হুরে জান্নাত শিখাঃ নিরাপত্তার চাহিদা মানুষের জৈবিক প্রেষণা না হলেও এটি জৈবিক প্রেষণার মতোই তীব্র। প্রাচীন কাল থেকেই দলবদ্ধ জীবন যাপন করা এবং সমাজ জীবনে বসবাস করার অন্যতম একটি কারণ ছিল নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করা, বন্য প্রাণীর আক্রমণ প্রতিরোধ করা, জীবনের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করা ইত্যাদি বিষয়গুলো মানুষের নিরাপত্তাবোধের সাথে আদিম কাল থেকেই সম্পৃক্ত হয়ে এসেছে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীবনে পারস্পরিক সহযোগিতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা ইত্যাদির ব্যবহার করে সবার আগে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে চলেছে আদিমকাল থেকেই। সভ্যতার এ পর্যায়ে এসে মানুষের নিরাপত্তার প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়েছে। এখন মানুষ এমন কিছু নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করে যার উৎস হলো সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট।
নিরাপত্তাহীনতা যে কোনো কারণেই তৈরি হোক না, তা ব্যক্তির মনোজগতের জন্য সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করে। ব্যক্তি নিরাপত্তাহীনতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নানা রকম আচরণ করে, যা হতে পারে উপযোজনমূলক কিংবা ধ্বংসাত্মক। ব্যক্তির জীবনে কখনও নিরাপত্তাহীনতা আসবে না এমন কোনো নিশ্চয়তা কোনো সভ্যতাই দিতে পারে ন। কাজেই মূল যে বিষয়টি ব্যক্তির জন্য প্রয়োজন, তা হলো কীভাবে সে এ নিরাপত্তাহীনতার সাথে উপযোজন করা শিখবে। এ শিক্ষাটি হয়ে থাকে শিশুর প্রাথমিক শৈশবকাল থেকে। সন্তান প্রতিপালনের মাধ্যমে শিশুর পরিবার শিশুকে নিরাপত্তার অনুভূতি দেয়। প্রাথমিক শৈশবে নিরাপত্তার অনুভব সৃষ্টি হয় শারীরিক যত্নের ভেতর দিয়ে। শিশুর জন্য আরামদায়ক পরিবেশ এবং যত্ন শিশুর মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি করে। পরবর্তীতে নিরাপত্তা বোধ বিষয়টি শারীরিক নিরাপত্তার বেষ্টনী থেকে মানসিক নিরাপত্তার বিস্তৃত জগতে ছড়িয়ে যায়। যেমন, পারিবারিক কলহ, পিতা বা মাতার আবেগীয় জগৎ ইত্যাদি বিষয়গুলো শিশু বুঝতে শুরু করে। একজন ক্রুদ্ধ, বিরক্ত, বিষণ্ন বা উদ্বিগ্ন বাবা মা সন্তানের জন্য স্বাভাবিকভাবেই স্নেহময় পরিবেশটি বজায় রাখতে ব্যর্থ হন। শিশু যখন দেখে বাবা বা মা ক্রুদ্ধ আচরণ করছেন তখন সে তার মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়, বোধ করি তার জীবন এতে করে বিপন্ন হতে পারে। এর একটি সুদূর প্রসারী ফলাফল শিশুর মনোজগতে তৈরি হয়। বস্তুত শিশুর জন্য কেবল মৌলিক চাহিদা পূরণই যথেষ্ট নয়। তার জন্য প্রয়োজন একটি আবেগীয় নিরাপত্তার জগৎ। এ জগৎটি তৈরি হয় পরিবারের আবেগীয় চর্চার ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে। যেমন, সন্তান কোনো কারণে কাঁদতে পারে। এটি তার জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু বাবা বা মা যদি সন্তানের কান্না নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হন তাহলে এটি সন্তানের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সন্তান বুঝতে পারে না কেন বাবা মা উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। বাবা মায়ের উদ্বেগ দেখে সে উদ্বিগ্ন হয় এবং তার কান্নার পরিমাণ বেড়ে যায়। এভাবে বাবা মায়ের নিরাপত্তাহীনতার বোধ সন্তানের মধ্যে প্রবাহিত হয়। বাবা মায়ের অতি মাত্রায় নিয়ন্ত্রণমূলক বা সাবধানতামূলক আচরণ সন্তানের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করে। অনেক বাবা মা তাদের সন্তানদের অন্যদের সাথে মিশতে দেন না, কারো সাথে বাইরে বেড়াতে দিতে চান না, ঘরের দরজায় অনেকগুলো তালা দিয়ে রাখেন বা মানুষকে সন্দেহ করেন। এ আচরণগুলো সন্তানের মধ্যে মানুষ সম্পর্কে অবিশ্বাস তৈরি করে। সে নিজের মতো করে নতুন কোনো পরিবেশে স্বাভাবিকভাবে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়।
বাবা মায়ের সাথে সম্পৃক্ততার অভাব সন্তানের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার স্থায়ী সংকট তৈরি করে। শৈশবকালে শারীরিক যত্ন, ‘আমি বা আমরা তোমার সাথে আছি’ এমন একটি আবহ তৈরি করা, স্নেহ মমতা ইত্যাদি সন্তানকে বাবা মায়ের সাথে সম্পৃক্ত করে। সম্পৃক্ততা এমন একটি বোধ যার মাধ্যমে সন্তান বুঝতে পারে, বাবা মা তার জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ের ভূমি। এ বোধ তৈরি হলে একটা সময় সে বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতে নিজের জগতে স্বচ্ছন্দে এবং স্বাভাবিকভাবে বিচরণ করতে পারে। তার পক্ষে সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করা সহজ হয়। বাবা মায়ের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা এক সময় ব্যক্তির মধ্যে তৈরি করে আত্মবিশ্বাস এবং জগতের প্রতি বিশ্বাস। এ বিশ্বাস তাকে সারাজীবনের জন্য যে কোনো নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকে রক্ষা করে। যখন সে নিরাপত্তার অভাব অনুভব করে, সে আত্মবিশ্বাসের সাথে তা মোকাবিলা করতে সমর্থ হয়।
নিরাপত্তাহীনতা নয়, বস্তুত ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর হলো নিরাপত্তাহীনতার বোধ। মানুষের জীবন দারিদ্র্য, বঞ্চনা, অনিশ্চয়তা, বিপদ, বিপর্যয় সব কিছুই স্বাভাবিক ঘটনা। আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বাবা মা যদি সন্তানের জন্য অনেক অর্থ সম্পদ সঞ্চয় করে রাখেন তাতেও তার জীবন নিরাপদ হবে সে নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়। নিরাপত্তা যে কোনো সময়, যে কোনো কারণেই বিঘ্নিত হতে পারে। কোভিড-১৯ এ আমরা দেখেছি অর্থ, বিত্ত, জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই একটি চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিয়ে পার হতে হয়েছে। কারো কারো জন্য এ সময়টি ছিল গভীর বেদনার। কাজেই নিরাপত্তা কখনও নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যেটি করা সম্ভব সেটি হলো ব্যক্তির ভেতর প্রতিকূল, অনিরাপদ পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার মানসিক প্রস্তুতি ও যোগ্যতা তৈরি করা। এর জন্য প্রয়োজন নিজের উপর আস্থা এবং সামাজিক জীবনের সহযোগিতার উপর বিশ্বাস থাকা। নিরাপত্তাহীনতার বোধ কেবল উদ্বেগ তৈরি করে, এটি নিরাপত্তা সৃষ্টি করে না- আচরণের এ মূল নীতিটি সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে মাথায় রাখা দরকার। একজন মানুষকে বিপদ সংকেত বুঝতে হয়, বিপদে সাবধান হতে হয়, সুচিন্তিত আচরণ করতে হয়। কিন্তু যখন ব্যক্তি নিরাপত্তাহীনতায় থাকে তখন তার মধ্যে তৈরি হয় প্রবল উদ্বেগ। এ উদ্বেগের ফলে ব্যক্তি স্বাভাবিক যে কোনো পরিস্থিতিতেও ঘাবড়ে যায়। নিরাপত্তাহীনতার বোধ ব্যক্তির মধ্যে এমন মানসিক সংকট তৈরি করে যে সে সব সময় অনাগত বিপদ অনুমান করে উদ্বেগাক্রান্ত হয়ে সময় কাটিয়ে দেয়। জেনারেলাইজড এ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনের সকল কিছুকেই উদ্বেগের কারণ মনে করে। তার মনে হয়, ‘বাইরে গেলে দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারি’, ‘অপরিচিত মানুষ আমাকে বিপদে ফেলতে পারে’, ‘পড়ালেখা করলেও পরীক্ষায় আমি ফেল করতে পারি’, ‘আমার প্রিয় কোনো মানুষ যে কোনো সময় মারা যেতে পারে’। সোশ্যাল এ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে ব্যক্তি যে কোনো সামাজিক পরিস্থিতিতে অপদস্থ হবার ভয় করে। তার মনে হয়, ‘মানুষ আমাকে নিয়ে হাসবে’, ‘আমি নিজেকে বোকা প্রমাণ করবো’, ইত্যাদি। এসব মনোরোগের পেছনে থাকে প্রবল নিরাপত্তাহীনতার বোধ যার বিকাশ ঘটে শৈশবের বেড়ে ওঠার সময়কালে।
এ মনোরোগগুলোর অন্যতম কারণ যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ, তার একটি বড় প্রমাণ হলো, আমরা সকলেই একই ঘরে বাস করে বা একই সমাজে বাস করে একই রকম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি না। একজন পথশিশুকে আমরা অনায়াসে রাস্তায় চলাচল করতে দেখি। কেউ কেউ দ্রুতগামী ট্রাফিকের মধ্যেই সাইকেল চালায়। তাদের নিরাপত্তাবোধ তাদের সব সময় নিরাপদে রাখে এটাও যেমন নিশ্চিত নয় তেমনি, আমি ঘরে বসে থাকলেও নিরাপদ সেটিও নিশ্চিত নয়। কাজেই নিশ্চয়তা একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় যার উপর আসলেও কারো কোনো হাত নেই। যেটির উপর আমাদের হাত আছে সেটি হলো আমরা যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, সে অবস্থাতেই নিজের নিরাপত্তা বজায় রাখার আচরণগত দক্ষতা অর্জন করা।
নিরাপত্তাহীনতার বোধ কেবল উদ্বেগ তৈরি করে এমন নয়। আমাদের কিছু সাইকোসিস যেমন, প্যারানয়ার একটি প্রবল তীব্র লক্ষণ হলো অন্যকে সন্দেহ করা। এ সন্দেহ এমন পর্যায়ে চলে যায় যে ব্যক্তির মধ্যে নানা রকমের ভ্রান্ত বিশ্বাস তৈরি হয়। তার মধ্যে একটি হলো, প্রতারিত হবার অলীক বিশ্বাস। প্যারানয়া আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের কল্পিত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব সময় অন্যদের সন্দেহ করে, সে মনে করে অন্য মানুষ সব সময় তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে, এমনকি এ ধরনের বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে সে অন্য মানুষকে খুন করতে পারে। যদিও সাইকোসিসের পেছনে বেশিরভাগ সময় বংশগত কারণ থাকে, তা সত্ত্বেও ব্যক্তির পরিবেশ তাকে এ জাতীয় মনোরোগ বিকাশে সাহায্য করে থাকে। সাইকোসিস প্রবণ একজন ব্যক্তি যদি পারিবারিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতা, সম্পৃক্ততার অভাব, কলহপূর্ণ পরিবেশ এবং আবেগীয় অনিশ্চয়তার মধ্যে বড় হয় তার মধ্যে এ মনোরোগোর লক্ষণগুলো দেখা দেবার প্রবণতা বাড়ে। এ জাতীয় পরিবেশ ব্যক্তির পায়ের তলার মাটিকে নড়বড়ে করে রাখে ফলে যে কোনো সাধারণ বিপর্যয়ে তার পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়ানো আর সম্ভব হয় না।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।
মনের খবর ম্যাগাজিনের প্রিন্ট ভার্সন পড়তে ক্লিক করুন
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে