ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, Who will watch the watchman? সত্যিই তো। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় আমাদের নিরাময় শিল্পীরা রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, কিন্তু তাদের সুস্থতা কে দেখবে? কে ভাববে তাদের নিয়ে? বলা বাহুল্য, আমাদের দেশের চিকিৎসক, নার্স, স্যাকমো, ওয়ার্ড বয় ও স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট সবাই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। ইতোমধ্যে সরকারি মেডিকেল, বেসরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের স্টাফ কোয়ারেন্টিনে গেছেন। এমন শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে অনেকে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হতে পারেন। চিকিৎসকদের অটল মনোবল ধরে রাখতে না পারলে চলমান সংকট উতরানো অনেকাংশে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আর নিজেদের এই মানসিক সুরক্ষার দায়িত্ব চিকিৎসকদেরকেই নিতে হবে।
যে সকল কারণে একজন চিকিৎসকের মনের শক্তি চিড় ধরতে পারে-
১. শারীরিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি। করোনা আক্রান্ত রোগী ম্যানেজ করতে গিয়ে নিজেই সংক্রমিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে চিকিৎসক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারেন।
২. পিপিই এর অপ্রতুলতা বা মানহীনতা
৩. ২৪ ঘন্টা কর্মস্থলে থাকা ও ছুটি বাতিলজনিত স্ট্রেস
৪. লকড ডাউনের জন্য কর্মস্থলে সঠিক সময়ে উপস্থিত হওয়া বা যাতায়াতের ঝক্কিঝামেলা সংক্রান্ত স্ট্রেস
৫. ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনের বিপরীতে কোন ধরণের প্রণোদনা না পাওয়া
৬.পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা ও তাদের স্বাস্থজনিত দুশ্চিন্তা
৭. সোশ্যাল মিডিয়া ও বিবিধ সামাজিক প্রত্যাশার কারণে চাপ
৮. নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধি ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হওয়ার কারণে চাপ
৯. চিকিৎসকদের পূর্বকালীন বিষণ্নতা ; বিশেষত ক্যারিয়ার, পোস্টগ্রাজুয়েট ডিগ্রী, পরীক্ষা, জব স্যাটিসফেকশন না থাকা, আন্তঃ ক্যাডার বৈষম্যের কারণে তৈরি হওয়া।
১০. সহকর্মীদের আক্রান্ত হওয়া কিংবা মৃত্যু হওয়া
সবাই কি দুশ্চিন্তা, বিষণনতা কিংবা স্ট্রেসে কাবু হবেন? নিশ্চয় না। মূলত যারা-
১। ভালনারেবল পারসোনালিটির অধিকারী, অন্তর্মুখী
২। স্ট্রেস মোকাবেলার সক্ষমতা কম
৩। দীর্ঘদিন কোন মানসিক সমস্যা বা জটিলতায় ভুগছেন তারা মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকবেন।
কখন বুঝবেন আপনি বা আপনার সহযোদ্ধা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ছেন?
– ঘুম কম হওয়া
– মেজাজ খিটখিটে হওয়া
– বিরক্তি চলে আসা
– কোন কাজে মনোযোগ দিতে না পারা
– সহজ কিছু সহজে ভুলে যাওয়া
– রোগী বা অন্যদের সাথে রুঢ় বা অসংযত আচরণ করা
– ক্ষুধামন্দা
– অত্যধিক মৃত্যুচিন্তা পেয়ে বসা
– অস্থির লাগা
– অর্পিত দায়িত্ব পালনে অনীহা তৈরি
– এনজাইটি সিমটমস বেড়ে যাওয়া
– স্মোকিং কিংবা রিক্রিয়েশনাল ড্রাগের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি
এই লক্ষণগুলি দুই বা তার অধিক উপস্থিত থাকলে এবং আপনার প্রাত্যহিক, পেশাগত কিংবা সামাজিক কার্যক্রম ব্যাহত হলে অবশ্যই মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
কিভাবে নিজের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন?
১. নিজের সমস্যা একসেপ্ট করতে হবে। সমস্যার সমাধান অবশ্যই আছে।
২. মনোরোগ নিয়ে স্টিগমার কারণে অনেকে চিকিৎসা নিতে চান না বা বিলম্ব করেন। এ চক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
৩. নিজের মনোবিকার বা সমস্যা নিয়ে আপনার বিশ্বস্ত কলিগের সাথে খোলামেলা আলাপ করুন। সহযোগিতা কিংবা পরামর্শ চান।
৪. ইমোশন ভেন্টিলেশন করুন।
৫. শিথিলায়ন, ইয়োগা, মেডিটেশন করতে পারেন।
৬. ডিউটি শিডিউল রিল্যাক্স করুন। মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকার যত কৌশল আছে এপ্লাই করুন।
৭. স্ট্রেস কোপিং এবিলিটি তৈরি করুন। মানসিক চাপ ও রাগ নিয়ন্ত্রণের কলা কৌশল রপ্ত করলে খুব কাজে দেবে।
৮. শারীরিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য একে অপরের পরিপূরক।
৯. ধূমপান কিংবা অন্যান্য রিক্রিয়েশনাল ঔষধের ব্যবহার যথাসাধ্য কমিয়ে আনুন।
১০. ঘুমের নিয়ম কানুন (স্লিপ হাইজিন) মেনে চলুন।
১১. অবসরে বিনোদন কিংবা সৃজনশীল কাজ, শিল্প-কলা জাতীয় কাজে সম্পৃক্ত রাখুন।
১২. সোশ্যাল মিডিয়ার যৌক্তিক ব্যবহার করুন।
১৩. দুশ্চিন্তা বা এনজাইটি সিমটমস আসলে মনকে অন্যকাজে ব্যস্ত রাখুন বা আবেগকে বিক্ষেপ করুন।
১৪. অতীত বা ভবিষ্যৎ এর ঘেরাটোপে বন্দি না হয়ে বর্তমানে থাকুন। হাতের কাজে মনোযোগ দিন। অর্থাৎ মাইন্ডফুল থাকার চেষ্টা করুন।
১৫. কিভাবে সফলতার সাথে ‘না’ বলা যায় তা রপ্ত করুন।
১৬. মনোচিকিৎসকদের সাথে অনলাইনে যুক্ত থাকুন। প্রশ্ন করুন। কনসাল্ট করুন।
দু:সময় দ্রুত কেটে যাবে। দেশের ক্রান্তিকালে দু:সাহসী ভূমিকা পালন করার জন্য সকল নিরাময় শিল্পীদের হ্যাটস অফ সালাম। শুভেচ্ছা ও শুভকামনা নিরন্তর।
লেখক: ডা. বাপ্পা আজিজুল, রেসিডেন্ট (সাইকিয়াট্রি)
শেয়ার করুন, সাথে থাকুন। সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে।