প্রতিটি দেশের অন্যতম সম্পদ সে দেশের প্রবীণগণ। বয়স বৃদ্ধির পাশাপশি বাড়তে থাকে তাদের অভিজ্ঞতা। কিন্তু বাংলাদেশ ও পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে একটা সময় পর প্রবীণদের কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর দিয়ে দেয়। অবসরের পর একজন প্রবীণের মাঝে ঘটে আমুল পরিবর্তন। থাকে না তার দৈনন্দিন রুটিনের ধারাবাহিকতা। আচমকা এই ধারাবাহিকতায় বিঘ্ন ঘটায় মানসিক চাপে ভোগেন তারা। সেক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের অবণতির পাশাপাশি হয় তাদের শারিরিক অবস্থার অবনতিও।
এছাড়া বয়স বাড়ার পরিক্রমায় শারিরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে। পাশাপাশি একক পরিবারের হার বেড়ে যাওয়ায় শেষ বয়সে একা হয়ে যাচ্ছেন তারা। আর এতে করেই দিনদিন মানসিক স্বাস্থের অবনতি হয় তাদের। কিন্তু অনেকেই নিচ্ছেন না মানসিক স্বাস্থ্য় সেবা। ফলে তারা আচ্ছন্ন থাকেন নানা হতাশা ও অবসাদে। তবে অনেকেই স্বাস্থ্য সচেতেন, শারিরিক স্বাস্থের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থের যত্নও নেন তারা। যদিও সেই সংখ্যাটা আনুপাতিক হারে অনেক কম।
মানিসক স্বাস্থ্য অবনতি হওয়ার পর যথাসময়ে চিকিৎসা না নিয়ে অনেকের জীবনে নেমেছিল বিপর্যযতা আর অনেকেই যথাসময়ে চিকিৎসা নিয়ে পেয়েছেন সুস্থতা। যথাসময়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়া এবং দীর্ঘসময় চিকিৎসাহীনতায় ভুগে পরিশেষে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়া দুজন প্রবীনের জীবনে ঘটে যাওয়া গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের প্রবীণ মন।
আমজাদ সাহেব হেটে চলছেন। চারদিকে সবুজের সমারোহ। সরু মেটো রাস্তার দুই পাশেই সারিবদ্ধ তালগাছ। অজনা এক গন্তব্যের উদ্যেশ্যে ছুটছেন তিনি। তার পিছেনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে হামিম। হামিম আমজাদ সাহেবের বড় ছেলের সন্তান। দাদাকে ফেরাতেই পিছু নিয়েছে হামিম।
মাস খানেক আগেই অবসর নিয়েছেন আমজাদ সাহেব। পেশায় একজন ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। কিন্তু অবসরের পরদিন থেকে তাকে নিঃষ্প্রাণ দেথা যায়। তার স্মৃতিতে তখন অফিস ও সহকর্মীদের প্রতি টান বিরাজমান্। সবাইকে হারিয়ে তিনি ডুবে যান হতাশার মহাসাগরে। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম কিছুই ছিল না তার মাঝে। এরকম কাণ্ডে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয় তার। পরিবারের কেউ কিছু বললেই খিটখিটে হয়ে যেতেন তিনি। একটা সময় যা সীমার বাইরে চলে যায়।
চিরচেনা মানুষটির এমন পরিবর্তনে ভড়কে যান তারা। কেউ কেউ ভাবছেন ভূত-প্রেতের আসর কিনা। আর সেই ভাবনা থেকেই বাড়িতে ডাকা হয়েছিল ওঝা। সবার ধারণা ছিল ওঝার ঝাড়-ফুঁকেই কেটে যাবে সব। কিন্তু প্রাচীন এ কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন না আমজাদ সাহেব। তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান। তারপর রাগান্বিত হয়ে বাড়ি ছেড়ে যান তিনি।
দাদার মানসিক অবস্থার এই অবণতির কথা শুনে শহর থেকে বাড়িতে আসেন হামিম। কিন্তু বাড়িতে প্রবেশ করে হতভম্ব হয়ে যায় সে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কুসংস্কারে বিশ্বাসী তারই পরিবারের মানুষজন। ব্যাগটা রেখে দাদাকে দেখতে চায় সে। একসময় জানতে পারে আমজাদ সাহেব সেখানে নেই। কিছুক্ষণ আগেই রেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন তিনি।
হামিম তখন আমজাদ সাহেবকে অনুসরণ করতে থাকে। একসময় সে আমজাদ সাহেবের কাছে পৌছায়। হামিমকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন আমজাদ সাহেব। হামিম কে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেন- তুই আসছিস দাদুভাই! এদের কেউই আমাকে বুঝে না। অবসরের পর থেকে বাড়িতে একা থাকি। কেউ সঙ্গ দেয় না, সবাই ভাবে আমাকে জ্বীনে পেয়েছে। তুই তো বুঝিস, এসব সবই ভ্রান্ত ধারণা।
হামিম তাকে উদ্যেশ্য করে বলে- সব ঠিক হয়ে যাবে দাদু।
এরপর হামিম আমজাদ সাহেবকে বুঝিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নেয়। দুদিন পর আমজাদ সাহেবকে চিকিৎসার জন্য শহরে নিয়ে যায় হামিম। সেখানে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয় তারা। ওই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমাজাদ সাহেবের সমস্যা নিয়ে কথা বলে তারা। পরবর্তীতে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিয়ে অল্পদিনের মাঝেই কাটিয়ে তোলেন এই মানসিক অসুস্থতা। বর্তমানে সাবলীল জীবন যাপন করছেন তিনি।
আমজাদ সাহেব বর্তমানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য রয়েছেন। কেননা তার পরিবারে ছিল একজন সচেতন মানুষ। তার সচেতনাতেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সুস্থ হয়েছিলেন আমাজাদ সাহেব। কিন্তু যার পরিবারে নাই সচেতন কেউ, তখন তার অবস্থা হয়তো পৌঁছায় চরম বিপর্যযতায়।
মানসিক স্বাস্থ্য অবণতির চিকিৎসা না নিয়ে দীর্ঘ দিন ভুগছিলেন শহীদউল্লাহ। বয়স ৬৫ কিংবা ৬৭। পেশায় একজন কৃষক ছিলেন তিনি। একদা শীত মৌসুমে তার মানসিক অবস্থার অবণতি দেখা যায়। এলোমেলো ভাবে কথা বলা, আনমনে কিংবা একা একা কথা বলতে থাকেন তিনি। বিষেশত তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই এ সমস্যাটা লক্ষণীয় হয়। কখনও কখনও বাড়ি থেকে উদাও হয়ে যেতেন তিনি। শহীদ সাহেবের এমন পরিবর্তন দেখে প্রতিবেশিরা ভেবে ছিলেন- হয়তো বদ জ্বীনের প্রভাব এটা। আর যা ভাবনা তাই কাজ। শুরু হয় তার উপর কবিরাজি চিকিৎসা। এতে করে তার মানসিক অবস্থার উন্নতি থেকে অবনতি হতে থাকে বেশি।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তার মানসিক অবস্থার অবনতি ক্রমশই বাড়তে থাকে। একসময় মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যান তিনি। হারিয়ে ফেলেন তার স্মৃতি শক্তিও।
আধুনিক সভ্যতায় পিছিয়ে থাকা প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক গ্রামে তার বসবাস। সেখানে কারো মানসিক স্বাস্থের অবনতি হলে নেতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখে মানুষ। যেখানে একজন মানসিকরোগীর চিকিৎসার প্রয়োজন হয় সেখানে তাকে সম্মুখীন হতে হয় তিরস্কার ও হাসি ঠাট্টার।
শহীদ সাহেবের বেলায়ও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। চলতে-ফিরতে সর্বদা তাকে এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এক সময় তাকে শিকল দিয়েও বেঁধে রাখা হয়েছিল। সচেতনতার অভাব এবং মানসিক রোগের চিকিৎসা বিষয়ক ধারনা না থাকায় এই ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল তাকে। চিকিৎসাহীনতায় এভাবে প্রায় ৮ বছর কেটে যায় শহীদউল্লাহর।
সময়ের বিবর্তনে সে গ্রামে পৌঁছায় আলো। আধুনিকতার পাশাপাশি বাড়ে শিক্ষার হারও। শিক্ষিত তরুণ ও যুবকদের মাঝ থেকে দূরীভুত হয় কুসংস্কার। মানসিক স্বাস্থেরও যে চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে তা নিয়ে অবগত হন তারা। পরবর্তীতে তাদের উদ্যোগে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয় শহীদউল্লাহ। তখন জানা যায়, চিকিৎসা অবহেলায় এমন করুণ দশা হয়েছিল তার। ওই বিশেষজ্ঞের পরামর্শে দীর্ঘ দেড় বছর চিকিৎসা নেয়ার পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান তিনি।
উপরোক্ত দুই প্রবীনের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের এটাই নির্দেশ করে যে, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না নিলে এর পরিনাম হয় ভয়াবহ। আমজাদ সাহেবর নাতি হামিম সচেতন হওয়াতে অল্প দিনেই সমস্যার সমাধান হয়েছিল তার। অপরদিকে শহীদুল্লাহর ভাগ্যে ঝুটেছিল বিপত্তি। চিকিৎসাহীনতায় হারিয়েছিলেন নিজের স্বাভাবিক জীবনটাও। কিন্তু একটা সময় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছিলেন তিনি। সুতারং এটাই মনে রাখতে হবে শারিরিক স্বাস্থের পাশাপাশি যত্ন নিতে হবে মানসিক স্বাস্থেরও। সেটা যে বয়সেই হোক না কেনো। একই সাথে প্রবীনদের মানসিক স্বাস্থের যত্নও নিতে হবে। বিশেষত ওই বয়সে তাদের মাঝে একাকীত্ব দেখা যায়। তাছাড়া কর্ম হারিয়ে নিজেকে অবহেলিত মনে করেন। সে সময়টায় উচিত তাদের মানসিক স্বাস্থেরও যত্ন নেয়া এবং তাদের একাকীত্ব দূরীকরণে সাহায্য করা। পাশাপাশি তাদের মাঝে কোনো প্রকার অবসাদ দেখা দিলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া।
আবু রায়হান ইফাত, গণমাধ্যমকর্মী
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে