এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস (কোভিড-৯) নিয়ে যে সব বিষয় শুনছেন তাতে বিচলিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনার সন্তানের মধ্যেও এ নিয়ে উদ্বেগ কাজ করছে বলে সহজেই ধরে নেওয়া যায়। তারা অনলাইন ও টিভিতে যা দেখছে বা অন্যদের কাছ থেকে এই ভাইরাস সম্পর্কে যা শুনছে, তা বোঝা শিশুদের জন্য কঠিন হতে পারে। তাই তাদের মধ্যে উদ্বেগ, চাপ ও দুঃখবোধ তৈরি হতে পারে। কিন্তু আপনি সন্তানের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে ও তাকে সহায়তার মনোভাব নিয়ে আলোচনা করলে তা তাদের বিষয়গুলো বুঝতে, কঠিন এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে এবং এমনকি অন্যদের জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখতে সাহায্য করবে।
চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য সতর্কতা ও পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘের শিশুদের নিয়ে কাজ করা বিশেষ সংস্থা ইউনিসেফ।
ইউনিসেফ জানাচ্ছে,
১. খোলা মনে প্রশ্ন করুন ও শুনুন: বিষয়টি নিয়ে সন্তানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করুন। বোঝার চেষ্টা করুন তারা বিষয়টি নিয়ে কতদূর জেনেছে এবং কি কি বিধিনিষেধ অনুসরণ করছে। খুব ছোট হলে এবং এখনও রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে না জেনে থাকলে তাদের কাছে বিষয়টি তোলার দরকার নেই- তার মধ্যে ভয় না ছড়িয়ে শুধু যথাযথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার স্বাস্থ্যবিধিগুলো তাদের মনে করিয়ে দিন। নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করুন এবং আপনার সন্তান যেন স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে সেই সুযোগ তৈরি করে দিন। ছবি আঁকা, গল্প বলা বা অন্য কোনো কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তার সঙ্গে আলোচনাটা শুরু করা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলোকে কখনোই খাটো করে না দেখা বা এড়িয়ে যাওয়া। তাদের অনুভূতি-উপলব্ধিকে মেনে নিন এবং তাদেরকে বুঝান যে, এসব বিষয়ে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনার আচরণে এটা প্রকাশ করতে হবে যে, পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে আপনি তার কথা শুনছেন এবং চাইলেই যেন আপনার ও তাঁর শিক্ষকদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে সেই আত্মবিশ্বাস তাদের দিতে হবে।
২. সৎ হতে হবে: শিশুবান্ধব পদ্ধতিতে সত্যটা তুলে ধরুন বিশ্বজুড়ে যা চলছে সে বিষয়ে জানার অধিকার শিশুদেরও রয়েছে। তবে বড়দেরও দায়িত্ব রয়েছে তাদের মানসিক যন্ত্রণা থেকে দূরে রাখা। তাদের বয়স অনুযায়ী কথা বলুন, তারা কি প্রতিক্রিয়া দেখায় তা খেয়াল করুন, তাদের উদ্বেগের মাত্রা অনুধাবনের চেষ্টা করুন ও তাদের প্রতি সংবেদনশীল হন। তাদের কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলে কোন কিছু বানিয়ে বলবেন না। এটাকে ধরে নিন সবগুলো প্রশ্নের একসঙ্গে উত্তর দেওয়ার সুযোগ হিসেবে। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ওয়েবসাইট এসম্পর্কিত তথ্যের বড় উৎস। তাদের বুঝিয়ে বলুন যে, অনলাইনে যত তথ্য পাওয়া যায় তার সবটাই সঠিক নয়। তাই এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যের ওপর নির্ভর করাই সবচেয়ে নিরাপদ।
৩. ছেলে-মেয়েরা নিজেদের ও তাদের বন্ধুদের কীভাবে রক্ষা করতে পারে, তা দেখিয়ে দিন: ছেলে-মেয়েদের করোনাভাইরাস ও অন্যান্য রোগ থেকে নিরাপদ রাখার সবচেয়ে ভালো উপায়গুলোর একটি হচ্ছে নিয়মিত সঠিকভাবে হাত ধোয়া। এর জন্য তাদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে পারে এমন আলোচনার অবতারণা করার কোন দরকার নেই। শিশুর কাছে এ বিষয়ক শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করতে গান বা নাচের মাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। হাঁচি-কাশির সময় কিভাবে হাত ভাজ করে কনুই দিয়ে নাক-মুখ ঢাকতে হয় তা আপনি ছেলে-মেয়েদের দেখাতে পারেন। তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে যে, যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের কাছে না যাওয়া এবং জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট বোধ করলে যেন তারা যেন সেটা সঙ্গে সঙ্গে জানায়।
৪. মানসিকভাবে চাঙা রাখতে তাদের প্রতিনিয়ত আশ্বাস দিতে হবে: যখন আমরা টেলিভিশন বা অনলাইনে প্রচুর মন খারাপ করা ছবি দেখি তখন মনে হতে পারে যেন সংকট আমাদের চারপাশেই। শিশুরা স্ক্রিনের ছবি এবং নিজেদের বাস্তবতাকে গুলিয়ে ফেলতে পারে এবং ভাবতে পারে তারা আসন্ন বিপদের মুখে। এসব ক্ষেত্রে সম্ভব হলে খেলাধুলা ও মনোবল চাঙা করার অন্যান্য কর্মকাণ্ডের সুযোগ তৈরি করে আপনি আপনার শিশুকে মানসিক চাপ মুক্ত রাখতে পারেন। যতটা সম্ভব তার জন্য সময় দিন, বিশেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে, আবার একটা নতুন পরিবেশে নতুন কিছু করতে গেলে তাকে সহযোগিতাও করতে হবে। আপনার সন্তান অসুস্থ বোধ করলে বোঝাতে হবে যে, তার/তাদের ঘরে থাকা বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নিজের ও তাদের বন্ধুদের জন্য বেশি নিরাপদ। তাদের বোঝাতে হবে যে, এই সময়টা কঠিন (ভীতিকর, এমকি বিরক্তিকরও) হবে, কিন্তু এই নিয়মগুলো মেনে চললে সবাই নিরাপদ থাকবে।
৫. খতিয়ে দেখতে হবে তারা স্টিগমার শিকার হয়েছে বা ছড়াচ্ছে কি না: করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বর্ণ বৈষম্যের ঘটনা ঘটেছে বলে অনেক খবর প্রকাশ হয়েছে। তাই আপনার সন্তানও এ ধরনের বিদ্বেষের শিকার হচ্ছে কি না বা তা ছড়াতে ভূমিকা রাখছে কি না তা খতিয়ে দেখা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে যে, কোনো মানুষ দেখতে কেমন, ষে কোথা থেকে এসেছে বা কোন ভাষায় কথা বলে, তার সাথে করোনাভাইরাসের কোন সম্পর্ক নেই। যদি তারা এ ধরনের আচরণের শিকার হয় তাহলে যেন সংকোচ না করে তাদের আস্থাভাজন বড় কাউকে বিষয়টি সম্পর্কে জানায়। আপনার সন্তানকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, স্কুলে নিরাপত্তা ও বন্ধুসুলভ আচরণ সবারই প্রাপ্য। কাউকে হেনস্তা করা কখনোই ঠিক নয়। বরং একে অপরের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা বাড়াতে আমাদের সবারই দায়িত্ব রয়েছে।
৬. বিপদে এগিয়ে আসা লোকজনের দিকে নজর: এটা শিশুদের জানা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই সংকটকালে অনেক মানুষ সহমর্মিতা ও উদারতার হাত নিয়ে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়াচ্ছে, সহায়তা করছে। রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ও কমিনিউটিকে নিরাপদ রাখতে স্বাস্থ্যকর্মী, বিজ্ঞানী ও তরুণসহ অন্যরা যারা কাজ করছে, সে বিষয়ে তাদের সাথে গল্প করুন। সহৃদয় লোকজন যে তাদের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত আছে সেটা জানতে পারলে তারা অনেকখানি স্বস্তি ও সাহস পাবে।
৭. নিজের যত্ন নেওয়া: এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজে ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারলেই আপনি সন্তানদের সহায়তা করতে পারবেন। এসব খবরে আপনার কি প্রতিক্রয়া ঘটে, তার থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করবে আপনার সন্তান। তাই এই পরিস্থিতিতে আপনি সুস্থ ও শান্ত আছেন দেখলে তারাও স্বস্তি অনুভব করবে। আপনি উদ্বিগ্ন ও হতাশ বোধ করলে নিজের জন্য সময় দিতে হবে এবং সমাজে আপনার আস্থাভাজন লোকজন, বন্ধু ও অন্যান্য পরিবারের কাছে গিয়ে কথা বলতে হবে। আপনি নিজে যাতে চাঙা ও উজ্জীবিত থাকেন সেজন্য কিছু সময় ব্যয় করতে হবে।
৮. সতর্কতার সঙ্গে আলোচনায় সমাপ্তি টানা: এটা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের সন্তানদেরকে আমরা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রাখছি না। আলোচনা শেষ করার সময় তাদের শরীরী ভাষা দেখে, স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে কিনা এবং শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক আছে কিনা তা দেখে তাদের উদ্বেগের মাত্রাটা বোঝার চেষ্টা করুন। সন্তানদেরকে মনে করিয়ে দিন, যে কোনো সময় আপনার সঙ্গে তাদের আরও গুরুতর কোন বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। তাদেরকে বুঝিয়ে দিন, আপনি তাদের প্রতি যত্নশীল, তাদের কথা শুনছেন এবং তারা যখনই উদ্বিগ্ন হবে তখনই আপনার সাথে তা নিয়ে বিনা সংকোচে কথা বলতে পারবে।
সূত্র: ইউনিসেফ