বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিদিনই যৌথ পরিবার ভাঙছে, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন একক পরিবার। খুব বেশি দিন আগের কথা নয় আমাদের দেশে পরিবার বলতে চোখে ভাসত দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুপুু, চাচাত ভাই-বোনের বিশাল পরিবার। কিন্তু এখন এরকম পরিবারের সংখ্যা হাতেগোনা। তাই দাদা-দাদির সাথে থাকে এমন শিশুও আজকাল কম পাওয়া যায়। যদিও শিশুর মানসিক বিকাশে দাদা-দাদী, নানা-নানি এক বিশাল ভূমিকা পালন করে থাকেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে দাদাদাদি, নানা-নানির সম্পর্ক মধুর। তাঁদের কাছ থেকে শিশুরা নানারকম উপহার সামগ্রী পায়, গল্প শোনে, দুষ্টুমি করে, বেড়াতে যায়, খেলাধুলা করে-আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়।
জীবনের নানারকম অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, জ্ঞান, নাতি-নাতনিদের মধ্যে দাদা-দাদি, নানা-নানিরা বিতরণ করেন। এ প্রবীণরা শিশুর মনোজগৎ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাঁরা নাতি-নাতনিদের বংশের বাতি হিসেবে দেখেন। তাঁদের রক্তের উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচনা করেন। নাতি-নাতনিদের সাফল্য দেখার জন্য আকুল হয়ে ওঠেন।
দাদা-দাদি, নানা-নানির কাছে নাতি-নাতনিরা অনেক সুন্দর, আকর্ষণীয় ও আনন্দদায়ক। তাঁদের কাছে নাতিনাতিনরা সহজে মনের কথা বলতে পারে, সমস্যার কথা বলতে দ্বিধা করে না। দাদা-দাদি, নানা-নানি অনেক সময় বাবা-মার দায়িত্ব এবং কর্তব্যে হস্তক্ষেপ করেন। তাতে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়। বাবা-মাকে বুঝতে হবে সন্তানের বেড়ে ওঠা যেন আনন্দের হয়। শিশুরা তার দাদা-দাদি, নানা-নানিকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তাদের সামনে দাদা-দাদি নানা-নানিকে লাঞ্ছিত হতে দেখলে শিশুমনে দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
শিশুরা প্রবীণদের ওপর কোনো ধরনের অত্যাচার মেনে নিতে পারে না। প্রতিবাদ করার সাহস, ক্ষমতা না থাকায় চপু থাকে; কিন্তু ভেতরে ঝড় বয়ে যায়। দিনশেষে এ শিশু বাবা-মার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। খুব কম সংখ্যক ছেলেমেয়ে দাদা-দাদি, নানা-নানি সম্পর্কে বিরক্তিকর মন্তব্য করে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের ছেলেমেয়েদের সামনে গুরুজনদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করে। এমনকি তাদের সঙ্গে মিশতে বারণ করেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি মোটেই ঠিক কাজ নয়। দাদা-দাদির রক্তের উত্তরাধিকার নাতি-নাতনিরা। বড়ো হয়ে এরা দাদা-দাদিকে অবহেলা করবে না, বরং যারা দাদা-দাদি সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেছে, তাদের খারাপ জানবে।
আবার বিপরীতটাও অনেক সময় পাওয়া যায়, কোনো কোনো সময় দাদা-দাদি, নানানানিরা দায়িত্ব পালনে বিরক্তিবোধ করেন। তারা নাতিনাতনিদের সেবাযত্ন করতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। শারীরিক সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় নাতি-নাতনিদের সঙ্গ দিতে চান না। পারিবারিক ঝগড়া-বিবাদ অনেক সময় দাদা-দাদি, নানা-নানিকে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করে। দাদা-দাদি, নানা-নানিকে বেশি দায়িত্ব দিলে তারা বিরক্ত বোধ করেন এবং মুক্তি খোঁজেন। তারা বেড়াতে যেতে চান, ঘুরতে চান, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে চান। দাদা-দাদি, নানা-নানিদের জন্য এ সুযোগ রাখতে হবে। তাদের প্রতি মনোযোগ বাড়িয়ে দিলে তারা তাদের নাতিনাতনিদের প্রতি বেশি মনোযোগী এবং আন্তরিক হবেন।
আমাদের প্রবীণরা আমাদের শেকড়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সমাজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেকেই সে শেকড়টি উপড়ে ফেলছি। প্রবীণরা আমাদের অনেকের কাছেই শুধু ‘বুড়া-বুড়ি’। আমাদের বহুমুখী কর্মব্যস্ততায় পারস্পরিক দায়বদ্ধতা লোপ পাচ্ছে, আর মা-বাবা তথা প্রিয়জনের প্রতি বাড়ছে উপেক্ষা। অথচ পারিবারিক, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনে রয়েছে প্রবীণদের অবদান। আর প্রবীণদের শত অভিজ্ঞতা নবীনদের সামনে চলার পথে দিক-নির্দেশনা হতে পারে। তাদের অভিজ্ঞতা তরুণরা শুনে শুনে কাজে লাগাতে পারে। পারিবারিক কোনো সিদ্ধান্তে যখন কোনো প্রবীণ থাকে তখন সেই কাজটা অনেকাংশে ভালো হয় কেননা এতে প্রবীণদের থাকে পূর্ব অভিজ্ঞতা। নবীনদের হাজারো মানসিক অত্যাচার মাথায় নিয়েও তাদের অকৃিত্রম ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে নবীনদের জন্য আশীর্বাদ করেন, তাদের ভালো কাজের দিক-নির্দেশনা দেন।
আর এক্ষেত্রে নবীনদের প্রবীণদের প্রতি দায়িত্ববোধ, মানবিকতাবোধ বাড়াতে হবে। তারাও যে পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের একটা সম্পদ তা বিবেচনা করতে হবে। তাদেরকে মানসিকভাবে সাহস জোগানোর দায়িত্ব নবীনদের দিতে হবে। এই বয়সে তাদের যেন কারো মুখাপেক্ষী না হতে হয়। নবীনদের উচিত তাদের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও দায়িত্ববোধ বাড়ানো। তাহলে প্রবীণ মন হতাশা থেকে রেহাই পাবেন। প্রবীণরা বেঁচে থাকবেন প্রাণোচ্ছলতায়।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে