মহামারীকালীন মানসিক সমস্যাজনিত আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয়

0
100
আত্মহত্যা
আত্মহত্যা প্রবণতা অন্যান্য মানসিক সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। আর কোভিড-১৯ মহামারীর এই দুঃসময়ে এই সমস্যা বহুল মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে তাই অন্যান্য সময়ের তুলনায় এই সময়ে আমাদের আরও বেশী মনযোগী হতে হবে। কিছু পন্থা অবলম্বন করে এই প্রবণতা প্রতিরোধ করার প্রচেষ্টা করা যেতে পারে।

আমাদের সবার জীবনই বিভিন্ন ভাবে কোভিড-১৯ দ্বারা প্রভাবিত। এর প্রভাব পড়ছে কর্মক্ষেত্রে, শিশুদের লালন পালনে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং দৈনন্দিন কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে। বিশেষ করে তাদের জন্য জীবন যাপন অত্যন্ত কঠিন প্রতিপন্ন হয়ে গেছে যারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রথম থেকেই দুর্বল ছিল। সমস্যা যত কঠিনই হোক, মানুষ সর্বদা একে অপরের পাশে থেকে লড়াই করে সেই সমস্যার সমাধান করার প্রয়াস করেছে।

কিন্তু করোনা মহামারী প্রতিরোধে যে সামাজিক দূরত্বের গণ্ডী আঁকা হয়েছে সেই গণ্ডী আমাদের কাছ থেকে সেই সুযোগও কেড়ে নিয়েছে। মানুষ এই দুঃসময়ে আরও একাকী হয়ে পড়েছে। আর যারা পূর্ব থেকেই দুর্বল চিত্ত, মানসিকভাবে শক্তিহীন তাদের কাছে মহামারীর এই দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত মানসিক দৃঢ়তা না থাকায় অনেকেই আত্মহত্যাকে সকল কষ্ট থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় হিসেবে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে সব সমস্যারই সমাধান রয়েছে। করোনা সংক্রমণ থেকে দূরে থাকতে আমাদেরকে যে সব নিয়ম পালন করতে হচ্ছে, সেগুলোকে ইচ্ছা করলে আমরা আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, এমনকি আত্মহত্যা প্রবণতা প্রতিরোধেও কাজে লাগাতে পারি। মানুষের মাঝে এই ধারণা গুলো আরও স্পষ্ট করে প্রচার করা প্রয়োজন যাতে তারা নিজের মত করে একটা আত্মহত্যা প্রতিরোধী মানসিকতা গড়ে তুলতে পারে। মহামারীর এই দুঃসময়ে মানসিকভাবে দুর্বল মানুষদের মাঝে এগুলো সুস্পষ্ট ভাবে প্রচার করার কিছু কৌশল নিম্নে তুলে ধরা হল।

১) বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে নিজ প্রচেষ্টায় মানসিক ক্ষত নিরাময়ঃ
আত্মহত্যা প্রবণ মানুষের মাঝে এমন একটা মানসিকতা কাজ করে যে সব কিছুর জন্য তারা নিজেদেরকেই দায়ী মনে করে। কিন্তু এটা একেবারেই ঠিক নয়। নিজেকে নিজের বোঝাতে হবে যে মহামারীর এই দুঃসময় আপনার বা অন্য কারোর সৃষ্ট নয়। এই সময়টাকে অসহনীয় মনে হওয়ার পেছনে আপনার কোন দায়বদ্ধতা বা ভুল নেই। নিজের আয়ত্ত্বের মধ্যে থাকা বিষয় গুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা করুন এবং যেগুলো আপনার আয়ত্ত্বের বাইরে সেগুলোকে প্রকৃতির নিয়মে চলতে দিন।

সব সময় মনে রাখবেন, পৃথিবী জুড়ে এই সময়ে সবাই আপনার মতোই বিষণ্ণতা, হতাশা, দুশ্চিন্তা এবং অসহায়ত্বের বেড়াজালে বন্দী। যেহেতু করোনা সংক্রমণ থেকে দূরে থাকতে আপনাকে বিশেষত অন্যান্যদের থেকে দূরে থেকেই সব কিছু করতে হচ্ছে তাই নিজেই নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে চেষ্টা করুন। নিজেকে বিভিন্ন বিনোদনমূলক কাজ যেমন, নতুন নতুন রান্না করা, টিভি দেখা, ভিডিও গেম খেলা, লেখালিখি, গান শোনা, ছবি আঁকা সহ বিভিন্ন কাজ যেগুলো আপনাকে আনন্দ দেয়, কষ্ট থেকে দূরে রাখে, ব্যস্ত রাখে সেসব কাজ করার চেষ্টা করুন। এসব কাজের মাধ্যমে অবশ্যই আপনি মানসিক স্বস্তি খুঁজে পাবেন।

