মন ও শিক্ষা

0
70

মন ও শিক্ষা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেই কি আমাদের মন শিক্ষিত হয়ে যায়?
মার্শাল আর্টের এক গুরুর প্রতি একটি মানুষ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। মানুষটির উদ্দেশ্য ছিলো শিক্ষককে প্রচণ্ডভাবে অপমান করা, যাতে করে সে তার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিতে পারে। কিন্তু গুরু বা শিক্ষক তাতে একটুও বিচলিত হলেন না। যিনি তাকে কটুক্তি করছিলেন, তিনি শেষ পর্যন্ত নিজেই রণে ভঙ্গ দিয়ে খুব বিরক্তি নিয়ে চলে গেলেন। তখন গুরুর শিষ্যরা অবাক হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি কীভাবে এত অকথ্য ভাষাসহ্য করছিলেন।
গুরু হেসে বলেছিলেন তোমরা কখনোই অপমানিত হবে না যদি কটু বাক্যগুলো গ্রহণ না কর। মহাত্মা গান্ধীও বলেছিলেন, আমার অনুমতি ছাড়া কেউ আমাকে অপমান করতে পারবে না। একজন সত্যিকারের শিক্ষিত মনের মানুষের পক্ষেই এ ধরনের মনোভাব পোষণ করা এবং সেটির চর্চা করা সম্ভব।
দার্শনিকেরা শিক্ষাকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতে, শিক্ষা আমাদের সত্যকে খুঁজে বের করার মাধ্যমে অন্তরের ভালোবাসা ও ঐশ্বর্য্য বাড়িয়ে জীবনের অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে বের করতে সহায়তা করে।
অ্যারিস্টটলের ধারণা, শিক্ষার মাধ্যমে আমরা সুস্থ শরীরে স্থিতিশীল মনকে সৃষ্টি করতে সমর্থ হই। প্লেটো বলেছেন, শিক্ষা আমাদের মনকে সঠিক মুহূর্তগুলোতে আনন্দ ও দুঃখকে অনুভব করার ক্ষমতা যোগায়।
‘মন’ শব্দটির সংজ্ঞা দেওয়া খুব কঠিন। কারো মতে মন হচ্ছে মস্তিষ্কের কার্যক্রমের ফলাফল। তবে আমাদের মন বিভিন্ন সম্পর্কের মাধ্যমে তৈরি হয়। আমরা নিজের সাথে অবচেতনভাবে যে সম্পর্ক সৃষ্টি করি মনের একটি অংশ তার মাধ্যমও তৈরি হয়।
প্রত্যেকের নিজস্ব ভাবনা অনুভূতি প্রত্যক্ষণ বিশ্বাস মনোভাব এবং খাপ খাইয়ে চলার নিজস্ব ধারা রয়েছে। এই ধারাটি দ্বারা আমরা প্রতিনিয়ত পরিচালিত হচ্ছি।
অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেছি। কিন্তু আমাদের মনটি কি শিক্ষিত হয়েছে শিক্ষিত মনের মানুষরা মুক্ত মন নিয়ে সব ধরনের মতবাদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে চলেন নিজের সত্তাটিকে সঠিকভাবে চিনতে পারেন এবং জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা থেকে শেখা বিশ্বাস ও মূল্যবোধগুলো সুদৃঢ় স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠা করেন।
আমার কাছে একটি ১৪/১৫ বছরের ছেলে বলেছিল তার বাবা তাকে নির্মমভাবে মারধর করেন। বাবাকে প্রশ্ন করেছিলামতি নিও এভাবে মার খেয়ে বড় হয়েছিলেন কিনা। বাবা বলেছিলেন ওর চাইতে দশগুণ বেশি মার খেয়েছি আর সেজন্যই তো মানুষ হয়েছি। আমি হতাশ হয়ে ভাবছিলাম তিনি শিক্ষিত মনের ও মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হয়েছিলেন কিনা তা কি বুঝতে পারছেন?
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি বড় পদে বহাল আছেন ঠিকই তবে নিজের সন্তান ও অন্যদের প্রতি কি শ্রদ্ধার মনোভাব নিয়ে তাদের সাথে আচরণ করেন?মানুষের দোষগুলোকে বড় করে না দেখে তাদের সাথে সহৃদয়ভাবে কি মিশতে পারেন?
একজন মানুষ বেলুন বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি লাল হলুদ নীল গোলাপী রঙের বেলুনের ভেতরে হিলিয়াম গ্যাস ভরে আকাশে উড়িয়ে দিতেন। একদিন তিনি দেখতে পেলেন একটি ছোট শিশু পেছন থেকে তার কাপড় ধরে টানছে। তার দিকে তাকাতেই শিশুটি জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা তুমি যদি একটি কালো বেলুন আকাশে উড়াও তাহলে কি সেটি উড়বে? ভদ্রলোক খুব সুন্দরভাবে উত্তর দিলেন ‘বাবু বেলুনের রঙ দিয়ে কিছু হয় না আমি যে জিনিসটা এর মধ্যে ঢোকাচ্ছি সেটাই বেলুনকে আকাশে নিয়ে যাচ্ছে’।
এই গল্পটি থেকে যে নির্দেশনা পাওয়া যায় তা হলো আমাদের চেহারা বাইরে থেকে যেমনই হোক না কেন ভেতরে যা রয়েছে তা-ই আমাদের উপরে উঠতে সাহায্য করে। সেটি হচ্ছে আলোকিত ঐশ্বর্য্যময় শিক্ষিত একটি মন।
লেখক:
ড. মেহতাব খানম
অধ্যাপক, এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Previous articleশিশুদের আত্মমর্যাদাবোধ তৈরিতে পিতা-মাতার ভূমিকা
Next articleমানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here