অভিবাসন একটি সুপরিচিত বৈশ্বিক বিষয়। বিভিন্ন দেশে, নতুন স্থানে অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে আদিমকাল থেকেই মানুষ ছুটে চলেছে এবং ইতিহাস-জুড়ে এর পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। কখনো মানুষ নিজ ইচ্ছায় উন্নত জীবনের আশায়, আবার কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, ভূ-রাজনৈতিক কারণ বা জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে নিজের আজন্ম পরিচিত স্থান ত্যাগ করে। নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সাথে তাদের নিজস্ব সম্প্রদায়ের সদস্যদের অনুপস্থিতি মানসিক চাপের কারণ হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের আনুমানিক এক কোটি তিরিশ লাখ মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। প্রায় আট লাখ মানুষ প্রতি বছর দেশ ছাড়ছে। যার অধিকাংশ অদক্ষ শ্রমিক। দেশ ছাড়া মানুষের মধ্যে দক্ষ পেশাজীবীর সংখ্যা কম। প্রায় এক লাখ নারী শ্রমিক প্রতি বছর দেশ ছাড়ছে। এই শ্রমিক শ্রেণীর অধিকাংশ নিজ দেশে থাকা অবস্থায় বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষার সুযোগ থেকে সুবিধা বঞ্চিত হয়। আবার বিদেশে যাবার পর কম দক্ষ চাকরি, কম মজুরি এবং ঝুঁকি সম্পর্কিত তথ্যের অভাব, বৈষম্য, শোষণ এবং শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় অপর্যাপ্ত সেবা তাদের বিধ্বস্ত করে তোলে। আবার নারী শিশুদের একটি অংশ পাচারের ঝুঁকিতে থাকে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অভিবাসন, শরণার্থী, মানব পাচার প্রতিটি দেশকে কম বেশি প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ছয় কোটি বাস্তুচ্যুত মানুষের মধ্যে চল্লিশ শতাংশ প্রধানত সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন থেকে এসেছে।
আঞ্চলিকভাবে এটি আশ্রয় দানকারী প্রথম সারির দেশগুলিকে যথেষ্ট চাপের মধ্যে রেখেছে। শরণার্থীদের জন্য এই সংকটের ফলে তাদের অধিকার, তাদের জীবনযাত্রার মান এবং শিক্ষাগত মান এবং তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ সবই নিম্মগামী। শরণার্থী/অভিবাসী/আশ্রয়প্রার্থী হয়ে ওঠা একটি জটিল মানসিক সামাজিক প্রক্রিয়া। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শরণার্থীরা করুণ পরিস্থিতিতে মানবেতর সময় পার করছে। মানব পাচার সম্পর্কিত ঘটনার জন্য অসংখ্য মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশুরা স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শরণার্থী, অভিবাসী, আশ্রয়প্রার্থী অথবা মানব পাচারের শিকার সকলের জন্য যেটি অনন্য তা হল নতুন বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারার ক্ষমতা। এই খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা সকলের এক নয়। আবার বৃহত্তম অংশের স্বাভাবিক জীবন চালনের জন্য নতুন করে জীবন যুদ্ধে নামতে হয়। নানামুখী চাপের জন্য এই জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে থাকে।
বিশ্বব্যাপী আশ্রয়প্রার্থী, উদ্বাস্তু এবং অভ্যন্তরীণভাবে স্থানান্তরের পথকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রিমাইেগ্রশন অর্থাৎ যাবার আগের প্রস্তুতি, মাইগ্রেশন বা অন্য স্থানে যাবার প্রক্রিয়া এবং পোস্ট মাইগ্রেশন বা নতুন স্থানে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া। প্রতিটি পর্বে নির্দিষ্ট কিছু ঝুঁকি রয়েছে।
প্রিমাইগ্রেশন সমেয় প্রায়ই ব্যক্তির স্বাভাবিক সামাজিক ভূমিকা এবং বিভিন্ন সম্পর্কের ব্যাঘাত ঘটে। আবার অভিবাসনের সময় অভিবাসীরা তাদের নাগরিকত্বের অবস্থা সম্পর্কে দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যায়। বিশেষ করে যারা আশ্রয় চাচ্ছে তারা অপ্রতুল সম্পদ এবং স্থানীয় সহিংসতাসহ শরণার্থী শিবিরে দীর্ঘ সময় কাটায়। কিছু দেশে আশ্রয়প্রার্থীদের কেন্দ্রে আটক করে রাখা হয়, যা ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসকে নষ্ট করে। যেসব শিক্ষার্থীরা দরিদ্র দেশ থেকে ধনী দেশে যায় তারাও বাধার সম্মুখীন হয়। তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পাশাপাশি টিউশন ফি নিশ্চিত করতে হয়। এটি ছাত্র এবং তার পরিবারের জন্যও দীর্ঘস্থায়ী চাপ হিসেবে কাজ করে।
আবার নতুন জায়গায় নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে রয়েছে ভাষা এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য। এর ফলে অনেকেই না চাওয়া সত্ত্বেও সমাজ থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলে বা আলাদা হয়ে যেতে হয়। প্রথম প্রজন্ম অভিবাসীরা যদিও বা নিজের সংস্কৃতির কিছুটা ধারণ করতে পারে, দ্বিতীয় প্রজন্মের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা উল্লেখযোগ্য। পারিবারিক কাঠামো, ঘরে বাইরের পার্থক্য, সমাজের মূল ধারায় মিশতে না পারা, নিজেকে সমাজের অংশ ভাবতে না পারা এ বিষয়গুলো অভিযোজন, প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। অভিবাসন এবং পুনর্বাসনের অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত চাপ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে বা বাড়িয়ে তুলতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, পোস্টট্রোম্যাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, ঘুমের সমস্যা, শিশুদের আচরণগত সমস্যা, নেশা জাতীয় দ্রব্যের অপব্যবহার, আত্মঘাতী ভাবনা বা আত্মহত্যার মতো ঘটনা।
মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যাপক প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও, অভিবাসী এবং শরণার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় পর্যাপ্ত বাধা রয়েছে। ভাষার বাধা সঠিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। প্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের অভাব, অপর্যাপ্ত সম্পদ, বিদ্যমান মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং সম্পদ (যেমন পরিবহণ, বীমা এবং শিশুর যত্ন) সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসহ নানাবিধ কারণে মানসিক সমস্যা জর্জরিত মানুষগুলো সেবা পাওয়া হতে বঞ্চিত হয়।
মনস্তাত্ত্বিক চাপের বিরুদ্ধে লড়াই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক অবিচার মানুষকে এক অঞ্চল ছেড়ে অন্য অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য করে। এটি রোধে ন্যায়বিচার সামাজিক সমতা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এখানে বিশ্বনেতাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অভিবাসনের পর হোস্ট দেশের উচিত অভিবাসীদের প্রতি নমনীয় মনোভাব রাখা। তাদের নতুন পরিবেশে মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি রাখা উচিত। এই ধরনের পরিষেবাগুলি সরবরাহ করতে ব্যর্থতা কেবল পরে সমস্যাগুলিকে জটিল করে তোলে। জনসংখ্যার রোগের বোঝা কমাতে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও কল্যাণের জন্য ‘স্বাস্থ্যের সংস্কৃতি’ গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষিত হতে হবে এবং বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় রোধে জাতীয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের এখনই সময়।
ডা. সুলতান-ই-মনজুর
সাবেক সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ, সিরাজগঞ্জ।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৯ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে