ডিলুশনাল ডিজঅর্ডার কি স্বাভাবিক জীবনযাপনের অন্তরায়?

0
54

জিয়ানুর কবির
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট

ডিলুশনাল ডিজঅর্ডার হলো এক ধরনের সাইকোসিস জাতীয় মানসিক সমস্যা যেখানে একজন ব্যক্তি বাস্তব এবং যা কল্পনা করা হয় তার মধ্যে পার্থক্য বলতে পারে না। যখন আপনার এই ব্যাধি থাকে, তখন আপনার একটি অটুট বিশ্বাস থাকে যে বাস্তব জীবনে ঘটতে পারে এমন ঘটনাগুলি ঘটেছে, যদিও সেগুলি ঘটেনি। এই ব্যাধির সাথে বসবাসের ফলে আপনি রাগান্বিত, বিরক্ত বা ভুল বোঝাবুঝি বোধ করতে পারেন, তবে আপনি বুঝতে পারবেন না যে আপনার একটি মানসিক সমস্যা আছে। চিকিৎসায় মাধ্যমে আপনার বিশ্বাসগুলো ঠিক করা যায়। চিকিৎসার মাধ্যমে যখন আপনার বিশ্বাস পরিবর্তন হবে এবং স্বীকার করবেন যে আপনার বিশ্বাসগুলি বিভ্রম, তখনই আপনি সুস্থ বোধ করবেন।

ডিলুশনাল ডিজঅর্ডার একটি মানসিক ব্যাধি হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। আপনার যদি এটি থাকে তবে আপনার বিভ্রম এবং বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে সমস্যা হতে পারে। আপনি যে বিভ্রান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন তা সাধারণত অ-উদ্ভট বলে বিবেচিত হয়, যার মানে সেগুলি এমন জিনিস যা আসলে ঘটতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি ভাবতে পারেন যে কেউ আপনাকে অনুসরণ করছে বা আপনাকে দেখছে। আপনার প্রিয় কেউ আপনার খাবারে বিষ দেওযার চেষ্টা করছে।

সিজোফ্রেনিয়া স্পেকট্রাম এবং সাইকোটিক ব্যাধিগুলিতে সাধারণত বিচ্ছিন্ন বিভ্রান্তিকর চিন্তার ব্যাধিগুলি একজন ব্যক্তিকে আরো গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একটি বিভ্রান্তিকর ব্যাধি চরম অসুবিধা সৃষ্টি করবে। বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত প্রতিটি ব্যক্তি জীবনের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে নেতিবাচক ফলাফল অনুভব করবে নিম্নে কিছু বিষয সংক্ষেপে উহাহরণসহ আলোচনা করা হলো:

অন্য ব্যক্তির প্রতি হিংসাত্মক বা রাগান্বিত মনোভাব পোষণ করা: এসব ব্যক্তি ভুল বিশ্বাসের কারণে অন্যব্যক্তির প্রতি হিংস্বাত্মক মনোভাব পোষণ করেন। উদাহরণস্বরূপ: একজন ব্যক্তির ডিলুশনের কারণে মনে হচ্ছে তার পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক তাকে সব সময় অনুসরণ করেন, তিনি তার ক্ষতি করতে চান। তাই তিনি যখনই পাশের ফ্ল্যাটের সেই ভদ্রলোককে দেখবেন তখনই তার রাগ হবে।

রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হওয়া: ডিলুশন থাকার কারণে রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও জটিলতা ও দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়। উদাহরণস্বরূপ। একজন ডিলুশনে আক্রান্ত ব্যক্তি ভাবতে পারেন তার পার্টনার বিপরীত লিঙ্গের কারও সাথে প্রেম করছে। এই ভাবনাটা এতটাই জটিল হয় যে তিনি কোনোভাবেই তার পার্টনারকে বিশ্বাস করতে চায় না। এতে করে সম্পর্কে ব্যাপক অবনতি হয়।

আইনি সমস্যা: ডিল্যুশনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের আচরণের কারণে বিভিন্ন ধরনের আইনি সমস্যায় পড়েন। উদাহরণস্বরূপ: একজন ডিলুশনে আক্রান্ত ব্যক্তি সন্দেহের বশে আরেকজন ভদ্রলোককে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। তিনি মনে করেন যে, তার পিছনে সারাক্ষণ এই ভদ্রলোক লেগে আছে। এই অ্যাটাকের কারণে তাকে পুলিশি মামলা খেতে হয় এবং পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।

কাজ সম্পাদনে অসুবিধা: ডিলুশনাল চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে অন্য কোনো সৃজনশীল কাজ-কর্ম করতে ব্যক্তির খুব কষ্ট হয়। তিনি খুব সহজে এসব কাজ করতে পারেন না। উদাহরণস্বরূপ: একজন ব্যক্তি মনে করেন তার কথাবার্তা বা চিন্তাভাবনা সবাই জেনে যাচ্ছে তাই তিনি অফিসের কাজ আর করতে পারছেন না। তিনি মনে করেন তার কথাবার্তা অন্য অফিসের লোক জেনে গেলেই তার অফিস আর্থিক ঝামেলায় পড়বেন এবং ব্যবসায়ীক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সব তথ্য জেনে যাবে।

চাকরি হারান: ডিলুশনাল চিন্তা মাথায় আসলে এবং এলোমেলো আচরণ করলে তার পক্ষে অনেক কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে, একসময় কোম্পানি তাকে বাদ দিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে তিনি চাকরি হারিয়ে ফেলেন। উদাহরণস্বরূপ: একজন ডিলুশনে আক্রান্ত ব্যক্তি যখন সন্দেহ করেন তার কাজকর্ম অন্যরা জেনে যাচ্ছে তাই তিনি গোপনীয়তা বজায় রাখতে গিয়ে আর কাজ করতে চান না। কাজ না করার কারণে আফিসে অনেক ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় যে কারণে তিনি চাকরি হারিয়ে ফেলেন।

আর্থিক সংগ্রাম: কাজ কর্ম বা চাকরি না থাকার কারণে ডিলুশনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন রকমের আর্থিক সমস্যায় ভোগেন। উদাহরণস্বরূপ: ডিলুশনাল ব্যক্তি তার কথা অন্যরা জেনে যাচ্ছে বা সবাই তাকে ফলো করছে এসব ভাবার কারণে কাজকর্ম ঠিকমতো করতে পারেন না। তাই তিনি মারাত্মক আর্থিক সমস্যায় ভুগেন।

মানসিক ব্যাধির তীব্রতা: ডিলুশন মারাত্বক একটা মানসিক সমস্যা। এই সমস্যার চিকিৎসা না করালে আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে। ব্যক্তির মানসিক সমস্যা তীব্রতাও একসময় বেড়ে যায় এবং দিন দিন চিকিৎসার আওতায় আনা কঠিন হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরুপ: একজন রোগী ডিলুশনে আক্রান্ত হয়ে সারাদিন এসব চিন্তা করতে করতে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে। নিজের চিন্তাগুলোকে সঠিক মনে করে এবং তার ইনসাইট না থাকার কারণে কোনো চিকিৎসা নিতে চায় না।

সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া: ডিলুশনে আক্রান্ত হবার কারণে ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্কে সমস্যা হয়। স্টিগমার কারণে অনেকেই এসব লোকজনের সাথে ঠিকমতো মিশতে চায় না। সমাজে মানুষ তাদের ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দেবার কারণে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ: একজন ব্যক্তি যখন মনে করেন যে, সবাই তাকে ফলো করছে তখন তিনি আর ঠিকমতো বাইরের কোনো লোকের সাথে মিশতে চায় না ফলে সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।

স্ব-আরোপিত বিচ্ছিন্নতা: ডিলুশনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা রোগের তীব্রতা বাড়ার কারণে ঘর থেকে বের হতে চায় না এবং তারা নিজে নিজে সামাজিক পরিবেশে না মিশে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেন। অনেকে আবার নিজেকে অপরাধী ভেবে ঘরের ভিতর আটকে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ: একজন ভদ্রলোক কোনো গাড়ির শব্দ শুনলেই খাটের নিচে গিয়ে লুকিয়ে থাকত কারণ তিনি মনে করেন যে, গাড়িতে পুলিশ বা র‍্যাব এসে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে।

নিজের ক্ষতি করা: অনেক সময় এসব ব্যক্তি নিজের ক্ষতি করতে পারে। তারা রেগে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারেন। নিজের শরীরে আঘাত করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ: একজন মহিলা মনে করেন তার স্বামী চাকরিতে গিয়ে অন্য কলিগের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছেন যদিও এটার কোনো প্রমাণ নেই। অথচ এই ভাবনার কারণে তিনি কষ্ট পেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

শারীরিক সমস্যা: এসব ব্যক্তি সারাদিন ডিলুশনাল চিন্তা করার কারণে তাদের শরীরের প্রতি তেমন যত্ন নিতে পারেন না। পরিবারের লোকজনকে অতিরিক্ত সন্দেহ করার কারণে খাবার খেতেও পারেন না। অপরিষ্কার থাকার কারণে এবং পুষ্টিকর খাবার অভাবে অনেকের বিভিন্ন ধরনের শারীরিক রোগ দেখা যায়। উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, একজন ব্যক্তি ডিলুশনে আক্রান্ত হলে তার স্বাভাবিক জীবনযাপন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। তিনি আশে- পাশের মানুষের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেন। সামাজিক সম্পর্ক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার চাকরি হারিয়ে ফেলেন এমনকি কর্মক্ষমতা কমে যায়। তিনি আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকেন। তাই আরো বেশি ক্ষতি হবার আগে এসব ব্যক্তিকে দ্রুতই চিকিৎসার আওতায় আনা প্রয়োজন।

Previous articleডিমেনশিয়া রোগীদের প্রতিদিনের পরিচর্যায় যেসব বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি
Next articleপারিবারিক সহিংসতায় বাড়ে মানসিক রোগের ঝুঁকি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here