মাদকাসক্তি একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ

মাদকাসক্তি, মাদক সম্পর্কিত রোগগুলো, মাদকাসক্তি একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ

আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে মাদকাসক্তিকে বলা হচ্ছে একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ। বৈজ্ঞানিকভাবে বিভিন্ন মাদক সম্পর্কিত রোগগুলো একসাথে বলা হচ্ছে, Substance-Related and Addictive Disorders। অন্যদিকে জুয়া আসক্তিকে বলা হচ্ছে, Non Substance-Related and Addictive Disorders Gambling।

অনেকেই মনে করেন, মাদকাসক্তি এমনি এমনিতে সেরে যেতে পারে। চিকিৎসার নেয়ার বিষয়েও আছে বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস গড়িমসি এবং ঢিলেমি। বিষয়টিকে এভাবে না ভেবে অন্য আরো দশটা রোগের মতোই রোগ ভাবা উচিত। তাতে লাভটি হচ্ছে, চিকিৎসার বিষয়টি যে, দরকারি এটি দ্রুত বোঝা যাবে। অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে, আমরা যেমন জানি, চিকিৎসা ছাড়া ভালো হয় না তেমনি মাদকাসক্তি ছাড়তে হলেও চিকিৎসা লাগবে এই ব্যপারটি মেনে নেয়া সহজ হয়।

মাদকাসক্তরা নিজের বিশ্বাসের কারণেই হোক বা ভুল বোঝার কারণেই হোক তারা মনে করেন যেকোনো সময় ইচ্ছা করলেই তারা এটি থেকে সরে আসতে পারবে। বাস্তবে কি এটি সম্ভব হয়! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিভাবকরা বিভ্রান্ত হয়, কী করা যায়, কী করা উচিত এই ভেবে। বিভ্রান্ত হবার আরো কারণ হয়তো আছে। যেমন মাদকাসক্তির চিকিৎসা এখনো অনেক ব্যয় বহুল ও কষ্টসাধ্য। তাই চিকিৎসা করাতে গিয়েও হয়তো অনেকে হিমশিম খায় এবং অনেকে ক্ষেত্রে পিছু হটা ছাড়া উপায় থাকে না।

এসব কে মেনে নিয়ে হলেও চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হয়, ভালো হবার সম্ভাবনাও ততই বেশি থাকে। সেই কারণেও এই রোগটিকে রোগ হিসেবে মেনে নেয়া জরুরি। রোগ হিসেবে মেনে নিতে পারলে চিকিৎসা হয়তো তাড়াতাড়িই শুরু করা সম্ভব হবে এবং এটিও বোঝা সম্ভব হয় অন্য কোনো পদ্ধতিতে এই আসক্তি ভালো হবার নয়।

কীভাবে একজন আসক্ত মানুষকে চিহ্নিত করা যেতে পারে?

এক এক মানুষ এক একভাবে চিন্তা করে, একই বিষয়ে ভিন্ন মানুষ ভিন্ন আচরণ করে থাকে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে মানুষের আচরণের এই ভিন্নতার কথা বলে শেষ করা যাবেনা। তবু সাধারণভাবে একজন মানুষ কী ধরনের আচরণ করে, কীভাবে চলে, তার একটা সাধারণ ধারণা আশপাশের মানুষের ভেতর তৈরি হয়ে যায়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানুষের এই আচরণ ও চিন্তার পদ্ধতি দিয়েই মানুষকে চেনা যায়।

যখন কোনো একজন মানুষের চেনা পরিচিত সেই আচরণগুলো পরিবর্তন হতে থাকে, তখনই সেটিকে আমলে আনতে হবে। এটা শুধু মাদকাসক্তির কারণে ঘটে থাকে এমন কোনো কথা নেই। বিভিন্ন মানসিক রোগ ও মানসিক সমস্যার কারণেও সেসব হতে পারে। তবে মাদকাসক্তির প্রথম দিকের সমস্যাগুলির একটি হচ্ছে মানুষের চেনা পরিচিত সাধারণ আচরনগুলো পরিবর্তন হতে থাকা।

– দেখা যায় মানুষটি আগের চেয়ে বেশি সময় একা একা থাকতে চায় বা পছন্দ করে।
– তার প্রতিদিনের ভালোলাগা বা ভালোবাসার কাজগুলো থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে।
– নিজের প্রতি, নিজের শরীরের প্রতি যত্ম কমে আসে। তুলনামূলকভাবে অপরিষ্কার বা অপরিচ্ছন্ন থাকে।
– সময়মতো গোসল করা, দাঁত মাজা বা নিজের কাপড়-চোপড়ের প্রতি অনীহা চলে আসে।
– বেশিরভাগ সময়ই মন খারাপ এবং ক্লান্ত থাকে, অলস ও অপরিকল্পিত সময় কাটায়।
– কখনো উল্টোটাও দেখা যায়। খুব দ্রুত কথা বলে, অর্থহীন কথা বলতে থাকে কিংবা খুব কর্মতৎপর হয়ে উঠে। যদিও এসবের কোনো প্রকৃত অর্থ থাকেনা। অর্থাৎ অর্থহীন অদ্ভুত কাজ করতে থাকে।
– যখন তখন নার্ভাস হয়ে যেতেও দেখা যায়।
– মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। যখন তখন রেগে যাওয়া বা বিরক্ত হয়ে যাবার প্রবণতাও দেখা যায়।
– হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ থেকে মন ভালো আবার মন ভালো খারাপ বিষয়গুলো দ্রুতই ঘটতে থাকে।
– অসময়ে এবং অস্বাভাবিক মাত্রায় ঘুমিয়ে থাকে।
– অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজে মনোযোগ দিতে পারেনা।
– প্রায়ই করনীয় কাজটি করতে ব্যর্থ হয়। যেমন; সময় মতো স্কুলে, কলেজে যাওয়া বা কাজে যাওয়া ঠিক থাকেনা। কারো সাথে সময় দিয়ে সময় মতো কথা দিয়ে কথা রাখতেও ব্যর্থ হয়।
– কাজের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঝামেলার সৃষ্টি হয়।
– খাওয়া দাওয়া ঠিক থাকেনা। খাওয়া দাওয়ার রুটিন ও পরিমাণ সবই উলট-পালট হয়ে যেতেও দেখা যায়।
– নেশা করার সময় নিজের উপর প্রায়ই কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকেনা।
– দিন দিন নেশার চাহিদা বাড়তে থাকে।
– নেশা বন্ধ করতে চাইলে অস্বস্থি ও অসুস্থ বোধ করে।
– সেই অস্বস্থি কাটাতেও তারা বারবার এবং বেশি বেশি নেশাদ্রব্য নিতে থাকে।
– শারীরিক, পারিবারিক, সামাজিক ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলগত সমস্যা হওয়া সত্ত্বে নেশাদ্রব্য নেয়া চালিয়ে যেতে থাকে।
– নেশার টাকা জোগাড়, নেশা পাওয়া ও নেশা গ্রহণের পেছনে প্রচুর সময় ব্যয় হয়। ফলে টাকা পয়সার দিকে প্রচুর ঝোঁক তৈরি হয়।
– কোথায় কীভাবে টাকা পাওয়া যাবে, সেই চিন্তায় কখনো কখনো অস্থির থাকতেও দেখা যায়।
– ঘরে বাইরে সহজেই প্রতারণা ও মিথ্যা কথা বলতেও দেখা যায়।
– প্রায়ই চোখ লাল থাকে। শরীর কাঁপতে থাকে।
– কথার ভলিয়ম ও টোন পরিবর্তন হতে থাকে।
– তারা খুব সহজেই মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। ব্যক্তিত্ব বোধ পরিমিতি বোধ কমে আসে।
– কোথায়, কার সাথে কী করতে হবে, কতটুকু করতে হবে সেসব বিষয়গুলোয় ঠিকমতো কাজ করে না।

নেশা বা মাদকাসক্তির ফলে মানুষটি দ্রুতই পরিবর্তন হতে থাকে। এই পরিবর্তন, চিন্তা ভাবনা আচরণ কাজ সব দিকেই পড়তে শুরু করে।

মনের খবর ডেস্ক

Previous articleমানসিক রোগের ওষুধ নিয়ে বিভ্রান্তি
Next articleবাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, সন্তানের মনোকষ্ট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here