পাশের বাসায় অনেক্ষণ ধরে সায়েমা সায়েমা বলে চিৎকার করছে এক মধ্য বয়সী লোক। আন্দাজ করে বুঝলাম মেয়েটি রাগ করে দরজা লাগিয়ে রেখেছে। বাবা তার মেয়ের দরজা খোলানোর জন্যে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে নাম ধরে ডেকেই যাচ্ছে।
আমার ভিতরে ভয় লাগছিল মেয়েটি নিজের কোনো ক্ষতি করে বসলো কিনা! কেননা, ঘন্টা খানেক হয়ে গেছে কোনো সাড়া শব্দ নেই। ইদানীং কিশোর কিশোরীর অতিরিক্ত রাগ, জেদের সাথে সাথে, রাগ করে দরজা লাগিয়ে রাখা,না খেয়ে থাকা, নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে।
অনেক্ষণ পর ভিতর থেকে আওয়াজ এলো, খুব নিচু স্বরে, ” আমাকে একা থাকতে দেন”। কিন্তু বাবা ডেকেই যাচ্ছে। তার ভিতরেও হয়তো কোথাও কোনো আশংকা লুকিয়ে আছে।
এমন এডোলুসেন্ট, মানে কিশোর কিশোরী বয়সে ভিন্ন ধরনের আচরণ, হঠাৎ রেগে যাওয়া, দ্বিমত পোষণ করা, কথা না শোনার প্রবণতা, সাথে আরো অনেক অযাচিত আচরণ আমরা প্রায়ই লক্ষ করে থাকি।
করোনাকালে এই সমস্যা গুলো বেড়ে গিয়েছে অনেক গুন।এর পিছনে বড় একটি কারণ হলো, পরিপূর্ণ নিয়মের অভাব। সোজা ভাষায় বললে বলা চলে, অবসর সময় অনেক বেশি এবং সে তুলনায় কাজের পরিমান কম হওয়ায়, অনেকটা সময় ধরে কর্মহীন থাকার বিরুপ প্রভাব এর বহিঃপ্রকাশ এটা!
ঘুমের সময় পালটে গিয়েছে, খাওয়ার সময় ও অনিয়ম, ডিজিটাল স্ক্রিনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় ব্যয়, মাত্রাতিরিক্ত ফাস্ট ফুড গ্রহণ করা এবং অনিশ্চিত একটি জীবন যাপন, শুধু শিশু কিশোর নয় বড়দের মনেও বিরুপ প্রভাব ফেলছে।
এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে আমরা এর থেকে বের হবো? কি আচরণ করলে শিশু কিশোরদের এই অযাচিত ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে?
প্রথমত, উত্তর হলো, শিশু কিশোরের ব্যবহার,তাদের স্বাধীন ইচ্ছা, আবেগ নিয়ন্ত্রণের আমি পক্ষপাতী নই। কারন আপনি একজনের জীবনের বেশ খানিকটা অংশ নিজে নিয়ন্ত্রণ করে, শেষমেষ আশা করবেন যে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সে সম্পূর্ণ সঠিকভাবে নিবে, এটা কখনোই সম্ভব নয়! আপনি আপনার সন্তানের নিয়ন্ত্রক নন বরং সহায়ক হিসেবে কাজ করবেন। আপনার সন্তানের আবেগ, ইচ্ছা, অনুভূতিকে গুরুত্ব দিন। সিদ্ধান্ত আপনার সন্তানকে নিতে দিন, আপনি সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করুন। সেই সিদ্ধান্তের ভালো খারাপ দিক তাকে নিয়ে বিশ্লেষণ করুন।
পরবর্তী আরেকটি যে ব্যাপার নিয়ে আপনাকে অবশ্যই কাজ করতে হবে, তা হলো একটি স্বাভাবিক নিয়মে সন্তানকে নিয়ে আসা। তার জন্যে আপনাকে নিজেকে সঠিক নিয়মে আসতে হবে। মনে রাখবেন, আপনার সন্তান আপনাকে ফলো করে। আপনি যদি অফিস বন্ধ বলে দেরীতে ঘুম থেকে উঠেন, তাহলে আপনার সন্তান ঠিক টাইমে ঘুম থেকে উঠবে এটা আশা করা অযৌক্তিক! আপনি প্রথমে আপনার নিজের দৈনন্দিন নিয়ম ঠিক করুন, এরপর আপনার সন্তানের দৈনন্দিন নিয়ম ঠিক করা নিয়ে কাজ করুন। তাহলেই আপনি সফল হবেন। এবং এখানে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখবেন দৈনন্দিন নিয়ম বলতে আমি শুধু পড়ালেখার কথা বুঝাইনি। এখানে আপনার সন্তানের প্রতিটি কাজ,সেটা নাস্তা খাওয়া থেকে শুরু করে খেলার সময়, গোসলের সময়, টিভি দেখার সময়ও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
অনেক বাবা-মা বলেন সন্তানকে ডিজিটাল স্ক্রিন কখনোই ব্যাবহার করতে দিতে চান না। এগুলো আসক্তি করে তাই। আমার মতামত হলো আমি যদি সন্তানকে আধুনিক বিশ্বের সাথে পরিচয় না করাই তাহলে সে সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে আগাবে কিভাবে? আপনি অবশ্যই ডিজিটাল ডিভাইস সন্তানকে দিতে পারেন। তবে এখানে সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। এবং এটাও রুটিনে যুক্ত থাকতে হবে যে সে কতটা সময় ডিজিটাল স্ক্রিন ব্যাবহার করবে।
সন্তানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাফল্যকে উৎসাহ দিন। তার অযাচিত ব্যাবহার কে ডিসকারেজ করুন। তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করুন। কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ আপনার সাথে আপনার সন্তানের দুরত্বের তৈরি করবে। কোনো ভুল করে বসলে অভয় দিন, তাকে সমাধানের রাস্তা দেখিয়ে দিন। এমন সম্পর্ক সন্তানের সাথে না থাকাই ভাল যেখানে আপনার সন্তান তার ভুলের কথা আপনার কাছে বলতে ভয় পায়। কেননা এমনটি হলে ভুলের পরিমান বাড়তেই থাকবে এবং সঠিক সমাধানের পথ সে পাবে না।
আমরা যদি স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে পারি তাহলেই তাদের অযাচিত আচরণ অনেকটাই কমে আসবে। এবং আপনার সন্তান একটি কোয়ালিটিফুল জীবন যাপন করতে পারবে। এরপরও যদি কারো মাঝে অযাচিত আচরণ, অতিরিক্ত রাগ, জেদ দেখা যায় তাহলে অবশ্যই একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে