করোনা পরবর্তী কী মানসিক পরিবর্তন হতে পারে

করোনা পরবর্তী কী মানসিক পরিবর্তন হতে পারে

আমরা দেখেছি, প্রকৃতি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে কী হিংস্র আচরণ করেছি, কতটকুু সাম্রাজ্যবাদী ছিলাম আমরা। এক দেশ আরেক দেশের ওপর কর্তৃত্ব করার কী মহামারি-উল্লাস ছিল আমাদের আগ্রাসনের ভেতর। কত নির্মম, আর কী পাষন্ড আমরা, দেখেছি। নিজেদের আবিষ্কার করেছি। দেখেশুনে প্রশ্ন করেছি এত অমানবিক হতে পারি আমরা? হা হা করছি। করোনা পরবর্তীকালে সব হাহাকারের কথা ভুলে যাব। সব ভালো উপলব্ধির কথা ভুলে যাব। কী কী ভুল করেছি, জেনেও পরবর্তীকালে আবার সে ভুল করব। আবার হিংস্র হব। পৈশাচিক উল্লাস করব। আবার হিংস্র প্রবৃত্তি আমাদের সত্তায় জেগে উঠবে। আবার আমরা অপরাধ করব। প্রতিহিংসায় ডুবে যাব। আবার একে অন্যের ক্ষতি করার প্রণোদনায় লাফিয়ে লাফিয়ে উঠব। অন্যকে হেয় করার, ছোটো করার উন্মাদনায় মেতে উঠব। অন্যের সফলতায় ঈর্ষাকাতর হয়ে তাকে নানাভাবে নাজেহাল করার চেষ্টা করব।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাস ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড এর মাকোন্দো গ্রামের মানুষের ভুলে যাওয়া রোগের মতো রোগে আক্রান্ত হব। নতুন বোধ তখন ভেসে যাবে। ভুলে গিয়ে আবার পূর্ণ দানবীয় সত্তা ফিরে পাব। এ পর্যন্ত যেসব মানুষ মারা গেছে তাদের কথা ভুলে যাব। চিকিৎসকরা সেবা দিতে গিয়ে মৃত্যৃুবরণ করেছেন, ভুলে যাব সব কথা। চিকিৎসকদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে গালাগাল দেব। সচিবসহ প্রশাসন-পুিলশ-র‌্যাবের সদস্য, ব্যাংকার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক মারা গেছেন। সবার কথা ভুলে যাব। সাহিত্যের মাঠে কারো বই না পড়েই তাকে খাটো করার চেষ্টা করব। ‘অমুক কোনো লেখকই না’ বলে তাকে বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে দেব।

আবার আমাদের হিংস্র প্রবৃত্তি, আণবিক শক্তি লাভ করে আরো বিধ্বংসী হবে। অন্যদিকে করোনার বিধ্বংসী সহিংসতা নিজ চোখে যারা দেখেছেন, স্বজন, প্রিয়জন, বন্ধু-বান্ধব হারিয়েছেন কিংবা অর্থসংকটে ডুবে গেছেন বা চাকরি খুইয়ে পথে বসে গেছেন অথবা ব্যবসায় ভয়াবহ ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন, তারা মানসিক সমস্যা/রোগে আক্রান্ত হয়ে যাব। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডার, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার ধরনের রোগশোকে ভুগতে থাকব। আত্মহত্যার মতো বিধ্বংসী মনোবৃত্তিও চেপে বসতে পারে গুরুতর সংকটে ডুবে যাওয়া বিষণ্ণ রোগীদের মাথায়।

অনেকে অনেক কিছু হারিয়েছি আমরা, পুরো জাতি দেখেছে ভয়াবহতা। করোনার বিধ্বংসী ছোবলে কীভাবে মানুষ সংক্রমিত হয়েছে, মারা গেছে কীভাবে, লাশ বহন করা হয়েছে কীভাবে, স্বজনবিহীন লাশ কবরে চলে যাচ্ছে কীভাবে, প্রায় স্বজনহীন জানাজা ছাড়া লাশ কবরে চলে গেছে কীভাবে, নিজে নিজেকে আড়াল করেছি আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে কীভাবে-এসব কথা মনে পড়বে। মনে পড়লে তারা মানসিকভাবে আক্রান্ত হবে। তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা হানা দিতে পারে। তাদের মধ্যে উদ্বেগ হানা দিতে পারে।

সাধারণত লস ইভেন্টের সঙ্গে জড়িত থাকে বিষণ্ণতা, আর থ্রেটের সঙ্গে জড়িত থাকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অ্যাংজাইটি। লস ও থ্রেট একসঙ্গে ঘটায় বিষণ্ণতা এবং অ্যাংজাইটি যৌথভাবে হানা দিতে পারে। বিষণ্ণ ব্যক্তির কর্মক্ষমতা কমে যাবে। কাজ করা নিরানন্দময় হয়ে যাবে। দিনযাপনে কোনো কাজে আনন্দ পাবে না। কাজে যেতে ইচ্ছা করবে না। কর্ম-ঘণ্টার অপচয় ঘটবে, উন্নয়ন কর্মতৎপরতা ব্যাহত হবে। পারিবারিক আবহে বিষাদের ঘনঘটা লেগে থাকবে।

একইসঙ্গে আমরা দেখব উদ্বেগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নানা বিষয়ে ভয়, অস্থিরতা। অযৌক্তিকভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার প্রবণতা। দেখব পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়া, দেখব তাদের মধ্যে হতাশা, পারিবারিক সহিংসতা, শিশু নির্যাতন। আবার অনেকে ট্রমা বহন করবে দীর্ঘদিন-পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেসের দীর্ঘমেয়াদি যাতনা ধীরে ধীরে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেবে। অস্থিরতা উদ্বেগ, মনোযোগের ঘাটতি, শব্দকথাবার্তা সইবার শক্তি কমে যাওয়া, দুঃস্বপ্নে বারবার ভয়াবহ ঘটনাগুলো মনে হানা দেওয়া, কোনো ‘কিউ’ সামনে এলে সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো ঘটনাটা মনের মধ্যে জেগে ওঠা-সর্বোপরি ভেঙে পড়বে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ইমিউন সিস্টেম। অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে তখন। ঘুমের সমস্যাও শুরু হয়ে যাবে।

এসব থেকে বাঁচতে হলে প্রথমেই হতে হবে ক্যাথার্সিস। এখন যারা ভয়াবহ ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের ইমোশনাল রিলিজ হওয়া দরকার-ক্যাথার্সিস হওয়া দরকার, সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড দরকার, দরকার ক্রাইসিস ইন্টারভেনশনও। এসব চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করলে পরবর্তী সময়ে বিষণ্ণতা রোগ, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার অথবা অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডার-এসবে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কমে আসবে।

পরবর্তীকালে কী হবে, না-ভেবে কোভিড চলাকালীন সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে সাউন্ড রাখতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকার অর্থ হচ্ছে নিজের মধ্যে স্বস্তি থাকা, নিজের সামর্থ্যগুলো শনাক্ত করা, প্রতিদিনের চাপ মোকাবেলা করার ক্ষমতা অর্জন করা, প্রতিদিনের কাজগুলো ঠিকমতো পালন করা এবং নিজের দক্ষতাকে শাণিত করে পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য কিছু করা।

এসব গুণাবলী থাকলে আমরা বলব, একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো আছে। মানসিক স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে হলে নিজের দক্ষতাকে যেমন শানিত করতে হবে তেমনি নিজের অদক্ষতাগুলোকেও চিহ্নিত করতে হবে। পরিচর্যার মাধ্যমে তা উন্নত করতে হবে। তাহলে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে। মন ঠিক থাকবে। আবার বলা যায়, দেহ ঠিক থাকলে মন ঠিক থাকবে।

একই সূত্রে গাঁথা দেহ-মন। এ দুর্যোগকালীন সময়ে দেহ ও মনকে সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত এক্সারসাইজ, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং সামাজিক সংযোগ বজায় রাখা, ব্যক্তিগতভাবে না পারলে ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যম হলেও সংযুক্ত থাকা জরুরি। জরুরি বিচ্ছিন্ন না হওয়াও। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের ভালো থাকতে হবে। নিজেকে ভালো রাখতে হবে। পরিবারকে ভালো রাখতে হবে। সমাজকে ভালো রাখতে হবে।

সবচেয়ে বড়ো প্রয়োজন সচেতন থাকা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। হাল ছেড়ে দেওয়া চলবে না। সতর্ক থাকব প্রত্যেকে। তাহলে জাতিকে রক্ষা করতে পারব।

সূত্র:লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

 

Previous articleআপনি সোশ্যাল এংজাইটি ডিস্‌অর্ডারে ভুগছেন না তো!
Next articleমনের উপর আমাদের বাসস্থানের প্রভাব
অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল
প্রাক্তন পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here