আমাদের শিশু ও তাদের ভাষা বিকাশ

মানুষ সামাজিক জীব, তাকে প্রতিনিয়ত অন্যের সাথে বিভিন্ন ধরনের সামাজিকতা সম্পন্ন করতে হয়। আর ভাষা হচ্ছে এই সামাজিকতা ও ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। কেননা মানুষ তার ভাব ও চিন্তার প্রকাশ ঘটায় এই ভাষার মাধ্যমে। অতএব ভাষা হচ্ছে মানুষের যোগাযোগের অন্যতম প্রথম এবং প্রধান মাধ্যম। একটি সুস্থ মানবশিশুর এই ভাষা বিকাশের পর্বটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়, আর তা শুরু হয় শিশুর প্রথম জন্মদিনের আগেই। শিশুর ভাষা বিকাশের আয়ত্তকরণের বিভিন্ন ধাপ ও মাত্রাগুলো নিম্নরূপ-
প্রথম ধাপ
প্রাক ভাষিক স্তর- এই স্তরকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। ১) শ্রবণ দক্ষতার সূচনা ২) কথন দক্ষতা বা ধ্বনি উচ্চারণ ৩) শিশুর বিভাষা স্তর।
দ্বিতীয় ধাপ
দ্বিতীয় ধাপটি হচ্ছে ভাষিক স্তর এবং ভাষিক ব্যবহার।
মানবশিশুর ভাষা বিকাশের একটি সুনির্দিষ্ট রূপ বা কাঠামো আছে যা সে বিভিন্ন বয়স সীমায় আয়ত্ত করে। নিম্নে একটি সুস্থ মানবশিশুর ভাষার উন্মেষ ও বিকাশের ধাপগুলো বর্ণনা করা হলো-
১) শ্রবণ দক্ষতার সূচনা- মানবশিশু মাতৃগর্ভে থাকাকালেই তার মায়ের ভাষার শ্রবণ ক্ষমতার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে থাকে, মাতৃগর্ভে বেড়ে উঠার সময়ই মায়ের গর্ভের ভেতরে ও বাইরের শব্দ সে শুনতে পায়। ফলশ্রুতিতে এই শিশু জন্মকালেই তার মায়ের ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া বিশেষ করে এই ভাষাটির বাক্যসুরের (intonation) রূপ, প্রসোডিক কন্টোর ইত্যাদি সম্পর্কে অল্প-বিস্তর পরিচিত থাকে। এই প্রক্রিয়ার কারণে যে কোনো নবজাতক শিশু জন্মগ্রহণের পর মাতৃগর্ভে থাকাকালে যে ভাষার ধ্বনি শুনেছে এবং শোনে নাই এদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে।
২) কথন দক্ষতা বা ধ্বনি উচ্চারণ- একটি স্বাভাবিক শিশু জন্মের পরেই কান্না থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের নড়াচড়া করতে শুরু করে যা ঐ শিশুটির ভাষার বিকাশের শুভ সূচনা হিসেবে গণ্য করা হয়। জন্মের ঠিক পরেই একটি স্বাভাবিক শিশু কান্নার পাশাপাশি হাসতে শুরু করে। এর অব্যবহিত পরেই সে বিভিন্ন ধরনের ধ্বনি সদৃশ আওয়াজ যথা- ভেজিটেটিভ ধ্বনি (vegetative sound) যেমন- কান্না, ঢেঁকুর তোলা, গেলা ইত্যাদি) ও কু-ধ্বনি (cooing sound) যেমন- পাখির অনুরূপ কূজন ধ্বনি) উচ্চারণ করতে শুরু করে।
চিকিৎসা ভাষাবিদদের মতে জন্মের ৪ মাস পর থেকে একটি শিশু তার বাগযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে এনে চালনা করতে সক্ষম হয়। তখন সে বাগযন্ত্রের বিশেষ খেলা (vocal play) হিসেবে উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়। ৬ থেকে ৮ মাস বয়স হতে ধ্বনি সদৃশ আওয়াজগুলো, যেগুলোকে বাকস্ফুট(babling) যেমন- বাবা, মামা, দাদা ইত্যাদি হিসেবে অবহিত করা হয় তা একটি শিশু উচ্চারণ করতে এবং আওয়াজগুলোর মধ্যে সে পার্থক্য আছে তা বুঝতে সমর্থ হয়। শিশুর উচ্চারিত এই বাকস্ফুট আপাতদৃষ্টে অর্থবোধক কোনো ভাষিক উপাদান না হলেও এই ব্যঞ্জন স্বর বিন্যাস (vocal-consonant formation) শিশুর ভাষা বিকাশের প্রথম মাইলফলক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অর্থাৎ যেসব শিশু বাকস্ফূট করার পর্যায়ে যেতে পারে তারা তাদের স্বাভাবিক ভাষা বিকাশের প্রথম ধাপে সফলভাবে উত্তীর্ণ হয় বলে চিকিৎসা ভাষা বিজ্ঞানীরা মনে করেন। তবে শিশুর ভাষার ক্রমবিকাশ বিষয়ে এটাই শেষ কথা নয়। কারণ এমনও দেখা গেছে যে, অনেক শিশু বাকস্ফূট পর্যায়টি সফলভাবে পেরিয়ে যাওয়ার পরও সে স্বাভাবিক ভাষা বিকাশের অন্য স্তরগুলো অতিক্রম করতে পারেনি বলে পরিণতিতে ভাষা বৈকল্যে (communication disorder) আক্রান্ত হয়েছে।
শিশুর বাকস্ফূট পর্যায়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সেটি হচ্ছে একটি স্বাভাবিক শিশু এই সময়টাতে শুধু নিজের উচ্চারিত এই বাকস্ফূট ধ্বনিগুলোই শুনতে পায় না বরং তার চারপাশের স্বজনদের উচ্চারিত বিভিন্ন ধ্বনিগুলো শুনতে পায় এবং এদের পার্থক্য করার ক্ষমতাও তাদের জন্মে।
চিকিৎসা ভাষা বিজ্ঞানীগণ মনে করেন শ্রবণ সমস্যায় আক্রান্ত কালা বা বধির শিশু নিজের উচ্চারিত বাকস্ফূটকে যেমন শুনতে পায় না, তেমনি অন্যের উচ্চারিত ধ্বনিগুলো শোনে না বা এগুলোকে পার্থক্য করতে সমর্থ হয় না।
৩) শিশুর বিভাষা স্তর
শিশুরা বড়দের বাচনকে অনুকরণ করে সৃষ্টি করে স্বরের বিভাষা স্তর (jargon form)। স্বরের বিভাষা বা জারগন রূপ হচ্ছে বিচিত্র রকমের ঝোঁক ও বাক্যসুরের (intonation) সমন্বয়ে সৃষ্ট অক্ষর বা উচ্চারণের সমষ্ঠি বা একটি বিশেষ ধরনের স্বরীয় অবস্থা। যদিও সব শিশু স্বরের জারগন করে না, তবুও চিকিৎসা ভাষা বিজ্ঞানীদের এই ধরনের বিভাষা বা জারগন রূপকে শিশুদের ধ্বনিগত পরিপক্কতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করেন।
ভাষিক স্তর
একটি স্বাভাবিক শিশু ১৬-১৭ মাসের মধ্যে মাতৃভাষার ব্যাকরণিক নিয়মস্তর আয়ত্তকরণের পর্বটি শুরু করে। প্রথমে সহজ নিয়ম আয়ত্ত করার পর কঠিন পর্বগুলো ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়। যেমন- ‘মা দুদু’ এখানে একটি শিশু মায়ের কাছে দুধ খাওয়ার আবদার করছে। “খেয়ে ঘুমিয়ে পড়” এই ধরনের দুই আদেশের বাক্যগুলো বুঝতে পারে, সকলের সাথে ছড়া এবং গানে অংশ নিতে পারে এবং যোগাযোগ সঙ্গী অঙ্গুলি নির্দেশ করে কিছু দেখায় তখন সে তা দেখতে পায় (joint attention)।
৩ থেকে সাড়ে ৩ বছরের একটি শিশু অন্যের সাথে সংক্ষিপ্ত কথোপকথন (simple conversion) চালাতে পারে। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে জটিল বাক্য (complex sentence) সংগঠন দিয়ে জটিল ঘটনা পরষ্পর বর্ণনা করতে পারে। যেমন- আমরা নানা বাড়ি গিয়ে অনেক মজার খেলা খেলেছিলাম।
চিকিৎসা ভাষা বিজ্ঞানীগণ মনে করেন সাধারণত ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যেই একটি শিশু মাতৃভাষার প্রয়োজনীয় সব নিয়ম কানুন আয়ত্ত করে ফেলে। তারপর যতোই সময় যেতে থাকে ততোই সে তার নিজের ভাষার আরও অন্তর্নিহিত জটিল ও অগ্রসর বিধিমালা সমূহের সাথে পরিচিত হয়। এছাড়া এই সময় শিক্ষার্থী হিসেবে শিশু তার ভাষার লিখিত রূপের সাথে পরিচিত হওয়ার সুবাদে পড়া ও লেখার দক্ষতা অর্জন করে। ধ্বনিগত সচেতনতা হলো ভাষার ধ্বনি ও বর্ণের মধ্যে সমতার বিষয়টি শেখা এবং বিভিন্ন ধ্বনির সমন্বয়ে যে শব্দ তৈরি হয় তা বুঝতে সমর্থ হওয়া। যেহেতু এই পর্যায়ে একটি স্বাভাবিক শিশু তার আয়ত্তকৃত ভাষার লিখিত রূপের সাথে পরিচিত হয়, সেহেতু তাকে এই দুই রূপের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ভাষার পাঠ্য রূপের সংশ্লিষ্ট ধ্বনিটি লিখিত রূপে সে বর্ণটিকে রূপায়িত করে তাদের মধ্যকার সম্পর্কের স্বরূপটি উন্মোচন করাই হচ্ছে ধ্বনিগত সচেতনতা। কোনো শিশুর মধ্যে ধ্বনিগত সচেতনতা অর্জনে বাঁধাগ্রস্ত হলে পরবর্তীতে তৈরি হয় লিখন ও পঠন বৈকল্য। ভাষার নিয়মাবলী আয়ত্ত করার পর শিশু এই স্তরে এক ধরনের অধিভাষাগত যোগ্যতা (metalin-guistic conpetence) অর্জন করে। অধিভাষাগত যোগ্যতা হচ্ছে ভাষার মাধ্যমে কোনো কিছু বিশ্লেষণ করে করা, রূপায়িত করা, বর্ণনা করা অথবা ভাষা নিজেই যে বর্ণনীয় ও বিশ্লেষণের যোগ্য তা জানা। ভাষার ব্যকরণগত নিয়মাবলীর যোগ্যতা অর্জন করার পরবর্তী পর্বটি হচ্ছে-
১) ভাষিক বক্তব্য- ভাষিক বক্তব্য হচ্ছে অর্থ কেন্দ্রিক। অর্থাৎ মানুষ অন্যের কাছে যখন কিছু ব্যক্ত করে তখন সেটি পরিবেশ ও পরিস্থিতি (pragmatic skill) অনুযায়ী অন্যের কাছে অর্থপূর্ণ (semantic) হতে হয়। তা না হলে দুজনের মধ্যে কোনরূপ যোগাযোগ বা সংজ্ঞাপন কর্ম (communication) ঘটে না।
২) ভাষার ব্যবহার- একটি স্বাভাবিক শিশু জন্মের আগেই প্রথম শব্দটি উচ্চারণ করতে সমর্থ হয়। বিশেষ করে একটি স্বাভাবিক শিশু মাতৃগর্ভের ৮ মাসের মধ্যেই প্রথম শব্দটি শিখে ফেলে। জন্ম পরবর্তী কালে একজন শিশু যেসব প্রাক-ভাষিক দক্ষতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, মূলত সেগুলিকেই সে ভাষা বিকাশের পূর্ব পর্যন্ত সংজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। একটি নবজাতক শিশু জন্মের সময় যেসব সংবেদনমূলক ব্যবহার (affective behaviours) নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, সেগুলির সাহায্যেই সে তার মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সংজ্ঞাপনের কাজটি সম্পন্ন করে। বিশেষ করে জন্মের প্রথম বছরের প্রাক-ভাষিক পর্যায়ে তার খাওয়াসহ বিভিন্ন ইচ্ছা পূরণের জন্য মা-বাবা বা লালন-পালনকারীর সাথে সে অঙ্গভঙ্গি, চোখাচোখি ও সুরীয় উদ্দীপনার সাহায্যে যোগাযোগ সম্পন্ন করে থাকে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে প্রথম শব্দ আয়ত্তকরণে দ্বিগুণ সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। অবশ্য এ ধরনের বিলম্বকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে ভাবার কোনো কারণ নেই।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে শুধু আয়ত্তকরণ মস্তিষ্ক শব্দ সম্ভারের (mental lexicon) বিকাশই হয় না, সাথে সাথে ভাষার গুণগত পরিবর্তন ঘটে, যা শিশুর চারপাশের পরিবেশ থেকে আয়ত্ত করে। শিশুর বয়স যখন ২ বা আড়াই বছর হয় অর্থাৎ প্রাক স্কুলগামী অবস্থা থেকে স্কুল বয়সী অবস্থা বা ৪ বছরের মধ্যেই গুণগত ভাষা (quality of language) আয়ত্তকরণের পাশাপাশি সহশব্দ (allophoreme) ও ধারণার প্রায়োগিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সমর্থ হয় যা একটি স্বাভাবিক শিশুর মস্তিষ্ক শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে থাকে। এই আয়ত্তকরণ শিশুর শৈশবকালেই শেষ হয় না। এই প্রক্রিয়াটি পূর্ণবয়ষ্ক হওয়ার পরও চলতে থাকে। কেননা আমরা বিভিন্ন সময়কালে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানগত ধারণা ও বিষয়ের সাথে পরিচিত হই যেগুলি ক্রমাগত আমাদের শব্দ ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে থাকে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleআমার মনে হয় আমার গলার রগ ছোট হয়ে যাচ্ছে
Next articleগত দুইমাস ধরে কোনো কারণ ছাড়াই আমার মন খারাপ হয়ে যায়
ডা. ফাহমিদা ফেরদৌস
চিকিৎসা ভাষাবিদ এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক (মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ) জেড,এইচ, সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here