৬০ বৎসর বয়সের ঊর্ধ্বে ১৫% মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বার্ধক্যজনিত অক্ষমতার কারণগুলোর মাঝে ৬.৬% মানসিক এবং স্নায়বিক কারণে হয়ে থাকে। ২০১৫-২০৫০ সালের মধ্যে ৬০ বৎসরের বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা হবে দ্বিগুণ (অর্থাৎ, বর্তমানে আছে ১২%, তা বেড়ে হবে ২২%)।
বার্ধক্যে মানসিক রোগের কারণসমূহ
- বয়সের সাথে সাথে মানুষের সার্বিক কর্মক্ষমতা লোপ পেতে থাকে; চুলে পাক ধরে, দাঁত পড়ে, ত্বকে ভাঁজ পড়ে, হাড় ক্ষয় হতে থাকে, প্রজনন ক্ষমতা থাকে না বা কমতে থাকে।
- কর্মজীবন থেকে অবসরে যায়। সন্তানগণ বড়ো হয়, তাদের নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়, অনেক সময় জীবিকার্জনের জন্য দূরে চলে যায় বা কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে; ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বৃদ্ধ হলে আত্মবিশ্বাস কমে যায়, একাকিত্বের অনুভূতি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি করে।
- মধ্যবয়স থেকেই মানুষ জীবনের হিসেব নিকেষের খাতা খুলে বসে; কী পেলাম, কী পেলাম না এসব ভেবে ভেবে অস্থির থাকে, মানসিক চাপ তৈরি হয়।
- বয়স হলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, বিভিন্ন প্রকার দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগ যেমন-ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ ও হাড়ক্ষয়রোগ ইত্যাদি দেখা দেয়। যেহেতু, মন আর শরীর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তাই একটি খারাপ থাকলে অন্যটিও খারাপ থাকে। যেমন-হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে বিষণ্ণতার হার শারীরিকভাবে সুস্থ ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি। আবার যাদের হৃদরোগ ও বিষণ্ণতা রোগ আছে তারা যদি বিষণ্ণতা রোগের চিকিৎসা না নেন, তাহলে তা হৃদরোগের পরিণতিকে খারাপের দিকে নিয়ে যাবে।
- তাছাড়া দ্রুত নগরায়ন, ভৌগোলিক পরিবর্তন, শিল্পায়ন, সংষ্কৃতিতে পাশ্চাত্যের প্রভাব, যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গঠন ইত্যাদি বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
- বার্ধক্যজনিত মানসিক রোগের মাঝে বিষণ্ণতা রোগ, উদ্বেগজনিত রোগ, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগ, দেরিতে শুরু হওয়া সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার বা দ্বি-প্রান্তিক আবেগীয় রোগ, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বার্ধক্যে মানসিক রোগের সাধারণ সতর্কতামূলক লক্ষণসমূহ হচ্ছে
- একটানা হতাশা/ বিষণ্ণতায় ভোগা
- ইতিবাচক আবেগ অনুভব না করা
- অতিরিক্ত ঘুম, অথবা ঘুম না হওয়ার সমস্যা থাকা
- আত্মঘাতী চিন্তা করা
- ক্ষুধা, শক্তিস্তর অথবা মেজাজে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসা
- মনোযোগে সমস্যা হওয়া, অস্থির থাকা
- অতিরিক্ত চাপ বা উদ্বেগ অনুভূতি তৈরি হওয়া
- স্বল্পমেয়াদি বা সাম্প্রতিক স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া বা লোপ পাওয়া
- রাগ, আন্দোলন বা আগ্রাসন বৃদ্ধি পাওয়া
- অবাধ্যতামূলক আচরণ করা
- অস্বাভাবিক আচরণ বা চিন্তা করা
- স্থায়ী পাচক সমস্যা, শরীর-মাথা ব্যথা, যা সুনির্দিষ্ট শারীরিক রোগের কারণে হচ্ছে বলে প্রমাণ বা ব্যাখ্যা করা যায় না-এমন লক্ষণ দেখা দেয়া।
বৃদ্ধদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে যা করণীয়
- বৃদ্ধদের সেবা-শুশ্রুষার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসকদের মানসম্মত প্রশিক্ষণ প্রদান।
বয়সজনিত দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও শারীরিক রোগ, মাদকাসক্তি ইত্যাদির সুব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। - বয়সবান্ধব সেবা এবং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
- বয়স্কদের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
- মানসিক ও শারীরিক রোগ দ্রুত শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা প্রদান অপরিহার্য।
- মনোসামাজিক সহায়তা, কাউন্সেলিং এবং ঔষধের সমন্বয়ে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।
- যেহেতু ডিমেনশিয়া সম্পূর্ণ ভালো করার কোনো ঔষধ আবিষ্কার হয়নি, সেহেতু ডিমেনশিয়া রোগী এবং তাদের পরিচর্যাকারীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
- বৃদ্ধদের নির্যাতন বন্ধে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা।
- কমিউনিটিতে বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা।
- বয়স্কদের মাঝে ঝুঁঁকিপূর্ণ আচরণ শনাক্তকরণ এবং তার ব্যবস্থাপনা করা।
- বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবার সদ্ব্যবহার করা। কারণ, যদিও আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার সীমিত ব্যবস্থাপনা রয়েছে, যতটুকু রয়েছে তারও পুরোটা ব্যবহৃত হয় না অসচেতনতা, অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের কারণে।
মানসিক স্বাস্থ্য এবং সার্বিক সুস্থতা বৃদ্ধ বয়সেও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা গুরুত্বপূর্ণ অন্য বয়সে। তাই, যদি কারো পরিবারের বয়স্ক সদস্যের মাঝে মানসিক রোগের উপসর্গ দেখা দেয়, তবে যত দ্রুত সম্ভব প্রাথমিক চিকিৎসক অথবা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করা উচিত, রোগ গুরুতর হওয়ার আগেই সম্ভাব্য মানসিক রোগ নিরূপণ ও সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করা উচিত।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে