বাংলাদেশে প্রতি চার জন মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়৷ আর প্রতি ছয় জন ছেলে শিশুর মধ্যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় একজন৷ শুধু পুরুষ নয়, শিশুরা কখনো কখনো নারীর হাতেও যৌন হয়রানির শিকার হয়৷
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড এডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি’র সহযোগী অধ্যাপক৷ তিনি দীর্ঘদিন ধরে যৌন হয়রানির শিকার শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন৷ আর এই কাজ করতে গিয়ে তিনি যৌন হয়রানি নিয়ে ক্লিনিক্যাল গবেষণা করেছেন৷ তাঁর এই গবেষণায় শিশুদের যৌন হয়রানি বিষয়ে ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে৷ তাতে দেখা যায়, শতকরা ৭৫ ভাগ যৌন হয়রানির ঘটনাই ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে৷ আর ছেলে শিশুরাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে৷ প্রতি ছয় জন ছেলে শিশুর মধ্যে একজন যৌন হয়রানির শিকার৷ মেয়ে শিশুদের মধ্যে তা প্রতি চার জনে একজন৷
যৌন হয়রানির শিকার শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁরা দেখেছেন, পুরুষরাই প্রধানত যৌন হয়রানিকারী, তবে নারীদের বিরুদ্ধেও এখন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷ যৌন হয়রানির এই ঘটনা ঘটে বাড়িতে, আত্মীয় বা পারিবারিক বন্ধুদের বাড়িতে, স্কুলে, স্কুলে যাওয়ার পথে, পরিচিত পরিবেশে৷ পরিচিত জন ছাড়া শিশুদের যৌন হয়রানির ঘটনার নজির খুবই কম৷
আর বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, যৌন নিপীড়নের শিকার শতকরা ৫ ভাগ ছেলে শিশু৷ মেয়ে শিশু শতকরা ৯৫ ভাগ৷
শিশুদের যৌন হয়রানির মধ্যে ধর্ষণ ছাড়াও তাদের ওপর নানা ধরনের শারীরিক আক্রমণ, বলাৎকার, স্পর্শকাতর ও যৌনাঙ্গে অসৎ উদ্দেশ্যে স্পর্শ অন্যতম৷
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাবে গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৯৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৮ জন শিশু৷ ৫০ জন শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে৷ ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ছয় শিশু৷ ধর্ষণের শিকার শিশুদের মধ্যে ২২ জন শিশু প্রতিবন্ধী৷
ওই সময়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসে ইভটিজিং-এর শিকার হয়েছে ৩৮ জন শিশু৷ নানা ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৭৪ জন শিশু৷ যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করতে গিয়ে যৌন হয়রানিকারীদের মারধরের শিকার হয়েছে ১৮ জন শিশু৷ আর পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ১২ জন শিশু৷
শিশু যৌন নিপীড়নের ঘটনা বাড়ছে৷ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাব মতে, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, ২০১৫ সালে ৫২১ জন শিশু, ২০১৬ সালে ৪৪৬ জন শিশু, ২০১৭ সালে ৫৯৩ জন শিশু এবং ২০১৮ সালের প্রথম ৯ মাসে ৪৯৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়৷ যৌন নিপীড়নের আরো যে বিষয়গুলো আছে, তা-ও বাড়ছে৷ আর শিশু অধিকার ফোরাম এই হিসাব দিয়েছে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে৷ বাস্তবে শিশুদের যৌন নিপীড়নের অনেক ঘটনা সামাজিক ও পারিবারিকসহ নানা কারণে প্রকাশই হয় না৷
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের প্রোগ্রাম অফিসার আজমী আখতার বলেন, ‘‘সাধারণত নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরাই যৌন নিপীড়নের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি৷ তারা বস্তিতে বসবাস করে বা তাদের পারিবারিক সুরক্ষা নেই বললেই চলে৷ আর যারা শিশু যৌন নিপীড়ক, তারাও অধিকাংশ ওই পরিবেশের৷ তবে তারা ওই বাস্তবতায় প্রভাবশালী৷”
যৌন নিপীড়নের শিকার শিশুদের জন্য বিশেষ সেবার প্রয়োজন হয়৷ কারণ, তারা ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে৷ এমনকি বাবাকে দেখলেও ভয় পায়৷ বিশেষ কোনো স্থান বা পোশাকের প্রতিও তাদের ভীতির সৃষ্টি হতে পারে৷ কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্যই হারিয়ে ফেলে৷ আজমী আখতার বলেন, ‘‘দেশে কঠিন আইন আছে৷ কিন্তু আইন থাকলেও বিচারহীনতার কারণে শিশু যৌন নিপীড়ন বাড়ছে৷ কারণ, অনেক সময় এর বিচার চাইতে গিয়ে ভিকটিমের পরিবার সামাজিক নিন্দার শিকার হয়৷ আর যারা যৌন হয়রানি করে, তারা তুলনামূলকভাবে প্রভাবশালী থাকে৷ ফলে তারা বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত বা নিজেদের পক্ষে নিতে সক্ষম হয়৷ তাই পারিবারিক সুরক্ষাই এখানে প্রথম কাজ বলে আমি মনে করি৷”
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আমরা দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে দেখেছি, যেসব শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, তারা পরবর্তী জীবনে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগেন৷ কেউ কেউ যৌন নিপীড়কও হয়ে ওঠে৷”
শিশুরা সাধারণত যৌন নিপীড়নের শিকার হলে তা প্রকাশ করতে পারে না৷ তবে তাদের কিছু আচরণ পর্যবেক্ষণ করলে মা-বাবা অথবা পরিবারের সদস্যরা তা বুঝতে পারেন৷ তারা কোনো ব্যক্তিকে দেখলে ভয় পেতে পারে৷ কোনো বাসায় যেতে না চাইতে পারে৷ কোনো স্থানকে ভয় পেতে পারে৷ কাউকে দেখলে লুকিয়ে থাকতে পারে৷ কারুর কাছে আগে যেতো, কিন্তু এখন যেতে চায় না – এমন হতে পারে৷ আবার কোনো শিশু এমনিতে বিছানায় প্রস্রাব করে না, কিন্তু হঠাৎ করে বিছানায় প্রস্রাব শুরু করতে পারে৷ কোনো বিশেষ অঙ্গে ব্যথার কথা বলতে পারে৷ মা-বাবাকে এসব বিষয় খেয়াল করে জানার চেষ্টা করতে হবে৷ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘শিশুকেও সচেতন করা যায়৷ কোনটা গুড টাচ, কোনটা ব্যাড টাচ তাকে তা জানাতে হবে৷ খেয়াল রাখতে হবে, শিশুর প্রতি পরিচিতজন কেমন আচরণ করে৷ এমন কারুর কাছে শিশুকে রাখা যাবে না, যার মাধ্যমে শিশুর যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে৷ তার স্কুল, তার খেলার জায়গা, তার বেড়ানোর জায়গায় যেসব আশঙ্কা আছে, সেসব সম্পর্কে তাকে কৌশলে সচেতন করতে হবে৷”
আজমী আখতার বলেন, ‘‘একটু বড় শিশু হলে তাকে সতর্ক করা যায়৷ কিছু বিষয় তাকে বলা যায়৷ কিন্তু ছোট শিশুদের তো তা বলা বা বোঝানো যায় না৷ আর অনেক সময় তা হিতে বিপরীত হতে পারে৷ তাই পারিবারিক সুরক্ষা সবার আগে প্রয়োজন৷ শিশুকে কোনো পরিবারের কোনো বন্ধু-বান্ধব, কোনো আত্মীয়ের বাসা, পরিচিতদের কাছে, গৃহকর্মী বা ড্রাইভারের কাছে একা রাখা উচিত হবে না৷ মোট কথা, যতদূর সম্ভব শিশুকে বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে তাঁদের দৃষ্টির মধ্যে রাখতে হবে৷”
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০৩-এ ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডের বিধান আছে৷ তবে এটাকে মৃত্যুদণ্ড করার দাবি আছে বিভিন্ন মহল থেকে৷ আর অন্যান্য যৌন নিপীড়নের অপরাধেরও সর্বোচ্চ সাত বছর থেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের বিধান আছে৷ আর আইনে যৌন নিপীড়ন ও যৌন হয়রানি কোন কাজকে বলা হবে, তা-ও সুনির্দিষ্ট করে দেয়া আছে৷
গত ২২ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার সংসদে শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন৷ যৌন নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থতা শিকার করে নাগরিকদের কাছে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ক্ষমা চায় অস্ট্রেলিয়া৷ হাউস অব রিপ্রেজেন্টিটিভের গ্রেট হলে এদিন জড়ো হয়েছিলেন ৮০০-রও বেশি মানুষ৷ তাঁদের সামনে দাঁড়িয়েই সারা বিশ্বের জন্য অনন্য এই ঐতিহাসিক নজির সৃষ্টি করেন অস্ট্রেলিয়ার আইনপ্রণেতারা৷ এদিন বিরোধীদলীয় নেতাও একইভাবে নিপীড়িতদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন৷
সূত্র: ডয়চে ভেলে