দৃশ্যপট- ১: সুমন একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছোটবেলা থেকে এই পর্যন্ত নিয়ম মেনে চলা যেন তার একেবারে মজ্জাগত ছিল। সময়ের কাজ সময়ে করে ফেলার জন্য তার সুনাম ছিল পরিচিত মহলে। কিন্তু বিগত প্রায় মাস ছয়েক ধরে সেখানে ভর করেছে অসম্ভব অলসতা। সারাদিন হোস্টেলে নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে মোবাইল গেম খেলা ছাড়া আর কোন কাজেই সে আগ্রহ পাচ্ছে না। এর ফলে, সুমনের ক্লাসের কাজ জমে যায়, পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে সমস্যা হয় এবং তার আত্মবিশ্বাস হ্রাস পায়। প্রতিদিনই ভাবে যে এভাবে তো চলতে পারে না। আগামীকাল থেকে একেবারে ঠিক করে চলবে। কিন্তু সেই আগামীকাল আর আসে না। ইদানীং পরদিন নতুন করে শুরু করবে এটা ভাবলেও অনেক ক্লান্ত লাগে, মন থেকে আসে না উদ্যমটা। ফলাফল অলস বলে কুখ্যাতি অর্জন। সে ভাবে কি করে সে এমন অলস হয়ে পড়ল আর কিভাবেই বা মুক্তি পাবে?
দৃশ্যপট- ২: মুনিয়া একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। অনেক সংগ্রাম আর মানসিক দৃঢ়তার মিলিত ফলাফলে তার আজকের এই অবস্থান। নিজের পরিশ্রমী মনোভাব আর বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাভাবনার কারণে অতি অল্প সময়েই অফিসের একজন অপরিহার্য কর্মকর্তা হয়ে উঠে সে। ফলে, নিজের জন্যেও বরাদ্দ করা একগাদা কাজ তো আছেই, সাথে সহকর্মীদেরও অনেক কাজে টুকটাক এটা-সেটা করে দিতে হয় প্রতিদিন। এমনকি উর্ধতনরাও কোন সমস্যা হলেই আগে ডাক দেন মুনিয়াকে। শুরুর দিকে এসব উপভোগ্য থাকলেও এখন কেমন যেন ক্লান্ত লাগে। অতিরিক্ত কাজের চাপ, সেই সাথে ঠিক ভাবে করার মানসিক চাপ, আর সবার কাছে ভালো অবস্থান ধরে রাখতে পারার উদ্বেগের কারণে সে ধীরে ধীরে অলস হয়ে যাচ্ছে। করবো আর কি, আরেকটু পরে করবো, এভাবে করতে করতে জমে গেছে অনেক কাজ। এখন জমে থাকা কাজের দিকে তাকালে আরো অলসতা বেড়ে যায়। কাজ জমে থাকা এবং সময়মতো সম্পন্ন না করার ফলে তার চাকরিতে অনেক সমস্যা তৈরি হতে থাকে।
“কত রবি জ্বলে রে, কে বা আঁখি মেলে রে?”- অলসতার একটা আদর্শ গল্প থেকে নেয়া এই উক্তিটি যেন অলসতার চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে আছে। অলসতা একটি সাধারণ আচরণগত বৈশিষ্ট্য যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এটি শুধুমাত্র সময় নষ্ট করার প্রবণতা নয়, বরং এর মাধ্যমে জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। এই যে অলসতা, এটা আসলে কি?
অলসতা বলতে বোঝায় কোনো কাজ করার ইচ্ছার অভাব বা কাজকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা। এটি কখনো শারীরিক ক্লান্তি, কখনো মানসিক অবসাদ বা আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকে উদ্ভূত হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে কোনো কারণে কারো যদি অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে উঠে তাহলে তার কুফল হিসেবে অলসতা দানা বাঁধে। উপরের উদাহরণের সুমনের মতোই শুরুর দিকে বিষয়টা বুঝা না গেলেও পরবর্তীতে এক বিরাট সমস্যা হিসেবে উদয় হতে পারে অলসতা। যেমন আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে ফেলার পর যে অখন্ড অবসর সময় পাওয়া যায়, তখন বেশি বেশি মোবাইল ব্যবহার, বা সিনেমা দেখা, বা রাত জাগা, বা অন্য কোন অনিয়মের সূচনা হয়। শুরুতে বাবা-মা কেউই এটাকে অত সমস্যা মনে করেন না; অবসর সময় – কি করবে, এসব ভেবে। যার ফলে পরবর্তীতে অলসতা জেঁকে বসে জীবনে।
তবে, মানসিক স্বাস্থ্যের কিছু সমস্যা সমস্যা থেকেও হতে পারে অলসতা। যেমন-
মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: অতিরিক্ত চাপগ্রস্ত হলে কাজ করার আগ্রহ কমে যেতে পারে। মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ অলসতার একটি প্রধান কারণ।
- ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা: বিষণ্ণতা মানুষকে কর্মহীন ও নিষ্ক্রিয় করে তুলতে পারে। এটি অলসতার সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি।
- আত্মবিশ্বাসের অভাব: কোনো কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারব না- এই ভয় অলসতাকে বাড়িয়ে তোলে।
- পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব: ঘুম কম হলে শরীর ও মন ক্লান্ত থাকে, যা অলসতার জন্ম দেয়।
- প্রয়োজনীয় লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের অভাব: জীবনে কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকলে মানুষ অলস হয়ে পড়ে।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন অলসতার জন্ম দেয়, তেমনি অলসতাও মানসিক স্বাস্থ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে এটি ধীরে ধীরে ব্যক্তি ও সমাজের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। যেমন- বিষণ্ণতা বৃদ্ধি। অলসতা বিষণ্ণতার একটি সাধারণ কারণ এবং ফলাফল উভয়ই হতে পারে। অলস সময় কাটানোর ফলে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা বেড়ে যায়, যা বিষণ্ণতার মাত্রা বাড়ায়। কাজের অভাব মানুষের মধ্যে একাকীত্ব এবং মানসিক অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে। আবার আত্মবিশ্বাস হ্রাস ঘটে অলসতার কারণে। অলসতার কারণে কাজের অনিয়মিততা ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সময়মতো কাজ সম্পন্ন না করতে পারলে অপরাধবোধ তৈরি হয় এবং আত্মবিশ্বাস আরও কমে যায়। অলসতা কাজের চাপকে আরও বাড়িয়ে তোলে। যখন কাজ জমে যায়, তখন উদ্বেগ এবং চাপের মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে যায়। এটি দীর্ঘমেয়াদে মানসিক স্বাস্থ্যহানির কারণ হতে পারে, হতে পারে যে কোন উদ্বিগ্নতাজনিত রোগ। শুধু তাই নয়, অলসতা মানসিক স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করে। জীবনে যদি কাজের গতিশীলতা না থাকে, তাহলে মানসিক স্থিরতা নষ্ট হয়। এটি দীর্ঘমেয়াদে আরও বড় মানসিক সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর সামাজিক ক্ষতির কথা বললে বলতে হয় অলসতার ফলে সামাজিক কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। এটি ধীরে ধীরে ব্যক্তি ও তার আশেপাশের মানুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে এবং একাকীত্বের জন্ম দেয়।
আর তাই অলসতাকে গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিৎ। অলসতা কাটিয়ে উঠতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে কিছু কৌশল উল্লেখযোগ্য:
১. লক্ষ্য নির্ধারণ
নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকলে কাজ করার জন্য উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। ছোট এবং সহজ লক্ষ্য নির্ধারণ করে ধীরে ধীরে তা অর্জনের চেষ্টা করা উচিত।
২. দৈনন্দিন রুটিন তৈরি
নিয়মিত রুটিন মেনে চলা অলসতা কাটানোর একটি কার্যকর উপায়। রুটিনে সময়মতো ঘুম, খাওয়া, কাজ, এবং বিশ্রামের সময় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
৩. মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, এবং মানসিক চাপ কমানোর অন্যান্য কৌশল অনুসরণ করা যেতে পারে। এতে মনকে শান্ত রাখা যায় এবং অলসতার মাত্রা কমে।
৪. আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি
নিজের কাজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া জরুরি। ছোট ছোট সফলতা উদযাপন করলে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
৫. প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ
অলসতার অন্যতম কারণ হল অতিরিক্ত সময় প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যয় করা। এর জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা এবং অন্যান্য কাজে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
৬. পেশাদার সাহায্য নেওয়া
যদি অলসতা অত্যধিক হয়ে যায় এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলে, তবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া উচিত।
অলসতা মানসিক ও শারীরিক সমস্যার পিছনে একটি বড় উপকরণ, যা সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব। এর প্রভাব শুধু ব্যক্তির ওপর নয়, বরং সমাজের ওপরও পড়ে। মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা এবং জীবনে সাফল্য অর্জনের জন্য অলসতা কাটিয়ে ওঠা অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং সঠিক কৌশল অনুসরণ করলে অলসতাকে পরাজিত করা সম্ভব। তাই, অলসতাকে দূর করতে আর অলসতা নয়- সক্রিয়ভাবে চেষ্টা শুরু করুন এখনই।
ডা. পঞ্চানন আচার্য্য
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।
সিরিয়ালের জন্য ভিজিট করুন- এপোয়েন্টমেন্ট
আরও দেখুন-



