কোন কারণে মন খারাপ লাগলে অনেকের এটা সেটা খেতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছামত একগাদা পছন্দের খাবার খেলেই যেন মেলে মানসিক তৃপ্তি। এটাই ইমোশনাল ইটিং বা আবেগজনিত ক্ষুধা।এটা ক্ষুধায় পেট ভরার জন্য নয়, নেতিবাচক অনুভূতি দমনের জন্যই একগাদা অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে থাকেন অনেকে। তাই খাওয়াটা হয়ও নিয়ন্ত্রণহীন। এভাবে খাওয়ার পর অনেকেই অপরাধবোধে ভোগেন। এর ফলে ওজন বেড়ে যাওয়াসহ নানারকম শারীরিক সমস্যায়ও ভোগেন অনেকে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই সমস্যায় ভুগলেও নানা গবেষণায় দেখা গেছে নারীদের মধ্যেই এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
কেন এমন হয়?
কর্মক্ষেত্রে সমস্যা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, স্বাস্থ্য সমস্যা, ব্যক্তিগত সম্পর্কের সমস্যা থেকে শুরু করে নানা কিছুই নেতিবাচক আবেগের কারণ হতে পারে। নেতিবাচক বাগে নিয়ন্ত্রণে তখনই সমস্যা হয় যখন,
- মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার মুহুর্তে আশপাশের মানুষের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য বা সহমর্মিতা না পাওয়া
- মানসিক চাপ, দুঃখবোধ ইত্যাদি দূর করার চেষ্টা না করা অর্থাৎ এগুলো থেকে মুক্তির অন্য উপায় খুঁজে বের না করা
- শারীরিক ক্ষুধা ও মানসিক ক্ষুধার পার্থক্য ধরতে না পারা
- ইচ্ছেমতো খেলে বা মদ্যপানে সব ঠিক হয়ে যাবে, নিজেকে এমন প্রবোধ দেওয়া
- মানসিক চাপের জন্য মস্তিষ্কের কর্টিসল লেভেলে পরিবর্তন আসাতে ক্ষুধা বাড়া। ইত্যাদি
ইচ্ছেমতো খেলেই আবেগ নিয়ন্ত্রণ হবে ?
নেতিবাচক আবেগ যেমন রাগ, বিরক্তি, ভয়, দুঃখবোধ ইত্যাদি মানুষের ভেতরে একধরনের শূন্যতাবোধ তৈরি করে। ধরে নেওয়া হয় খাবার সেই শূন্যতা পূরনে অনেকটা সাহায্য করে। অল্প সময়ের জন্য হলেও একধরনের পরিপূর্ণতা এনে দেয় বা তৃপ্তি বোধ করায়। এভাবেই আবেগজনিত ক্ষুধা তৈরি হয়।
আবেগজনিত ক্ষুধা আর স্বাভাবিক ক্ষুধার মধ্যে পার্থক্য
বেঁচে থাকার জন্য আমাদের খেতে হয় তাই ক্ষুধা লাগাটাই স্বাভাবিক। তাই কোনটা আবেগজনিত ক্ষুধা আর কোনটা উদরপূর্তির ক্ষুধা সেই পার্থক্য বুঝতে সমস্যা হয়। আসুন দেখে নেই স্বাভাবিক ক্ষুধা আর আবেগপ্রবণ ক্ষুধার পার্থক্য গুলো কী।
স্বাভাবিক ক্ষুধা
- ধীরে ধীরে তৈরি হয়
- নানা রকম খাবার খাওয়ার ইচ্ছা তৈরি হবে
- একটা সময়ে পেট ভরার অনুভূতি তৈরি হলে খাওয়া বন্ধ করে দেবেন
- খাওয়ার পরে নেতিবাচক অনুভূতি বা অপরাধবোধ হয় না।
আবেগজনিত ক্ষুধা
- হুট করে বা যখন তখন খেতে ইচ্ছা করে
- কিছু নির্দিষ্ট খাবারই খেতে ইচ্ছা করে
- অনেক খেয়েও পেট ভরার অনুভূতি তৈরি হয় না
- খাবার পর অপরাধবোধ জাগে বা লজ্জা লাগে।
কীভাবে বন্ধ করবেন আবেগজনিত ক্ষুধা?
সাধারণত একগাদা খাবার খাওয়ার পরেই এই জাতীয় ক্ষুধায় কিছুটা তৃপ্তি মেলে। তবে তা খুব অল্প সময়ের জন্য। অনেকসময় মনের ক্ষুধা মেটাতে অনেক খেলেও মন খারাপের অনুভূতি দূর হয় না। বরং অনেকসময় খাওয়ার পর আরও বেশি আবগপ্রবণ হয়ে পড়ার সমস্যাও দেখা দিতে পারে। মানসিক চাপ দূর করতে খাওয়া অনেক সহজ। ভিন্ন কিছু করতে প্রয়োজন মানসিক শক্তি। তাই সবার আগে নিজেকে প্রস্তুত করুন আর মন খারাপ দূর করার নানা রকম পদ্ধতি চেষ্টা করে দেখুন। আসুন দেখে নেই আবেগজনিত ক্ষুধা দুর করার কিছু উপায়-
আবেগ নিয়ন্ত্রণ
নেতিবাচক আবেগের জন্য তৈরি হওয়া ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণের জন্য সবার আগে প্রয়োজন আবেগ নিয়ন্ত্রণ। আবেগ নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কে জানতে বই বা জার্নাল পড়ে ধারণা নিতে পারেন। ডায়রিতে লিখুন মন খারাপের কারণ। প্রতিদিনের মানসিক চাপ দূর করতে ধ্যানেও উপকার পাবেন।
ব্যায়াম
অনেকেই নিয়মিত ব্যায়াম করলে মানসিক চাপমুক্ত থাকেন। যখনই নেতিবাচক আবেগ তাড়া করবে তখনই যোগব্যায়াম, হাঁটা বা জগিং করতে পারেন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে দুশ্চিন্তা ও বিষাদের মতো নেতিবাচক আবেগ নিয়ন্ত্রনে যোগব্যায়াম দারুণ উপকারী। মন শান্ত করতে ধ্যানের বিকল্প নাই বললেই চলে। আবেগজনিত ক্ষুধা ও ক্ষুধামান্দ্যের সমস্যায় ধ্যান বেশ উপকারী। এর জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নিয়ে আসন পেতে বসতে হবে তা না। প্রয়োজন নিয়ন্ত্রিত গভীর শ্বাস প্রশ্বাস। যেকোন নিরিবিলি জায়গায় বসে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিন ও শ্বাস ছাড়ুন। আর যদি সুযোগ থাকে তাহলে ইউটিউবে মেডিটেশনের ভিডিও থেকেও সাহায্য নিতে পারেন।
ফুড ডায়েরি রাখা
আপনি যদি সত্যিই আবেগজনিত ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করতে চান তাহলে একটা ফুড ডায়েরি অনুসরণ করতে পারেন। প্রতিদিন কী খেলেন, কখন খেলেন সেটা লিখে রাখুন। এক সপ্তাহ পরে পরে সেই ডায়রি দেখলে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের প্রবণতা কমে আসবে।শুধু কখন কী খেলেন তাই না, তখনকার মানসিক অবস্থাও লিখে রাখুন। মানসিক সমস্যা নিরসনে যদি কোন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন, সেক্ষেত্রে এই ডায়রি বেশ কার্যকরী হবে।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকা
ব্যক্তিবিশেষের খাবার ও পুষ্টির চাহিদা আলাদা হয়। একটা স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকা অর্থাৎ সারাদিন নিয়ম করে সুষম খাবার গ্রহণ করলে স্বাভাবিক ক্ষুধা আর অবাঞ্ছিত ক্ষুধার পার্থক্য ধরা সম্ভব।নিয়মমাফিক খাদ্যতালিকা মেনে খাবার খাওয়ার পরেও অতিরিক্ত ক্ষুধা লাগলে তাজা ফল, সালাদ, পপকর্ণ বা অন্য কোন কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খেতে চেষ্টা করুন। বাসায় উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার, অস্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস যেমন চিপস, চকলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি কেনা কমিয়ে দিন। এমনকি মন খারাপের সময়ে মুদি দোকানে যাওয়াও ঠিক হবে না।
মনযোগ দিন খাওয়ায়
অনেকেই টেলিভিশন বা কম্পিউটারের সামনে বসে বা অন্য কোন কাজ করতে করতে খান। এতে করে কী খাচ্ছেন, কতটুকু খাচ্ছেন সেটিতে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনা। এতে করে পেট ভরার জন্য খাচ্ছেন নাকি আবেগজনিত কারণে সেটা বোঝা যায় না। গেলার আগে খাবারটা কতবার চিবোচ্ছেন সেটা হিসেব করে খেলেও আবেগজনিত খাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ আনা সহজ হয়। দেখা গেছে দশ থেকে তিরিশ বার চিবিয়ে কোন খাবার খেলে পেটের সঙ্গে মনের একটা সংযোগ তৈরি হয় ও অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা দূর হয়।
নিজেকে নিজেই বোঝান
আবেগজনিত কারণে অতিরিক্ত খাবার খেলে সেটা অনেকের মধ্যে পরে লজ্জার অনুভূতি তৈরি করে। এমন ক্ষেত্রে নিজেই নিজেকে বোঝান যে এভাবে অনিয়ন্ত্রিত খাবার খাওয়া আপনার জন্য কতটা ক্ষতিকর। তবে আবেগজনিত ক্ষুধার ক্ষেত্রে নিজের সঙ্গে জোরাজুরি না করে আস্তেধীরে চলাই ভালো। মন খারাপ হলেই বা বিষণ্ণতা ভর করলে মন অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করুন। ইতিবাচক থাকুন। সচেতনতাই পারে যেকোন সমস্যা বা রোগ থেকে মুক্তি দিতে। নিজের চেষ্টায় যদি আবেগজনিত ক্ষুধা দূর করতে না পরেন, তবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন আর একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে