ডা. আসাদুল বারী চৌধুরী অমি
এমডি ফেইজ-বি রেসিডেন্ট, সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
কেইস স্টাডি
তিমুর (ছদ্মনাম) পেশায় একজন সফটওয়্যার ডেভেলপার। কিশোর বয়সে তিনি সঙ্গদোষে পর্নোগ্রাফির প্রতি বেশ আসক্ত হয়ে পড়েন। শুরুটা ছিল কেবল সময় কাটানোর জন্য। পরবর্তিতে ধীরে ধীরে এর পেছনে অনেক সময় নষ্ট হতো। নিজেই বুঝতে পারতেন সবার সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় থাকছে না। আতাবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একঘেয়েমি জীবন ও আতাবিশ্বাসের অভাব-দুইয়ে মিলিয়ে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায় পেয়ে বসেছিল। বছর কয়েক বাদে যখন চাকরিতে ঢুকলেন, সামাজিক জীবন গোছানো ছিল। কিন্তু এই পর্নোগ্রাফি আসক্তির কারণে পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকতে পারতেন না. মেজাজ খিটখিটে থাকতো, অন্যদের সাথে অকারণেই ঝগড়া করতেন, গালিগালাজ করতেন। এ বিষয়ে তিনি এখন লজ্জিত, অনুতপ্ত। অতঃপর মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছেন।
আসক্তি রহস্যময় এক বস্তু। এটি কোনো কিছুর প্রতি তীব্র আগ্রহ বা কৌতূহলের চেয়েও বেশি কিছু। এটা এমন এক অবস্থা যা মস্তিষ্ক ও শরীরে পরিবর্তন আনে এবং কাউকে তা চালিয়ে যেতে বাধ্য করে এবং এমন কাজের দিকে ধাবিত করে যা তার জন্য সমূহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। পর্নো আসক্তি এমনই ধরনের এক আসক্তি। এতে ব্যক্তির আচরণের যেমন পরিবর্তন হয়, তেমনই ব্যক্তিত্ব গঠন ও বিকাশেও তার ছাপ পড়ে। পর্নো আসক্তি কেন স্বাভাবিক নয়? যৌনতা আসলে মানুষের জীবের আদিম প্রবৃত্তি, যা টিকে থাকা ও বংশবৃদ্ধি রক্ষার্থে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। সৃষ্টিগতভাবে মানুষের মস্তিষ্ক এমন ছবি বা ভিডিওর ক্ষেত্রে সহজে কম-বেশি সাড়া দেয় যা যৌনতা ধারণ করে। তাই মানুষ পর্নগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। পর্নগ্রাফির অল্প ব্যবহার যৌনাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি ও সঙ্গী ভিত্তিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটলেও দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার বা এর প্রতি আসক্তি মানুষের মস্তিষ্ক এবং যৌন জীবনের জন্য মারাত্যক ক্ষতির কারণ হয়।
ডিভাইস ও পর্নো আসক্তি
যখন কেউ কোনো ডিভাইসের (মূলত স্মার্টফোন) অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে নিজেকে বিরত থাকতে পারে না, তাকে “মোবাইল আসক্তি (smartphone addiction)” বলা হয়। দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ তরুণ স্মার্টফোনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে এটি প্রায় আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে-দেশের মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের এক গবেষণায় সম্প্রতি এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এর অর্থ, যদি তারা সবসময় মোবাইল ফোন হাতে না পায় তবে ‘আতঙ্কিত’ বা ‘বিচলিত’ হয়ে পড়ে। মোবাইলে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হয় অত্যধিক পরিমাণে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, মেসেঞ্জার ব্যবহার তথা কথোপকথন, ডেটিং অ্যাপস, শর্টস ও রিলস দেখা, গেইম খেলা ও এতে বিনিয়োগে। তবে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর সবচেয়ে মারাত্যক ও ভয়ংকর আসক্তি তা হচ্ছে-অনলাইন পর্নো ভিডিও দেখার আসক্তি। এ ধরনের আসক্তিমূলক আচরণের সাথে অন্যান্য সমস্যাও দেখা দেয়। যেমন-শারীরিক ও মানসিক চাপ, হতাশা, বিটখিটে মেজাজ, ঘুমের অভাব ও স্কুলের ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়া।
পর্নোগ্রাফি দেখলে কী পরিবর্তন হয়?
একটি স্বাভাবিক, সুস্থ, সঙ্গীভিত্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যৌন সঙ্গমের চাহিদাটাই শুধু মুখ্য থাকে না; সেখানে অনুভব থাকে; স্পর্শ থাকে; পরস্পরের চোখে তাকানো থাকে; পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকে। কিন্তু পর্নের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বাস্তব সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেগুলো সাধারণত হয় না-এমন ভঙ্গিমা ও উপায়ে যৌনতাকে তুলে ধরা হয়। তাই মানুষও সহজেই এতে আকৃষ্ট হয়। উপরন্তু এর সাথে দৈহিক ও মানসিক সুখের অনুভূতি যুক্ত থাকে।
স্বাভাবিক সঙ্গীভিত্তিক সম্পর্কের সময় ও পর্নোগ্রাফি দেখা-উভয় সময়ই আমাদের মস্তিষ্কে কিছু হরমোন নিঃসৃত হয়। আর এই হরমোনের উচ্ছ্বাসই আমাদের ভালো লাগার অনুভূতি দিয়ে থাকে। ডোপামিন ও এন্ডরফিন এমনই দুটি হরমোন। পর্নোগ্রাফি দেখলে মস্তিষ্কে ডোপামিনের নিঃসরণ স্বাভাবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেমন হওয়ার কথা, তার তুলনায় অনেক বেশি হয়। এই অধিক ডোপামিনের উচ্ছ্বাসকে ‘ডোপামিন স্পাইক’ বলে। দীর্ঘদিন ধরে পর্নো দেখতে দেখতে মস্তিষ্ক সেগুলোতে বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ততদিনে আমাদের মস্তিষ্কের ডোপামিন রিসেপ্টরগুলো বেশি বেশি ডোপামিন প্রবাহে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তখন কম পরিমাণ ডোপামিন ও এন্ডরফিন তাকে আগের সেই ভালো লাগার অনুভূতি দিতে পারে না। তাই পর্নো দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মানুষগুলো ক্রমাগত অতিরিক্ত ডোপামিনের স্বাদ পাবার জন্য পর্নো দেখা বাড়িয়ে দেয়। তাই পর্নো দেখায় সুখ খুঁজে পেলেও বাস্তবে সুখ মেলে না। এই অবস্থাকে বলে ‘একমুখী নিউরোলজিক্যাল সুপার হাইওয়ে’। তাছাড়া পর্নো আমাদের যৌন ফ্যান্টাসিকে শাখা-প্রশাখা ছড়াতে সাহায্য করে। ফলাফল হিসেবে বাস্তবে সেটা প্রায়ই সম্ভব হয়ে ওঠে না বলে সঙ্গীর সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
পরিসংখ্যান মতে, নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৪-৬% মানুষ শুধু পর্নো দেখার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করে। কিনসে ইন্সটিটিউটের (kinsey Institute) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৬% পর্নো আসক্ত মানুষ মাসে ৫ ঘণ্টা বা তার কম সময় পর্নো দেখে থাকে, আর ১৬% মাসে ১৫ ঘণ্টা বা তার কম সময় পর্নো দেখে।
পর্নোগ্রাফি আসক্তি বিশ্বব্যাপী সমস্যা হলে বাংলাদেশও কিন্তু এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। এদেশে ইন্টারনেটের হাতেখড়ি হয় ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে। এরপর ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলের আওতায় চলে আসে। ২০১৫ থেকে দেশব্যাপী মোবাইল অপারেটরগুলো ক্রমান্বয়ে দ্রুতগতির ‘থ্রিজি প্রযুক্তি’ চালু করে। সেই সাথে ব্রডব্যান্ড ও ওয়াইম্যাক্স সংযোগের উচ্চগতির অসীমিত ইন্টারনেটও যুক্ত হয়। ফলশ্রুতিতে দেশে ব্যক্তিগত মোবাইল ও কম্পিউটারের ব্যবহারও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ইন্টারনেট ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় শুধু পর্নো দেখা না, ছোটো পরিসরে বাংলাদেশ পর্নো বানানো এবং পর্নোগ্রাফি আর্টিকেল তৈরির সাথেও জড়িয়ে পড়ে।
কেন এই পর্নো আসক্তি?
কেবল স্ট্রেস (stress) বা মানসিক চাপ কমাতে অনেকেই পর্নো ভিডিও দেখে থাকে। তাছাড়া যৌন তৃপ্তির অসম্পূর্ণতা, ভিন্ন ধারার রুচির সাথে পরিচিত হবার আকাঙ্ক্ষা, সম্পূর্ণ জৈবিক কারণ যা পর্নো দেখার সময়, মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে পরিবর্তিত করে, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন, বিষণ্ণতা থেকে দূরে থাকতেও কেউ কেউ পর্নগ্রাফিতে মগ্ন থাকে।
আপনার পর্নো আসক্তি কীভাবে বুঝতে পারবেন?
আপনি যদি আপনার পর্নো দেখার বিষয়ে উদ্বিগ্ন হন, তবে কিছু সতর্কতাজনিত লক্ষণ জেনে রাখা ভালো।
আপনার পর্নো আসক্তি আছে বুঝবেন যদি আপনি-
- প্রায়শই পর্নের চিন্তায় আচ্ছন্ন হন, এমনকি যদি এটি সক্রিয়ভাবে নাও দেখেন।
- কর্মক্ষেত্রে বা সামাজিক পরিস্থিতিতেও মোবাইলে পর্নো দেখেন।
- পর্নো দেখার জন্য লজ্জিত, অপরাধী বা বিষণ্ণ বোধ না করেন।
- আপনার সঙ্গী বা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে এগুলো লুকিয়ে রাখেন।
- পর্নোগ্রাফি জড়িত না থাকলে সঙ্গীর সাথে স্বাভাবিক যৌনতৃপ্তি অনুভব করেন না।
- পর্নো দেখা বন্ধ করতে বলা হলে বিরক্ত হন।
- পর্নো দেখার কারণে সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
- পর্নো দেখা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন কিন্তু সফল হননি।
খুব বেশি পর্নোগ্রাফি আসক্তি আসলে কী ধরনের ক্ষতি করে?
পর্নো মূলত এক ধরনের অস্বাস্থ্যকর যৌন অভিব্যক্তি। এই অভ্যেস মানুষের মধ্যে অবাস্তব আকাঙ্ক্ষা ও আসক্তি সৃষ্টি করে। যুক্তরাষ্ট্রের কেইস ওয়েস্টার্ন রিভার্স ইউনিভার্সিটির এক রিপোর্ট অনুযায়ী, পর্নো আসক্তির ধারণাটাই একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষেকরা জানান, যারা বিশ্বাস করে তারা পর্নগ্রাফিতে আসক্ত তারা নানান মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, যেমন-দুশ্চিন্তা, ক্রোধ, উৎকণ্ঠা অনুভব করে থাকে। এর পাশাপাশি যে সমস্যাগুলো
হয়-
- যৌন উত্তেজনা কমে যাওয়া যাকে ‘সেক্সচুয়াল ডিজফাংশন’ বলে
- অর্গাজম বা তৃপ্তি লাভ না হওয়া
- যৌনাঙ্গে অনুভূতি বা সেনসিটিভিটি কমে যাওয়া
- ক্রমাগত স্ব-মেহনের ফলে যৌনাঙ্গের নার্ভএন্ডিংগুলো (স্নায়ু প্রান্ত) এবং ছোটো-বড়ো রক্তনালিগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া
- পর্নো দেখে সুখ খুঁজে পেলেও বাস্তব জীবনে
- যৌনাকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া অস্বাভাবিক যৌনাচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়া
- মস্তিষ্কের গ্রে-ম্যাটেরিয়াল কমে যাওয়া অর্থাৎ, স্মৃতিলোপ
- হতাশা, উদ্বেগ বা মানসিক চাপে ভোগা
- সামাজিক সম্পর্কের অবনতি ঘটা, সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে যাওয়া
- মনোযোগের ঘাটতিজনিত সমস্যা দেখা দেওয়া
অ্যান্টি-সোশ্যাল পার্সোনালিটি কী? পর্নো আসক্তির সাথে এর কী সম্পর্ক?
‘অ্যান্টি-সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার’ বা অসামাজিক ব্যক্তিত্ব ব্যাধির একটা মূল বৈশিষ্ট্য হলো অপরাধমূলক আচরণ করা। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত কারো অপরাধ করার জীবনের কোনো এক পর্যায়ে আইনগত জটিলতায় সম্মুখীন হওয়ার বেশ উচ্চ ঝুঁকি থাকে।
অ্যান্টি-সোশ্যাল পার্সোনালিটি রোগ নির্ণয়ের জন্য আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (ASA) কর্তৃক প্রকাশিত DSM-5 অনুযায়ী, কমপক্ষে ৮ বছর ধরে এমন কোনো আচরণে লিপ্ত হয়ে আইন ভঙ্গ করা যার ফলে গ্রেপ্তার হতে হয়, স্বার্থ লাভের জন্য মিথ্যা, প্রতারণার কারসাজির আশ্রয় নেওয়া, আবেগপ্রবণ আচরণ করা, বিরক্তি ও আগ্রাসী মনোভাব, এমন আচরণ যা প্রায়ই অন্যদের আহত করে বা মারামারির উদ্রেক করে, স্পষ্টতই নিজের ও অন্যদের নিরাপত্তা উপেক্ষা করা, দায়িত্বহীনতা এবং কর্মের জন্য অনুশোচনার অভাব বোধ হওয়া।
আমাদের মস্তিষ্কের পুরস্কার কেন্দ্রের (Reward center) অংশের নাম প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স (pre frontal cortex)। পর্নো দেখার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনিভাবে কাজ করে প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স। যাবতীয় যত বদ অভ্যাস এবং আসক্তিগুলোকে কঠোর নজরদারি করে এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য যারপরনাই ব্যস্ত থাকে। পর্ণের প্রভাবে মস্তিষ্কের স্ট্রেইটাম অংশের (straitum) আয়তন কমে যায়। সেই সাথে স্ট্রেইটাম এবং প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স অংশের মধ্যে যোগাযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং যা পরবর্তিতে সিদ্ধান্তহীনতা, অনিয়ন্ত্রিত আচরণের দিকে ঠেলে দেয়।
পর্নো আসক্তি ব্যক্তির আতা-নিয়ন্ত্রণকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। মস্তিষ্কের MRI স্ক্যান করে দেখা গেছে, এই ধরনের ব্যক্তিত্বে ফ্রন্টাল ও প্যারাইটাল অঞ্চলের অস্বাভাবিক এক সংযোগ স্থাপিত হয়-এই জায়গাগুলো আমাদের মনোযোগ, আতা-নিয়ন্ত্রণ ও দ্বন্দ্ব নিরসন করে। সেই সাথে সেরেবেলামও বিবেকবোধ হ্রাস ও সিদ্ধান্তহীনতার ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা পালন করে। ফলশ্রুতিতে পর্ণের মতো আসক্তিতে জড়িয়ে পড়া।
সমাধান কীভাবে?
প্রথমেই যা করতে হবে-যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের (মূলত মোবাইল) পরিমিত, প্রয়োজনমতো ও সঠিক কাজে ব্যবহার। এর জন্য মোবাইল ব্যবহার করার জন্য নির্দিষ্ট টাইম-টেবিল সেট করা এবং শুধু ওই সময়টুকুতেই ব্যবহার করা, নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে একেবারেই ব্যবহার না করা, সাধারণ কী-প্যাড মোবাইলের ব্যবহার করা, যতটা সম্ভব মোবাইলে কম অ্যাপস রাখা, মোবাইল অ্যাপের জরুরি নোটিফিকেশন চালু রাখা, অপ্রয়োজনীয় অ্যাপগুলোকে বন্ধ রাখা, কাজ বা পড়াশোনার সময় অথবা রাতে ঘুমানোর সময় মোবাইল দূরে সরিয়ে রাখা, একাকিত্ব দূর করা, বই পড়ার অভ্যাস করতে হবে, ব্যায়াম, শারীরিক অনুশীলনের জন্য সময় রাখা বা জিমে যাওয়া, পার্কে ঘুরে আসা, নতুন কোনো কোর্স করা বা ঘরের কাজ করা।
গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যান্য আসক্তিগুলোর মতো পর্নোগ্রাফি আসক্তি থেকেও নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব। প্রয়োজন মনোরোগচিকিৎসক ও সাইকোলোজিস্টের পরামর্শ গ্রহণ ও পারিবারিক সহযোগিতা। পর্নো ছেড়ে দেওয়ার পর শুরুতে একই রকম মানসিক কষ্ট ও বিষণ্ণতা ভর করতে পারে, যেটা অন্য ড্রাগ ছেড়ে দেবার পরও দেখা যায়। একে ‘উইথড্রয়াল সিম্পটম’ বলে। তখন ভয় না পেয়ে বরং জীবনের অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে বেশি সময় দেওয়া উচিত এবং মন ভালো করে এমন সাংস্কৃতিক বা বিনোদনমূলক কোনোকিছুর সাথে যুক্ত হওয়া যেতে পারে। একবার বেরিয়ে আসতে পারলে আতত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে যায় এবং সুস্থ ও সফল জীবন কাটানো যায়।
প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কী করা যেতে পারে
