মনোজগতের পরিবর্তনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন আবশ্যক

0
34

আমাদের দেশের একজন শিক্ষার্থীকে মোটামুটি ১৭-১৮ বছর কাটাতে হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পেছনে। অর্থাৎ জীবনের একটি বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাটায়। তাই বুদ্ধিবৃত্তিক সবলতার পাশাপাশি মানসিক দৃঢ়তা তৈরি করে একজন শিক্ষার্থীকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিশু-কিশোর ও তরুণের মনস্তাত্ত্বিক জগৎ এক রকম নয়। তাই শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই শিক্ষাদান কৌশল যেমন আলাদা হওয়া বাঞ্ছনীয়, তেমনি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার ক্ষেত্রেও আলাদা কৌশল প্রয়োজন।
কৈশোরে একজন শিক্ষার্থীর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা অনেক বেশি থাকে। হরমোন পরিবর্তনজনিত কারণে তারা আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। বাংলাদেশের পটভূমি বিচার করলে দেখা যায়, অষ্টম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। ফলে তার ওপর মানসিক চাপ থাকে। বাংলাদেশের প্রচলিত ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক পড়াশোনা যে সামাজিক জীবন তৈরি করে, তাতে টেক্সট বইয়ের বাইরে শিক্ষার্থীরা অন্য জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে খুব সামান্যই। তাই পরিবার, সমাজ, পরীক্ষা ও তার শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে শিক্ষার্থীরা একটা বড় রকমের মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। কিন্তু এই চাপকে মুক্ত করার মতো বন্ধু তার খুব একটা থাকে না। মেয়েদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও প্রকট। ফলে তাদের ভঙ্গুর মানসিক চিত্ত নিয়ে কৈশোরকাল পার করতে হয়। এতে খুব অল্পেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তারা। তাই কৈশোরের মানসিক চাপ দূর করতে প্রতিটি স্কুল-কলেজে স্টুুডেন্ট কাউন্সেলর থাকা খুবই জরুরি। যার নিয়মিত তত্ত্বাবধান একজন বয়ঃসন্ধিকালের শিক্ষার্থীর মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে। শিক্ষার্থী যদি তার যে কোনো প্রকার মানসিক অবস্থা শেয়ার করতে পারে এবং যুক্তিযুক্ত পরামর্শ পায়, তাহলে তার মনের চাপ অনেক কমে যায়।
`বাংলাদেশ জার্নাল সাইকিয়াট্রি`তে প্রকাশিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের এক গবেষণা রিপোর্টে দেখা যায়, ভর্তিকৃত ৯৯২ জন মানসিক রোগীর ৭২ শতাংশ শৈশবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ৬৬ শতাংশ আবেগীয় নিপীড়ন এবং ৬০ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বর্তমান সময়ে সাইবার বুলিং শিশু-কিশোর-তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুসারে, ২০১১ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যকারীর সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৬৪২, যা এর পর প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতি এক লাখে ১৭ জন ছেলে এবং ২২ জন মেয়ে আত্মহত্যা করে। কিশোর-কিশোরীদের তারুণ্যের সিঁড়ি বেয়ে ঢুকতে হয় কর্মজীবনে। প্রতিটি ধাপেই রয়েছে সংকট। কেউ সে সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে, কেউ পারে না। ব্যর্থরা মানসিক সমস্যার জালে জড়িয়ে যায় বা যেতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন জয় ছিনিয়ে আনতে নিজের যোগ্যতাকে শানিত ও ব্যর্থতাকে বরণ করার শক্তি সঞ্চয় করা। এই শক্তি মানসিক রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে
উদ্বেগ, হতাশা, বিষণ্ণতা শিক্ষার্থীদের যখন মারাত্মকভাবে গ্রাস করে, তখন তারা বেঁচে থাকার আনন্দ হারিয়ে ফেলে। এক সময় মানুষের জীবনে এতটা চাপ ছিল না। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সবকিছুই যেন জটিল হয়ে যাচ্ছে। এ জীবনে তাই প্রত্যাশার বোঝাও বেশি। আর এটি তো সত্যি যে, আমাদের সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কখনোই শিক্ষার্থীবান্ধব ছিল না। এখন তো পরিস্থিতি আরও জটিল। শুধু এক পক্ষকে দায়ী করলে চলবে না। অনেক অভিভাবকের অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ বিভিন্নভাবে খরচ করা হয়। অভিভাবকদের জীবনও সুশৃঙ্খল বলা যাবে না। সন্তানরাও দেখে দেখে তাই শেখে। স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষার্থী মাদকাসক্ত। তারা আচার-আচরণে বাড়িতে, সমাজে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্ছৃঙ্খল। তাদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? অভিভাবকরাও লাগামহীন। এই ঘুণে ধরা সমাজে শিক্ষক কোত্থেকে আসবেন? তাদের কাছ থেকে আমরা ফেরেশতার মতো আচরণ আশা করতে পারি না। এখন মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীদের একজন শিক্ষক কীভাবে মোকাবেলা করবেন? তার সে ধরনের প্রশিক্ষণ নেই, সামর্থ্য নেই, সময় নেই, ইনসেনটিভ নেই। এ বিষয়গুলোও আমাদের দেখতে হবে। শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ বিনির্মাণে সমাজ কতটা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে, তা আমাদের দেখতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজেরই একটি অংশ। শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিগত ত্রুটি যতটা না এ ক্ষেত্রে মুখ্য, তার চেয়ে বেশি দায়ী আমাদের অসুস্থ ও স্থূ্থল মানসিকতা। আমরা নিয়মনীতির কথা মুখে বললেও সন্তানদের সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই না।
প্রচলিত অর্থে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কঠোর নিয়মকানুনের মর্মান্তিক জাঁতাকলে পিষ্ট করছে শিক্ষার্থীদের। বর্তমানে একজন শিক্ষার্থীর মানসিক আশ্রয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র- কোথাও নেই। অবিরাম সে প্রত্যাশার চাপের মাঝে পার করছে তার যাপিত দিনগুলো। ফলে সে আশ্রয় খোঁজে অনলাইন, ফেসবুক, হোয়টসঅ্যাপ কিংবা ইমোতে। অতঃপর বেলাশেষে এই শিক্ষার্থী দেখে, তার জীবনের সবকিছু সে হারিয়ে বসে আছে। অথচ তার বাবা-মা, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার কাছে অনেক কিছু আশা করে। এই আশা এত দুর্বিষহ যে, তখন সে নিজেকে সফলদের কাতারে নিয়ে যাওয়ার জন্য অসদুপায় অবলম্বন করে। এসব থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে খেলাধুলা, বিতর্ক, আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতে হবে। এটা শুধু বিজয়ের জন্য নয়, পরাজয় মেনে নিতে শেখার জন্য। খেলা বা বিতর্কের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন জয়কে ধারণ করা শিখি, তেমনি পরাজয়কে বরণ করাও শিখি। এগুলো জীবনের বাস্তব শিক্ষা। পাঠ্যবইয়ের বাইরে শিক্ষার্থীদের প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস পারিবারিকভাবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে গড়ে উঠতে হবে। খেলাধুলা, নৈতিকতা ও সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। জীবনের হাসিকান্নার মধ্যেও এক অপূর্ব মাধুর্য আছে, যা শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে।

লেখক: মাসুম বিল্লাহ, শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ; ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি।

Previous articleমজবুত করুন সম্পর্কের বন্ধন
Next articleঢাবিতে চলছে ৫ম বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি কনফারেন্স

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here