ওয়ার্কাহলিক (Workaholic) বা কাজে আসক্তি হলো একটি আচরণগত সমস্যা,যেখানে কোনো ব্যক্তি নিজেকে কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারেন না। বলা যায় পেশাগত কাজের প্রতি ব্যক্তির একধরনের অবসেশন তৈরি হয়। প্রথমবার শুনলে মনে হবে-ভালোই তো, মানুষ কাজে ডুবে থাকলে তো ভালো! কিন্তু না, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। গৌতম বুদ্ধের মতে, ‘জীবনে যা প্রয়োজন তার অতিরিক্ত যেকোনো কিছুই বিষ।’ ওয়ার্কাহলিক ব্যক্তি তার পেশাগত কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন বলতে কিছুই থাকে না। তার সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান শুধুমাত্র তার পেশাগত কাজ এবং পেশাগত সফলতার ভেতরই আবদ্ধ থাকে।
অন্যান্য আসক্তির মতো কাজে আসক্তিকে সামাজিকভাবে খারাপ মনে করা হয় না, উপরন্তু ওর্য়াকাহলিক ব্যক্তির পেশাগত সফলতার কারণে সামাজিকভাবে প্রায় সবসময়ই তার প্রশংসা করা হয়। একদিকে সকলের প্রশংসা, অন্যদিকে পেশাগত সফলতা-সবমিলিয়ে ওয়ার্কাহলিক ব্যক্তি দিন দিন আরো কাজের মধ্যে ডুবে যেতে থাকেন।
কাজে আসক্তিকে সরাসরি একটি রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা খানিকটা দুষ্কর। কারণ সমস্যা হিসিবে চিহ্নিত করা হলেও বই-পুস্তকে একে রোগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। ওয়ার্কাহলিক ব্যক্তিরা তাদের কাজের আসক্তি নিয়ে সরাসরি চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হলেও নানা ধরনের মানসিক সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে এসে থাকেন। যেমন : বিষণ্ণতা, হীনমন্যতা, অস্থিরতা, নিদ্রাহীনতা, শরীরের বিভিন্ন স্থানে অকারণ ব্যথা, অকারণে রেগে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, দাম্পত্য জীবনে জটিলতা, ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি ইত্যাদি।
অর্থাৎ পেশাগত জীবনে সফল হলেও তার ব্যক্তিগত জীবন প্রায়ই সুখের হয় না। ওয়ার্কাহলিক ব্যক্তিদের কিছু লক্ষণ রয়েছে যা দেখে বোঝা যায় যে, ব্যক্তিটি তার কাজের প্রতি আসক্ত। যেমন :
- সবসময় ব্যস্ত ভাব
- অস্থিরতা
- কাজ নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তা
- অবসর সময়ের অভাব
- বিনোদনমূলক কাজে অনাগ্রহ
- সবসময় খিটখিটে মেজাজ
- হঠাৎ করে রেগে যাওয়া
- নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার বাইরেও অফিসে বা কর্মস্থলে কাজ করা
- ঘরে বসে অথবা ছুটির দিনেও অফিসের কাজ করা
- অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া এবং নিজের স্বাস্থ্যের অযত্ন
- ছোটোখাটো বিষয় ভুলে যাওয়া
- দাম্পত্য জীবনে নানা অভিযোগ ও সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি ইত্যাদি।
ওপরের লক্ষণগুলো থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, ওয়ার্কাহলিক ব্যক্তির জীবনে গুণগত মান কমতে থাকে। কাজে আসক্তিকে সামাজিকভাবে যেহেতু খারাপ মনে করা হয় না, সেহেতু এইসব লোকেরা ব্যক্তি জীবনে অসুখী হলেও তারা বুঝে উঠতে পারেন না যে, সুখহীনতার কারণ কী। ফলে ক্রমেই তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে যে কাজ ছিল তার সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান, সেই কাজকেই অসহ্য লাগতে শুরু হতে পারে।
মনে রাখা উচিত, জীবনের জন্যই কাজ, কাজের জন্য জীবন নয়। জীবনের বৃহত্তর উদ্দেশ্যের মাঝে পেশাগত কাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশমাত্র। জীবনের আরো গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে। আর একটি সুন্দর জীবনের জন্য তার সকল অংশই সুন্দর হওয়া জরুরি। আর পেশাগত কাজের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মেনে চললে সহজেই ওয়ার্কাহলিক হওয়া থেকে রেহাই পাওয়া যায়। যেমন :
- সপ্তাহে অন্তত একটি দিন সব কাজ থেকে বিরত থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে সময় দিন।
- প্রতিদিন খাওয়া-দাওয়া আর কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা ঘুমের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ করুন।
কাজের মাঝে খাওয়া বা খাওয়ার মাঝে কাজের স্বভাব পরিহার করুন। - সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।
- দিনে অন্তত একবেলা পরিবারের সকলের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাবার গ্রহণ করুন।
- নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিন।
- বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করবেন না।
- সপ্তাহে অন্তত একটি দিন বা অন্তত দু-বেলা সন্তান ও পরিবারের সাথে বিনোদনমূলক সময় কাটান।
- প্রতিদিন বিকছু সময় সন্তানের জন্য আলাদা করে রাখুন, তার সাথে কথা বলুন, তার পড়ালেখাসহ অন্যান্য বিষয়ে খোঁজখবর নিন।
- বছরে অন্তত এক বা দুবার পরিবার নিয়ে কোথাও ঘুরে আসুন।
- বই পড়া বা কোনো সুস্থ বিনোদন চর্চা করুন।
কথায় বলে, ‘জোশ দিয়ে নয়, হুশ দিয়ে কাজ করো।’ জীবনে সুখ ও পেশাগত সফলতা দুটোই সমানভাবে প্রয়োজন। তাই আসুন-কাজের জন্য জীবন ব্যয় না করে জীবনকে সুখী করতে কাজ করি।
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে