বাংলাদেশে এপর্যন্ত বেশ কয়েকজন মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে মানুষ করোনা ভাইরাস থেকে নিজেদের এবং তাদের পরিবারকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করছেন। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী অনেকেই বাড়িতে আটকে আছেন। দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে এই ভাইরাসকে মোকাবেলা করবেন তার জন্য শরীরের যত্ন নিচ্ছেন (যেমনঃ হাত ধোয়া, মাস্ক পড়া, পরিষ্কার কাপড় পড়া, জনসমাগম এড়িয়ে চলা ইত্যাদি)। কিন্তু শরীরের পাশাপাশি এসময় মনেরও যত্ন নেয়া নেয়ার প্রয়োজন। তবে কেউ হেসে উড়িয়ে দিতে পারেন যে, আমি কি পাগল না কি আমার মনের যত্ন নিতে হবে। গবেষনায় দেখা যায়, যেকোন বিপর্যয়ের পরে বিপর্যস্ত এলাকায় পরবর্তী সময়ে তীব্র মানসিক চাপ, দুর্যোগের বীভৎসতা এবং আগামী দিনগুলোর অনিশ্চয়তার কারণে দুর্যোগ সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ মানুষ মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ে পড়েন।
আজ বিশ্ব যে পরিমানে আতংকিত তাতে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ মানসিক সংকট ডেকে আনতে পারে (অস্ট্রেলিয়ান সাইকোলজিক্যাল আসোসিয়েশন)। এসময় অর্থনৈতিক সংকট বাড়বে, অনেক মানুষ নিঃস্ব হবেন, তথ্য বিভ্রাট ঘটবে, অনেকে প্রিয়জন হারাবেন ইত্যাদি কারণে মানসিক সংকট আরো ঘনিভূত হবে। অনেক মানুষ মানসিক চাপ বা অস্থিরতায় ভুগবেন, অ্যাংজাইটি বাড়বে, কেউ ডিপ্রেশনে থাকবেন, কারও ক্ষেত্রে সাইকোসিস দেখা দিতে পারে। কেউ কেউ মানসিক চাপ বা হতাশা সামলাতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারেন। বিপর্যয়ের পরবর্তী প্রাইমারি প্রতিরোধী হিসেবে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসোসিয়েশন, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর রেডক্রস অ্যান্ড রেডক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ বিভিন্ন আন্তজার্তিক সংস্থার গবেষণায় শরীরের পাশাপাশি মনের যত্ন নিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।কেননা শরীর ও মন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এসময় মনের যত্ন নেয়ার জন্য নিচের কাজগুলো করা যেতে পারে-
১) মন খুলে শেয়ার করুনঃ পরিবার-পরিজন আত্মীয়-স্বজনবন্ধু-বান্ধবের সাথে খোলা মনে কথা বলুন। নিজের মনের সুখ, উৎফুল্লতা, সফলতা, রাগ, হতাশা, ভাবাবেগ অন্যদের সাথে শেয়ার করুন। মন খুলে কথা বললে আপনার মনের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।তবে ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে সচেতন থাকবেন।
২) ইতিবাচক চিন্তা করুনঃ গবেষনায় দেখা যায়, মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে নিজের ইতিবাচক ও নেতিবাচক চিন্তার অনুপাত হওয়া প্রয়োজন ৫ঃ১। নিজের সক্ষমতা, যোগ্যতা সহ ভালো গুণগুলো মনে আনলে ইতিবাচক চিন্তা বাড়বে। তারপরেও নেতিবাচক চিন্তা ও আবেগ আসলে সেগুলিকে খাতায় বা ডায়েরীতে লিখে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন।কোনভাবেই নেতিবাচক চিন্তা থেকে বের হতে না পারলে প্রয়োজনে মনোবৈজ্ঞানিক সহায়তা নিন।
(৩) দুঃশ্চিন্তা জন্য সময় রাখুনঃ আপনার মনে দুঃশ্চিন্তা আসবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু আপনার দুঃশ্চিন্তা গুলোকে এড়িয়ে গেলে বা চাপিয়ে রাখলে এটি বেশি হয়। তাই প্রতিদিন একই সময়ে একইস্থানে ২০-৩০ মিনিট সময় দুঃশ্চিন্তাগুলোর জন্য রাখুন।এসময় দুঃশ্চিন্তাগুলোকে ইচ্ছে করে মনের মধ্যে নিয়ে আসুন।পারলে খাতা বা ডায়ড়িতেও এগুলিকে লিখতে পারেন এবং এগুলোর সমাধান নিয়ে ভাবতে পারেন। অন্যসময় দুঃশ্চিন্তাগুলো আসলে মনকে বলুন আপনি নির্দিষ্ট সময় দুঃশ্চিন্তাগুলোর জন্য বরাদ্দ রেখেছেন।
৪) সামাজিক দক্ষতা বাড়ানঃ সামাজিক দক্ষতার মাধ্যমে মানুষ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করেন।ব ন্ধু-বান্ধবের সাথে গল্প করা থেকে শুরু করে, কাউকে যুক্তি দিয়ে বোঝানো, কর্মক্ষেত্রে বা সমাজে ভালো করা, এমনকি স্বামী-স্ত্রী বা পরিবারের সাথে সময় কাটাতে গেলেও সামাজিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়। সামাজিক দক্ষতার ক্ষেত্রে অবাচনিক ও বাচনিক আচরণ দুটো বিষয় থাকে।অন্যদের সাথে ভাষার বিনিময় করতে গেলে আমাদের কথা বলার সময় চেহারার প্রকাশ ভঙ্গি, তাকানো,দেহভঙ্গি,আকার-ইঙ্গিত, স্পর্শ ইত্যাদি অবাচনিক বিষয় ব্যবহৃত হয়। আর কথা বলাকে বাচনিক আচরন বলে। বাচনিক আচরণের মধ্যে অন্যতম হলো আসারেটিভনেন্স।অন্যের প্রতি উৎকন্ঠা ছাড়া নিজের আবেগ যথাযথভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতাকে আসারেটিভনেন্স বলে। আসারেটিভনেন্স বলতে আলোচনা শুরু করা, চালিয়ে যাওয়া ও শেষ করা, অন্যদেরকে অনুরোধ করা, নিজের পছন্দ-অপছন্দের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করা, না বলা, অন্যের না বলা সহ্য করা প্রভৃতিকে বোঝানো হয়। অনুশীলনের মাধ্যমে সামাজিক দক্ষতা বাড়ানো যায়।সামাজিক দক্ষতার অভাব থাকলে মনোবিজ্ঞানির পরামর্শ নিতে পারেন।
৫) সম্পর্কগুলোর যত্ন নিনঃ আপনি কতটা মানসিকভাবে সুখী তা নির্ভর করে অন্যদের সাথে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের উপর।কারো সাথে নেতিবাচক আবেগ যেমন রাগ, হিংসা, ক্ষোভ, বিদ্বেষ থাকলে তা থেকে বের হয়ে আসুন, অন্যদেরকে ক্ষমা করে দিন, সম্পর্কগুলো প্রানবন্ত করুন।
৬) বর্তমানকে গুরুত্ব দিনঃ বর্তমানেই সব, মানসিকভাবে ভালো থাকতে গেলেও বর্তমানকে নিয়ে থাকতে হয়।অতীতের ভুলগুলো মনে আসলে সেগুলোকে না বলুন। ভবিষ্যৎ নিয়ে অযথা স্বপ্ন দেখলে মনের উপর চাপ বাড়বেই।অতীত নিয়ে আপনার কিছু করার নেই আর বর্তমান কাজকর্মের উপর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। তাই অতীতের ভুল গুলিকে ভুলে গিয়ে ভবিষ্যতকে না ভেবে বর্তমানকে বেশি গুরুত্ব দিন।
৭) লাইভ স্টাইল ব্যালেন্স রাখুনঃ পর্যাপ্ত সুষম খাবার খাওয়াও পানি পান করা, নিয়মিত হাটাচলা ও ব্যায়াম করা, পর্যাপ্ত ঘুমানো, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া ও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা, বেশী সময় সামাজিক মাধ্যমে ব্যয় না করা, মদ বা কোন ধরনের নেশা না করা, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অযথা কোন মেডিসিন না নেয়া ইত্যাদির মাধ্যমে লাইভ স্টাইল ব্যালেন্স রাখা যায়।লাইভ স্টাইল ব্যালেন্স থাকলে মানসিকভাবে সুখী থাকা যায়।
৮) পছন্দের কাজ করুনঃ প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য এবং সাপ্তাহিক ছুটির একদিন পুরো সময়টিতে পছন্দের কাজ করুন। গান শোনা, বইপড়া, সিনেমা দেখা, খেলা দেখা, পরিবারকে সময় দেয়া, তাদের সাথে বাইরে ঘুরতে যাওয়া, হৈ-হুল্লোড় করা ইত্যাদি পছন্দমত কাজগুলি করে মানসিক প্রশান্তি পেতে পারেন।
৯) রিলাক্স থাকার প্রাকটিস করুনঃ নিয়মিত কিছু সময়ের জন্য একাকী মনকে সময় দিয়ে ধ্যান করা বা রিলাক্সেশন বা মাইন্ডফুলনেস অনুশীলণ করার মাধ্যমে রিলাক্স থাকতে পারেন। এতে করে আপনার মনের চাপ কমে যাবে।
১০) মানসিক সমস্যায় সহায়তাঃ নিজের বা পরিবারের মানসিক কোন সমস্যা হলে সেই সমস্যা লুকিয়ে রাখবেন না।আপনি মানসিক সমস্যার চিকিৎসা নিতে যত দেরি করবেন সমস্যা ততোই বাড়বে।পরিবারের কেউ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হলেও আপনার উপর মানসিক চাপ বাড়বে। তাই প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা সাইকিয়াট্রিস্ট বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট বা অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর সহায়তা নিন।
লেখক: জিয়ানুর কবির, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, এম.এস ও এম.ফিল (ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি), বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত ও প্রাক্টিসিং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, কল্যাণ মানসিক হাসপাতাল, কল্যাণপুর, ঢাকা। মোবাইলঃ০১৯১৩৬২৭৪১৪। email:jia.cpsy@yahoo.com
Home করোনায় মনের সুরক্ষা বিশেষজ্ঞের মতামত করোনাভাইরাস পরবর্তী মানসিক বিপর্যয়ঃএখনই প্রয়োজন মনের যথাযথ যত্ন