২) প্রত্যাশায় বাঁচুনঃ
মহামারীর মত দুঃসময়ে মানুষের মন সব সময় ইতিবাচক দিক গুলো বাদ দিয়ে নেতিবাচক এবং খারাপ পরিস্থিতির দিকেই অধিক গুরুত্ব প্রদান করে। নিজের প্রচেষ্টার মাধ্যমে আপনি এটি পরিবর্তন করতে পারেন। হতাশা নয়, বরং ভালো কিছুর প্রত্যাশা করার দিকে মনোযোগ প্রদানের চেষ্টা করুন। আপনার চারদিকে তাকালে দেখবেন অনেক হৃদয়বান, সহানুভূতিশীল মানুষ আছে, অনেক সংস্থা আছে যারা এই করোনা কালে অন্যদের সাহায্য করছে। অনেক সম্ভাবনা রয়েছে যা এই দুঃসময়কে অবশ্যই সমাপ্ত করবে।  এসব বিষয় থেকে নিজে বাঁচার আশা সঞ্চয় করুন। এমন হাজার রকম কারণ আছে যা একটু চেষ্টা করলেই আপনি আপনার চারদিকে খুঁজে পাবেন যা আপনাকে সুস্থ, সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগাবে।

৩) মানুষের সাথে সংযুক্তি বাড়ানঃ
এই দুঃসময়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে অনেক মানুষের সাথেই আমাদের বহু দিন দেখা হয়নি। কিন্তু সামনাসামনি দেখা না হওয়াকে অধিক গুরুত্ব না দিয়ে আপনি যদি ভিডিও চ্যাট, ফোন কল, বা ভার্চুয়াল বিভিন্ন উপায়ে পরিবার, সহকর্মী বা বন্ধু বান্ধবদের সাথে যুক্ত থাকার সুযোগকে অধিক গুরুত্ব দেন তাহলে অবশ্যই মানসিক পীড়া এবং অসহায়ত্ব থেকে মুক্ত থাকবেন। আর যদি আপনি পরিবারের সাথেই বসবাসের সুযোগ পেয়ে থাকেন তাহলে অন্যান্যদের সাথে অধিক থেকে অধিকতর সময় অতিবাহিত করার চেষ্টা করুন। নিজের মাঝে চেপে না রেখে আপনার কাছের মানুষদের কাছে মনের কথা খুলে বলুন। তাদের সহানুভূতি আপনার মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

৪) বিভিন্ন সামাজিক এবং অর্থবহ কাজে নিজেকে যুক্ত করুনঃ
একবার ভেবে দেখুন, মানুষের এমন বিপদে আপনি কি ভূমিকা রাখতে পারছেন? কিভাবে নিজেকে অন্যদের সাহায্যার্থে কাজে লাগাতে পারছেন? একটু চারদিকে তাকালে দেখবেন এমন অনেক অনেক মানুষ আছে যারা এই মহামারীতে আপনার থেকেও অনেক বেশী সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারপরেও মানুষ বেঁচে আছে। সবাইকে নিয়ে বাঁচার প্রচেষ্টা করছে। অন্যদের দিকে তাকালে নিজের দুঃখকে অনেকটাই ছোট মনে হবে। কি করছেন আপনি তাদের সহায়তায়? এসব বিষয়ে ভাবুন। সামাজিক অনেক সংস্থা রয়েছে যারা এ সময় অন্যদের সাহায্য করছে। তাদের সাথে সামর্থ্য অনুযায়ী মিশে অন্যদের দুঃখ লাঘব করার প্রচেষ্টা করুন। যখন আপনি নিজের আগে তাদের কথা ভাববেন, অবশ্যই নিজের দুঃখকে এড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে।

৫) নিজের সুরক্ষা নিজে সুনিশ্চিত করুনঃ
যেসব বস্তু আপনাকে শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন করতে পারে, বিশেষত আত্মহননে সহায়ক বস্তু যেমন, ঘুমের ওষুধ, ব্লেড, রেজর বা বন্দুক, এসব বস্তু সহজলভ্য বা হাতের নাগালে রাখা থেকে বিরত থাকুন। এর অর্থ হল নিজের এবং এসব বস্তুর মধ্যে দূরত্ব তৈরি করুন।  এছাড়াও আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে আত্মহত্যা প্রতিরোধী বিভিন্ন গবেষণা ধর্মী লেখা পড়ুন। এতে আপনার মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা কমবে।

সব শেষে এটুকু বলতে পারি, জীবন অনেক সুন্দর। এই সুন্দর জীবনটাকে উপভোগ করুন। আপনার কাছে আপনার জীবন এবং আপনার ভালো থাকাই সব থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিৎ। নিজের মধ্যে দয়াশীল মানসিকতার বিকাশ ঘটানোর প্রয়াস করুন এবং নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন। মহামারীর এই দুঃসময়ে আপনিই একমাত্র যিনি আপনার সব থেকে বেশী সাহায্য করতে পারে। নিজেকে ভালবাসুন, আত্মহত্যা থেকে দূরে থাকুন।

মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন ক্রয়ের বিশেষ অফার

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে

Previous articleকিছুদিন আগে কিছু মানসিক সমস্যা অনুভব করি
Next articleএকাকীত্ব মানেই একা থাকা নয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here