মানসিক রোগের ইতিহাস সম্ভবত মানবজাতির উন্মেষকাল থেকেই। মানবসভ্যতার কালে এ রোগটি কিছুটা স্থিত হয়ে যায়। কালক্রমে সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে নানা জটিল উপাদান যুক্ত হয়ে আবার নতুন পরিগ্রহ করে। দেহ নিয়ে ভাবনা মানুষের যতটা মুখ্য, মন নিয়ে ভাবনাটা সে ক্ষেত্রে ততটা গৌণ। শিল্প-সাহিত্যের চর্চার ফলে এ বিষয়টি ক্রমাগত মানুষের চোখের সামনে আসে। মানুষের অদ্ভুত সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, অভিব্যক্তি- এসবের মধ্য দিয়ে জটিল সব উপকরণ পাওয়া যায়। এসব উপকরণ ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন দার্শনিক নতুন নতুন ভাবনার উপস্থাপন করেন। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীতে এসে এই সব ব্যাখ্যা সুনির্দিষ্ট রূপ পেতে থাকে। মানবসভ্যতার ক্ষেত্রেও নতুন সূত্র আবিষ্কার হতে থাকে।
আড়াই হাজার বছর আগে ইডিপাস নাটকের ঘটনা ব্যাখ্যা করে মা এবং পুত্রের সম্পর্কের নতুন মনোজাগতিক ভাবনা এসে মানুষকে চমকে দেয়। যাকে আমরা জানি ইডিপাস কমপ্লেক্স হিসেবে। আবার শেক্সপিয়ারের নাটকের ওথেলো চরিত্র বিশ্লেষণ করে সন্দেহের দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়, যাকে মনোবিজ্ঞানীরা বলেন ওথেলো সিনড্রম। বিংশ শতাব্দীতে সিগমন্ড ফ্রয়েড মনোবিজ্ঞানে এক ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে মানসিক চিকিৎসা মানে পাগলের চিকিৎসা। এই চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এই বিভ্রম কাটতে সময় লেগেছে এবং আরো সময় লাগবে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ নিজেদেরকেও একসময় খুবই অসহায় মনে করতেন। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বহুদিন আগেই বলেছে, সুস্বাস্থ্য মানে Physical and mental well being. এখন তা হয়েছে Physical, mental and spiritual well being. আমাদের দেশের শিক্ষিত সচেতন মানুষরাও মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেয় না। একজন মনোচিকিৎসকের সঙ্গে একবার বসলেই অনেক বড় মানসিক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এই ভাবনাটা একেবারেই কেউ করতে চান না। মনোচিকিৎসক যেহেতু মনের এবং শরীরের খুঁটিনাটি বিষয় থেকে শুরু করে অনেক বড় ভাবনার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছাবার ক্ষমতা রাখেন, তাই আমার একান্ত জটিল সমস্যাটি তিনিই সমাধান করতে পারেন। আমাদের সমাজে ‘চাপামানুষ’ নামে কিছু মানুষ আছেন, যারা সমস্যাকে জিইয়ে রাখেন, মন খুলে কাউকে কিছু বলেন না বলেই দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যায় পড়ে যান। তাই সেই লোকটি কালক্রমে পরিবারের এবং সমাজের অন্যদের বড় সমস্যায় ফেলে দেন। আবার কেউ কেউ নিজেকে অভ্রান্ত মনে করে তার নিজের কথাকে অপরের উপর চাপিয়ে দিয়ে সবাইকে মানসিক চাপের মধ্যে ফেলে দেন।
মানসিক রোগ কখনো পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থারই ফলাফল। কাউকে ছোট করার জন্য, কোন পেশাকে ছোট করার জন্য তাকে পাগল বলে অভিহিত করা হয়। যেমন, যারা নাটক করেন তাদের নাটকপাগল বলা হয়। যেখানে নাটক একটি সংঘবদ্ধ কাজ এবং সবচেয়ে বেশি মানসিক শৃঙ্খলা প্রয়োজন, সেখানে একজন পাগল কী করে নাটক করবে? অনেক প্রতিভাবানকে, সত্যভাষীকে পাগল বলে আখ্যা দিয়ে তার অবস্থানকে অনেক সময়ই ছোট করা হয়।
আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ যেভাবে বেড়ে গেছে সেখানে মানুষের জীবন-যন্ত্রণাও তীব্রভাবে বেড়ে গেছে। মানুষ কনজিউমার সোসাইটিতে ক্রমেই দিশাহারা হয়ে উঠছে। উদ্দেশ্যবিহীন জীবন, আদর্শহীন রাজনীতি চর্চা মানুষকে মারমুখী করে তুলছে। সেই পরিস্থিতিতে মানসিক রোগের বিস্তার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সর্দি-কাশি, মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড় করার মতো নিত্য রোগের মতোই আছে ছিটেফোঁটা মানসিক রোগ। এই রোগগুলোর জন্যও মনোচিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন। পাগলের ডাক্তারের অস্তিত্ব এখন আর নেই, তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত মনো-দৈহিক ও মনোচিকিৎসা। শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত নানা মানসিক রোগের চিকিৎসায় তারা সিদ্ধহস্ত। আজ অবশ্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু যে বিপুল পরিমাণ চিকিৎসক এবং সেবাকেন্দ্র প্রয়োজন তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। সমাজকে সুন্দর মানসিক স্বাস্থ্য দিতে হলে এ ব্যবস্থারও ব্যাপক উন্নতির প্রয়োজন। আর সে ব্যবস্থা করতে হবে রাষ্ট্রকেই।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।