পর্ন ও ডিভাইস আসক্তি নিয়ন্ত্রনে প্রতিরোধ নাকি চিকিৎসা কোনটা জরুরি?

0
31
পর্ন ও ডিভাইস আসক্তি নিয়ন্ত্রনে প্রতিরোধ নাকি চিকিৎসা কোনটা জরুরি?

ডা. ফাতেমা জোহরা
সহকারী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

পর্ণ আসক্তি বলতে বোঝায় যখন কেউ চাইলেও পর্ণ দেখা বন্ধ করতে পারে না এবং আসক্তি এমন পর্যায়ে যায় যে এটি দৈনন্দিন কাজ, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক এবং জীবনের অন্যান্য অংশগুলিতেও হস্তক্ষেপ করে। ইন্টারনেট আসক্তি বলতে সাধারণত ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ও বাধ্যতামূলক ব্যবহারকে বুঝানো হয় যার দ্বারা একজন ব্যক্তির জীবনের সামাজিক, পারিবারিক কর্মজীবনে উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়। তরুণরা বিশেষভাবে ইন্টারনেটের আসক্তির ব্যাধি হওয়ার বিশেষ ঝুঁকিতে রয়েছে।

পর্ন ও ডিভাইস আসক্তি

ইন্টারনেট আসক্তির সাথে পর্ণের আসক্তির সম্পর্ক রয়েছে। স্মার্টফোন আসক্তি, কখনও কখনও ‘নোমোফোবিয়া’ (মোবাইল ফোন ছাড়া থাকার ভয়) নামে পরিচিত। প্রায়শই ইন্টারনেটের অত্যধিক ব্যবহার গেমস, অ্যাপস এবং অনলাইন জগতের সাথে আমাদের সংযুক্ত করে। একটি স্মার্টফোন, ট্যাবলেট বা কম্পিউটার খুব সহজেই উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু পর্ণ ও স্মার্টফোনের আসক্তি বিভিন্ন সমস্যাকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে

১. ভার্চুয়াল সম্পর্ক: সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, ডেটিং অ্যাপস, টেক্সটিং এবং মেসেজিংয়ের প্রতি আসক্তি এমন পর্যায়ে হতে পারে যেখানে ভার্চুয়াল, অনলাইন বন্ধুরা বাস্তব জীবনের সম্পর্কের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যার ফলে একটি রেস্তোরাঁয় একটি পরিবারকে একসাথে বসে একে অপরকে উপেক্ষা করে তাদেরকে স্মার্টফোনের সাথে জড়িত থাকতে দেখা যায়।

অনলাইন বন্ধুত্ব আকর্ষণীয় হতে পারে কারণ তাদের একটি আলাদা জগত থাকে যা বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। ডেটিং অ্যাপের ব্যবহার দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তোলার পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি সম্পর্কে পরিবর্তন করতে পারে।

২. অনলাইন বাধ্যতামূলক গেমিং, জুয়া, স্টক ট্রেডিং, অনলাইন শপিংয়ের মতো নিলাম সাইটগুলিতে বিডিং প্রায়ই আর্থিক সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে। জুয়ার প্রাপ্যতা জুয়াকে অনেক বেশি সহজযোগ্য করে তুলেছে। বাধ্যতামূলক স্টক ট্রেডিং, অনলাইন কেনাকাটা আর্থিক এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিকারক হতে পারে। আসক্ত ব্যক্তিরা এর জন্য অস্বাভাবিক সময়ে ঘুমায় এবং জেগে উঠে। তারা এমন জিনিসগুলি ক্রয় করতে পারে যা আসলে প্রয়োজন নেই।

৩. অনলাইনে বিভিন্ন তথ্য দেয়া, বাধ্যতামূলক ওয়েব সার্ফিং, ভিডিও দেখা, গেম খেলা বা নিউজ ফিড চেক করা কর্মক্ষেত্রে বা স্কুলে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন অ্যাপের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বাস্তব জগতের সম্পর্ক থেকে শুরু করে সামাজিক সম্পর্কেও আঘাত হানে।

৪. অনলাইন পর্নোগ্রাফি ব্যবহার ও সাইবার সেক্সে আসক্তি: ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফি ব্যবহার বা সাইবার সেক্স বা পর্নো আসক্তির কারণে বিভিন্ন আনন্দদায়ক যৌন ক্রিয়াকলাপ যেমন নগ্ন ছবি অদলবদল, প্রাপ্তবয়স্ক মেসেজ আদান-প্রদান, অসামাজিক কাজে জড়িত হওয়ার জন্য ইন্টারনেটের ব্যবহার, পর্নগ্রাফির ব্যবহার এসব কাজ বেশি হয়ে থাকে। এর ক্রমাগত ব্যবহার কখনও কখনও আর্থিক, আইনি, পেশাগত, সম্পর্কের সমস্যা বা ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে উদ্ভূত হয়, যার বিভিন্ন নেতিবাচক পরিণতি হয়। এতে করে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বাস্তব জীবনে অসম্ভব কল্পনায় সময় কাটানো সহজ। যৌনতাকে সহজতর করে এমন ডেটিং অ্যাপের অত্যধিক ব্যবহার দীর্ঘমেয়াদি অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে বা সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে।

মনের খবর

পর্নো ও ইন্টারনেট আসক্তির লক্ষণ

১. যারা নিয়মিত পর্নোগ্রাফি ব্যবহার করেন তাদের যৌনতার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা বা লালসা থাকে। তারা যখন উদ্বিগ্ন হয় তখন তারা পর্নে আসক্ত হয়। তাদের কর্মক্ষেত্রে এবং বাড়িতে ঝামেলা করার প্রবণতা থাকে। পর্নের ও ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং প্রতিটি সম্পর্কের অবনতির মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে। ২. পর্নো কত বেশি দেখা হয় সে সম্পর্কে সংজ্ঞা বিভিন্ন রকম। তবে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরা সম্মত হন যে এটি যদি প্রতিদিন ঘটে তবে এটা খুব বেশি আসক্তি।

উদাহরণস্বরূপ, যদি-

  • পর্নো জীবনের একটি কেন্দ্রীয় অংশ হয়ে ওঠে, বন্ধ করলে এটা দেখার প্রবণতা বেড়ে যায়।
  • নিজের ব্যক্তিগত যত্ন অবহেলা করা হয়।
  • অন্যান্য কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
  • সামাজিক যোগাযোগে মানুষ কম আগ্রহী হয়ে ওঠে। • এটি নিজের সম্পর্কের ক্ষতি করে জানার পরও সরে
    আসা কঠিন হয়ে যায়।
  • এটি চাকরি বা স্কুলের কাজকে প্রভাবিত করে।
  • এটিকে এমন জায়গায় দেখা হয় যেগুলি উপযুক্ত নয়, যেমন- কাজ বা স্কুল।
  • যৌন জীবন অসম্পূর্ণ হতে শুরু করে। • উপভোগ না করা সত্ত্বেও ছাড়তে পারা যায় না।
  • ৬ মাস বা তারও বেশি সময় ধরে পর্নো দেখলে।

স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেটগুলির আকার ছোটো এবং সেগুলিকে যেকোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারি এবং যেকোনো সময় আমাদের বাধ্যবাধকতাগুলি পূরণ করতে পারি। আসলে, আমাদের বেশিরভাগই স্মার্টফোন খুব কমই পাঁচ ফুটের বেশি দূরে থাকে। ড্রাগ এবং অ্যালকোহল ব্যবহারের মতো তারা মস্তিষ্কের রাসায়নিক ডোপামিনের ট্রিগার করতে পারে এবং মেজাজ পরিবর্তন করতে পারে।

স্মার্টফোন ব্যবহার প্রায়ই অন্যান্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে, যেমন-মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা বা একাকিত্ব যা এই সমস্যাগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। কেউ যদি সামাজিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ, একাকিত্ব অনুভূতি থেকে মুক্তি দিতে তার স্মার্টফোনটিকে ব্যবহার করেন, তবে তিনি কেবলমাত্র নিজের চারপাশের লোকদের থেকে নিজেকে আরও দূরে সরিয়ে ফেলবেন। অন্য কথায়, উদ্বেগের জন্য যে প্রতিকারটি বেছে নিচ্ছেন (স্মার্টফোনের সাথে জড়িত) তা আসলে তিনি উদ্বেগকে আরও খারাপ করে তুলছেন। স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট আসক্তি জীবনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে:

১. নিঃসঙ্গতা এবং বিষণ্ণতা: যদিও এটা মনে হতে পারে যে নিজেকে অনলাইনে রাখলে অস্থায়ীভাবে একাকিত্ব, বিষণ্ণতা এবং একঘেয়েমির মতো অনুভূতিগুলিকে দূর করতে সাহায্য করবে, কিন্তু এটি আসলে মানুষকে আরও খারাপ অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারের সাথে হতাশা এবং উদ্বেগের মধ্যে একটি সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। ব্যবহারকারীরা বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের সমবয়সিদের সাথে প্রতিকূলভাবে তুলনা করে, একাকিত্ব এবং বিষণ্ণতার অনুভূতি প্রচার করে।

২. উদ্বেগ: কাজের জায়গায় ফোনের উপস্থিতি মানুষকে আরও উদ্বিগ্ন করে তোলে এবং কাজের গুণগত মান আরও খারাপ করে তোলে। একজন ব্যক্তির ফোন যত বেশি ব্যবহার হবে, তত বেশি উদ্বেগের সম্মুখীন হবেন, মানসিক চাপ বেড়ে যাবে। একটি স্মার্টফোন থেকে বার্তা এবং তথ্যের ক্রমাগত প্রবাহ মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে।

৩. ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে: অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার ঘুমকে ব্যাহত করতে পারে, যা সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি স্মৃতিশক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে, পরিষ্কারভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে এবং জ্ঞান এবং শেখার দক্ষতা হ্রাস করতে পারে।

৪. কর্মক্ষেত্রে বা বাড়িতে কাজগুলি সম্পন্ন করতে সমস্যা: অনলাইনে চ্যাটিং, টেক্সটিং বা ভিডিও গেম খেলতে ব্যস্ত থাকার কারণে ঘরের ও বাইরের কাজ জমা হয়। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারার কারণে প্রায়ই দেরিতে কাজ করতে হয়।

মনের খবর

চিকিৎসা

স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট আসক্তির চিকিৎসা করার জন্য যদি সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তাহলে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এমন অনেক চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে যা ডিজিটাল মিডিয়া থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সহায়তা করবে। ব্যক্তিগত এবং গ্রুপ থেরাপি নিতে হবে। কগনিটিভ-আচরণমূলক থেরাপির মাধ্যমে বাধ্যতামূলক আচরণ বন্ধ করা এবং স্মার্টফোন, ইন্টারনেট সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করার জন্য ধাপে ধাপে সাহায্য করবে। থেরাপি অস্বস্তিকর আবেগগুলির সাথে মোকাবিলা করার স্বাস্থ্যকর উপায়গুলি শিখতেও সাহায্য করতে পারে।

নিজেদেরকে একটি ভালো মডেল হতে হবে। বাচ্চাদের অনুকরণ করার প্রবল আগ্রহ থাকে, তাই নিজের স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহার পরিচালনা করা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সন্তানের স্মার্টফোন ব্যবহার নিরীক্ষণ এবং সীমিত করতে অ্যাপগুলি ব্যবহার করুন। এমন অনেকগুলি অ্যাপ রয়েছে যা আপনার সন্তানের ডেটা ব্যবহার সীমিত করতে পারে বা দিনের নির্দিষ্ট সময়ে টেক্সট এবং ওয়েব ব্রাউজিং সীমাবদ্ধ করতে পারে।

প্রতিরোধ

১. কখন আপনার স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারবেন তার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।

২. দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ফোন বন্ধ রাখতে হবে, যেমন- যখন গাড়ি চালানো, মিটিং করা, ডিনার করা বা বাচ্চাদের সাথে খেলা করার সময়।

৩. একাকী থাকলে স্মার্টফোন ব্যবহার করার তাগিদকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতে পারে। তাই এটা পূরণ করার জন্য অন্যান্য উপায়গুলির পরিকল্পনা করা যেতে পারে। যেমন-ধ্যান করা, বই পড়া বা ব্যক্তিগতভাবে বন্ধুদের সাথে কথা বলা।

৪. ফোন বা ট্যাবলেট বিছানায় আনা যাবে না।

৫. ফোন থেকে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ্লিকেশানগুলি সরিয়ে ফেলতে হবে।

৬. নিজের বাসায় ‘ফোন-মুক্ত’ জোন তৈরি করতে হবে। স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটের ব্যবহার বাড়ির একটি সাধারণ জায়গায় সীমাবদ্ধ করতে হবে যেখানে সন্তানের কার্যকলাপের উপর নন্দর রাখা যায় এবং অনলাইনে সময় সীমিত করা যায়।

৭. রাতের খাবার টেবিল এবং শয়নকক্ষ থেকে ফোন সরিয়ে ফেলতে হবে এবং রাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে ফোন বন্ধ করতে হবে পরিবারের সবার।

আপনি যদি আপনার সন্তানের, নিজের বা পরিবারের কারও স্মার্টফোন ব্যবহার বা পর্নো দেখা বা আসক্তি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হন তবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে ভয় পাবেন না, বরং অতি দ্রুত তা নিবেন ও এর
চিকিৎসা করবেন।

আরও দেখুনঃ

Previous articleতীর্যক মন্তব্য কিংবা সমালোচনা নিতে পারি না
Next articleকয়দিন ধরে লক্ষ্য করছি তার বিয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here