তি থেকেও দূরে রাখবে। যেহেতু বেকারত্ব ও মাদকাসক্তি একে অপরের সম্পূরক, তাই এই দুটিকে একসঙ্গে প্রতিহত করতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে হাতে হাত রেখে এগিয়ে যেতে হবে।
আরও পড়ুন-