মীর ফরিদ। দেশের খ্যাতিমান আলোকচিত্রী। ক্রীড়া সাংবাদিকতার এক অগ্রণী নাম। শৈশব থেকেই তিনি আলোকচিত্রের সাথে যুক্ত। চট্টগ্রামে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকে বিশেষ আলোকচিত্রী হিসেবে কর্মরত আছেন। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে কথা হলো তার সাথে। নিজের পেশা, নিজের মন ও প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে তিনি মনের খবর-এর সাথে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মামুন মিজানুর রহমান।
মনের খবর: ভালো আছেন? ভালো থাকার জন্য কী করা উচিত?[
মীর ফরিদ: ভালোই আছি।ভালো থাকার জন্য প্রত্যেকের উচিত পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। বিশেষত সব সময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। সব সময় কাজের মধ্যে থাকলেই ভালো থাকা যায়।
মনের খবর: ফটোগ্রাফির সাথে আপনি কতদিন যুক্ত আছেন?
মীর ফরিদ: শৈশব থেকেই আমি ফটোগ্রাফির সাথে যুক্ত। তখন হয়তো ১৯৮০ বা ৮৯। ক্লাস ফাইভে পড়ি। তখনই আমি ক্যামেরা পেয়ে যাই। আমার এক প্রাইভেট টিউটর সেই রাশিয়ান ক্যামেরাটি উপহার দিয়েছিলেন। কৈশোরে ক্যামেরা আমার নেশা হয়ে যায়। এই নেশা থেকেই পরবর্তী সময়ে ক্যামেরাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করি। ১৯৯০ সাল থেকে ফটোজার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করছি।
মনের খবর: ছোটবেলায় কী হতে চাইতেন?
মীর ফরিদ: অনেক ধরনের স্বপ্ন ছিলো ছোটবেলায়। সেনাবাহিনীতে যাওয়ারও ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু ক্যামেরার সাথে পরিচয়ের পর সেই ইচ্ছাটা আর থাকেনি। এছাড়া সেনাবাহিনীতে ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকে না, নিয়ন্ত্রিত জীবন পছন্দ নয় বলেই সেনাবাহিনীর পরিবর্তে ফটোগ্রাফির মতো মুক্ত জীবন বেছে নিয়েছি। আমি আসলে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই বলেই কোনো সরকারি চাকুরিতেও যেতে চাইনি।
মনের খবর: প্রথম চাকুরীতে প্রবেশ করেন কখন?
মীর ফরিদ: ৯০ এর দিকে আলোকচিত্রকে পেশা হিসেবে নিই। প্রথমে সাপ্তাহিক পত্রিকায় যুক্ত ছিলাম। দৈনিকের মধ্যে প্রথম চাকুরি করি দৈনিক দেশবাংলা পত্রিকায়। এরপর নিউ নেশন, দৈনিক বাংলা ও জনকণ্ঠে চাকুরি শেষে এখন কালের কণ্ঠে বিশেষ আলোকচিত্রী হিসেবে কর্মরত আছি।
মনের খবর: কী ধরনের পরিস্থিতিতে রেগে যান? রাগ কমাতে কী করেন?
মীর ফরিদ: সব চেয়ে বেশি রাগ হয় মিথ্যা কথায়। যে কোনো অন্যায় দেখলে রেগে যাই, সেটা যেখানেই ঘটুক। এজন্য আমার অনেক ঝগড়া করতে হয়।
খুব রাগলে একা থাকি। গান শুনি। এভাবে রাগ কমে আসে। তাছাড়া আমার রাগ তাৎক্ষণিক।
মনের খবর: হতাশা বোধ করেন? হতাশা থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব?
মীর ফরিদ: মাঝে মাঝে হতাশা আসে। চারপাশের অনিয়ম দেখে খুব হতাশ হই। ব্যক্তিগত হতাশা তেমন নেই। অনেক ভালো আছি আলহামদু লিল্লাহ।
হতাশা থেকে উঠে আসার জন্য পরিবারকে বেশি সময় দিতে হবে, বন্ধু ও ঘনিষ্ঠদের সময় দিতে হবে। ভার্চুয়াল লাইফ থেকে বেরিয়ে এসে এনালগ লাইফে আগের মতো সহজ-সাধারণ জীবনে ফিরে আসতে হবে।
মনের খবর: স্মৃতিকাতরতায় ভোগেন?
মীর ফরিদ: হ্যাঁ, অবশ্যই ভুগি। সুখের স্মৃতিগুলো অনেক মনে পড়ে। দুঃখের স্মৃতিগুলোও মনে পরে প্রায়ই, আমি দুঃখের স্মৃতিগুলো ভুলে থাকতে চাই। আমার অবশ্য দুঃখের স্মৃতি কম। বাবার জন্য খুব কষ্ট হয়। তার জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি।
মনের খবর: আপনার নিজের তোলা প্রিয় ছবিগুলো সম্পর্কে বলুন।
মীর ফরিদ: প্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে দুই-তিনটা আমার খুব প্রিয়। একবার ঢাকা কলেজে একটি ছাত্র আন্দোলনের ছবি তুলেছিলাম, মাথায় রাইফেলের বাটের আঘাতে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরা এক ছাত্রকে কয়েকজন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে, নিজের তোলা এই ছবিটি আমার খুব পছন্দ। আরেকবার এক বেদে মহিলার ছবি তুলেছিলাম, যার কোলে ছিলো শিশু, শিশুর মাথার উপর ফণা তুলেছিলো সাপ, শিশুটি হাসছিলো সাপটিকে দেখে, নিজের তোলা এই ছবিটা আমার অতি প্রিয়।
মনের খবর: ফটোগ্রাফিতে ভালো করতে হলে একজন নবীন আলোকচিত্রীকে কীভাবে মন প্রস্তুত করতে হবে?
মীর ফরিদ: ফটোগ্রাফি এখন অনেক সহজ। নবীনদের বলবো ভালোভাবে জেনে আসতে। যে বিষয়ে কাজ করবে, সে বিষয়ে ভালোভাবে জেনে কাজ শুরু করতে হবে। যন্ত্র দিয়ে ফটোগ্রাফি হয় না, মেধা থাকতে হবে, নতুন কিছু করার উদ্দীপনা থাকতে হবে। নতুনদের অবশ্যই নতুন কিছু করার চেষ্টা করতে হবে।
মনের খবর: ফটোগ্রাফি পেশায় আপনার অর্জন কতটুকু?
মীর ফরিদ: এই পেশায় এসে আমি নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট। ফটোসাংবাদিকতা করার সুবাদে দেশ-বিদেশের নানা ঘটনার সাক্ষী হতে পেরেছি। নানা পেশার নানা মানুষের সাথে যেভাবে মিশতে পেরেছি, অন্য পেশায় যুক্ত থাকলে এই সুযোগ এতটা পেতাম না। বাংলাদেশের নানা রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ঘটনায় উপস্থিত থাকতে পেরেছি। ২১ আগস্ট বোমা হামলার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেই ছিলাম, রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনার সময়ও কাছেই ছিলাম, এই দুই ঘটনার ছবি শুরুতে আমিই তুলি।দুই নেত্রীর সাথেই অসংখ্য স্থানে গিয়েছি ছবি তুলতে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সারা দেশ ঘুরেছি।
মনের খবর: ফটোগ্রাফি কেন মনের জন্য উপকারী?
মীর ফরিদ: আলোকচিত্র অবশ্যই মানুষের মনে আনন্দ দেয়। ভালো ছবি তুলতে পারলে আনন্দ হয়, দেখতে পারলেও আনন্দ হয়। মনের অব্যক্ত নানা কথা ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়, এতে মনের চাপ কমে। ভালো ছবি, নিসর্গের সৌন্দর্যের ছবি দেখে অনেকেই মনে প্রশান্তি অনুভব করেন।
মনের খবর: সাধারণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আলোকচিত্রীদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
মীর ফরিদ: আলোকচিত্রীদের উচিত ইতিবাচক জিনিসগুলো বেশি বেশি প্রকাশ করা। এমন ছবি বেশি বেশি প্রকাশ করা উচিত, যা দেখে মানুষ শিখতে পারে। বিভৎস ছবির ব্যাপারে নিয়ন্ত্রন আনতে হবে, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো বিভৎস ছবি প্রকাশ করা যাবে না। এ বিষয়ে ফটোগ্রাফার ছাড়াও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সচেতন হতে হবে।
মনের খবর: আপনার আগামী স্বপ্ন কী?
মীর ফরিদ: অনেকগুলো দলীয় আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নিলেও এখনো একক প্রদর্শনী করিনি। আমার এত বছরের কাজ গুছিয়ে একটি একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী করতে চাই। এছাড়া নির্বাচিত ছবি নিয়ে বইও প্রকাশ করতে চাই।
মনের খবর: দেশবাসীর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে মিডিয়া এবং সেইসাথে আলোকচিত্রীরা কী ভূমিকা রাখতে পারে?
মীর ফরিদ: জীবনের সুন্দর দিকগুলো বারবার দেখানো, বিভৎস ছবি প্রচার থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আলোকচিত্রীরাও জীবনের সুন্দর দিকগুলো তুলে ধরে প্রচার মাধ্যমে ছবি প্রকাশ করলে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে। ছবিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অনেকেই আরাম বোধ করেন। প্রকাশের ক্ষেত্রে পাঠক-দর্শকদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি বিবেচনায় রেখে প্রচার করতে হবে।