মূলধারার সংস্কৃতি অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক পর্যায়ে আন্তরিকতার সাথে সন্তানকে বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই যৌনতা সম্পর্কে সুস্থ ও স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া। শুধুমাত্র ‘কী করা যাবে না’ বলে, বরং ‘কেন করা যাবে না’ বা ঠিক কী করা উচিত এবং কতটা করা উচিত সে সম্পর্কে উপযুক্ত ধারণা দেওয়া।
পর্নগ্রাফির ব্যবহার কমাতে সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে পর্নো সাইটগুলো বাংলাদেশ থেকে প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া অথবা অন্যান্য দেশের ন্যায় নির্দিষ্ট বয়স যাচাইয়ের ব্যবস্থা রাখা। তবে পর্নগ্রাফির ওয়েবসাইট বন্ধ করে হয়ত সাময়িক সুবিধা মিলবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সুফলের জন্য এর চাহিদা কমাতে হবে। বাড়িতে বাচ্চাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তার ব্যবহৃত ডিভাইসে “প্যারেন্টাল কন্ট্রোল চালু করা। যারা ইতিমধ্যে এ ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য সরকারিভাবে পৃথক হাসপাতাল, পুনর্বাসন কেন্দ্র ও সাইকোথেরাপি কেন্দ্র নির্মাণ।
পর্নো আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে বিকল্প আনন্দের উৎস খুঁজে বের করতে হবে। সংগীত, সিনেমা, শরীরচর্চার মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। মানসিক সমস্যাগুলো অবহেলা না করে বরং পেশাদার পরামর্শ নেওয়া উচিত। নৈতিকতার চর্চা বা ধর্মীয় চর্চাও পর্নোগ্রাফি থেকে বিরত রাখতে কার্যকর, তবে সেটাও সাময়িক।
চিকিৎসা পদ্ধতি
পর্নো আসক্তি ও অ্যান্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি রোগে আক্রান্ত রোগীদের আজকাল সাধারণ মানসিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রেই চিকিৎসা করা সম্ভব। তবে অনেক সময় চিকিৎসা আরম্ভ করতে কোর্টের অনুমতি বা আদেশের প্রয়োজন হয়।
চিকিৎসা শুরু করার আগে রোগীর বয়স, পূর্ব ইতিহাস, পারিবারিক ইতিহাস ও অন্য কোনো অসুখ আছে কিনা অথবা রোগী মাদকাসক্ত কিনা তা জানা দরকার হয়।
এসব ক্ষেত্রে পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবদের সংলগ্নতা দরকার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। যদিও ঔষধের ভূমিকা খুব কম তবুও কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টি-সাইকোটিক ও অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট (এসএসআরআই গ্রুপের) ঔষধ, মন-মেজাজ পরিবর্তনের জন্য কার্বামাজেপাইন, লিথিয়াম ক্রোধ ও হঠকারি আচরণ কমায়। ঔষধ ছাড়াও থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা বিভিন্ন পদ্ধতিতে করা যায়-টকিং বা বাচন থেরাপি, CBT-চিন্তা পদ্ধতি পাল্টানোর মাধ্যমে ব্যবহার পাল্টানো, Mentalization therapy-থেরাপিস্ট রোগীকে তার আচরণের সাথে কাজের ওপর প্রভাবকে কীভাবে পাল্টানো যায় সে ব্যাপারে সাহায্য করেন,
Democratic therapeutic communities (DTC)-রোগী নিজের ঝুঁকিগুলোকে শনাক্ত করে তার আবেগ ও চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এছাড়াও শিক্ষাগত ও কারিগরি ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করা প্রয়োজন। সেই সাথে আতা-নিয়ন্ত্রণমূলক পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। মেডিটেশন, রিল্যাক্সেশন ব্যায়াম এবং দলগত ভূমিকায় কাজ করার অভ্যাস বাড়ালে অনেকটাই সমস্যা কমে আসে।
মনে রাখতে হবে কোনো কিছুর অতিরিক্ত ভালো না। যেকোনো আসক্তিই ক্ষতি বয়ে আনে। সেটা সেলফোন হোক আর পর্নো আসক্তি হোক। যেহেতু ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ও ইন্টারনেটের অতিমাত্রায় অপব্যবহারই আমাদের জীবনে পর্নের মতো মারাত্মক সমস্যা ডেকে আনে ও ব্যক্তিত্বের অসুখের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে, আমাদের শুরু থেকে সতর্ক থাকতে হবে। নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশে তথা জাতির ব্যক্তিত্ব বিকাশে আসক্তিমুক্ত নির্মল, সুস্থ, অপঙ্কিল জীবনযাপনে অভ্যন্ত হতে হবে। ভবিষ্যত প্রজন্মের সার্বিক সুস্থতা এর মাঝেই নিহিত।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।
সিরিয়ালের জন্য ভিজিট করুন- এপোয়েন্টমেন্ট
আরও পড়ুন: